২৭ শে নভেম্বর, ২০২২
রাত দেড় টা বাজে। পার্কিং লটে বিশ্রামরত গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে আকাশ দেখছিলাম আমি। রাতের অন্ধকারে হাসপাতালের বিপরীতপ্রান্তে বিস্তৃত মাছের ভেড়ির মধ্যে এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়েছে। ছিপছিপে জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে সেই স্থবির জলরাশি। কোথাও কোন ঢেউয়ের ওঠানামা নেই। রাস্তার পার্শ্ববর্তী সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের দলগুলির মধ্যেও নেই কোন হেলদোল। সেরকমভাবে বাতাসও বইছে না তেমন। শুধু হেমন্তের আদুরে হিমেল পরশে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে কয়েক ঘর।
সব কিছু যেন বড্ড সুস্থির।
কিন্তু আসলে তা নয়।
গরম কফিতে আলতো চুমুক দিতে দিতে মাঝরাত্তিরে এই ভাবেই একটু প্রকৃতি নিরীক্ষণ চলছিল আমার। নাইট ‘অন কল’ -এর তাড়নায় ঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে আসতে হলো বেশ কিছুদিন পর। রোগী দেখা শেষ করে এবার বাড়ি ফেরার পালা। তার আগে একটু কফির কাপ হাতে মাঝরাতের মৌতাত। চুপকথাদের জাগিয়ে তোলা।
ফুটবল বিশ্বকাপের গরমাগরম বাজারে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি একটু খালি খালি আজ। একটু আগেই মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়ে সোনারপুরের প্রলয়বাবু এসে পৌঁছেছেন আমাদের হাসপাতালে। সংজ্ঞাহীন রোগীর শ্বাসনালীতে টিউব পড়িয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন আপৎকালীন ডাক্তারবাবুরা। তাঁদের উৎসাহ দিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম রোগীর সিটি স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে। অপারেশন না শুধুমাত্র ওষুধের মাধ্যমে পরবর্তী চিকিৎসা চলবে রোগীর, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, দীর্ঘ আলোচনা চললো সিনিয়র এবং রোগীর স্বজনদের সঙ্গে।
সেই সমস্ত কথোপকথন এবং রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিকল্পনা শেষ করে বেরিয়ে আসছি হাসপাতাল থেকে, দেখা হয়ে গেল শৌনকের সঙ্গে।
শৌনক, আমাদের হাসপাতালের কফি শপের রাতজাগা প্রহরী।
-স্যার,অনেকদিন পর এলেন?
-হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস। মাঝরাতে না এলে, তোর সাথে তো আবার দেখা হয় না!
– বিশ্বকাপের কারণে কিনা জানি না, একদম ফাঁকা বাজার, স্যার। এক কাপ কফি চলবে?
– খাওয়াবি কফি? মাঝরাতে কফি খেলে আবার আমার ঘুম আসবে না। সকাল সকাল অপারেশন রয়েছে আগামীকাল।
শৌনক সে কথাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিলে আমার জন্য।
গত বছরের শেষ দিকে যখন ওমিক্রনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে কলকাতা শহরে তখন থেকেই দেখছি আমি ছেলেটাকে।রাতবিরেতে মাঝে মাঝে হাসপাতালে এলে , প্রায়শই ওর সঙ্গে দেখা হতো তখন। চতুর্দিকে রোগ আর সংক্রমণের করাল ছায়ার মধ্যেও হাসিমুখে পরিষেবা চালিয়ে যেতো শৌনক । উদ্বেগের আবহে কোভিড বিধি মেনেই চলতো দোকানের বেচা কেনা। কানে সর্বদা ইয়ারফোন গোঁজা থাকলেও তাতে ক্রেতাদের কখনো অসুবিধা হয় নি।
মাঝেমধ্যে রাতের অন কলে কফি খেতে খেতে কখন যেন টুকটাক জেনে গিয়েছি ওর সম্পর্কে। ছেলেটি কলেজে পড়ে, এখনো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেনি। কোভিডের থাবা য় আচমকা বাবা মারা যাওয়ার ফলে পরিবারে এসে পড়েছে অতিরিক্ত আর্থিক চাপ । মা আর ছোট বোনের সংসারে, দিনের বেলা পড়াশোনা চালানোর সাথে সাথে রাতের এই ‘অড জব’ টা তাই বেছে নিয়েছে সে । বারুইপুরের বাড়ি থেকে এতদূর এসে কাজ করাটা অসুবিধাজনক হলেও, রোজগারের প্রয়োজনে কাজটা চালিয়ে যেতেই হবে ওকে।
এতদিন পড়াশোনার খরচ চালানো’র লোকটাকেই যে কোভিড কেড়ে নিয়েছে!
দাম মিটিয়ে কফির কাপ হাতে বেরিয়ে এলাম বাইরে। অতিমারির দাপট কমে যাওয়ায় রাতের হাসপাতাল এখন অনেক শান্ত। সেই চাপা উদ্বিগ্ন ভাবটাও কমে গিয়েছে রোগী কমার সাথে সাথে। মূল ফটকগুলির সামনে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুরক্ষা কর্মীরা আড্ডায় ব্যস্ত। ভিতরে বসে থাকা রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা কেউ ঝিমোচ্ছেন অথবা কেউ ব্যস্ত মোবাইল ফোনে।
অসুস্থ প্রলয় বাবুকে ইন্টেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করে, বেরিয়ে এসে তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা ব্যস্ত পরিবারের অন্য মানুষদের সেই খবরাখবর জানাতে। সম্ভাব্য টাকা পয়সা খরচের একটা হিসাব পত্র করছেন হয়তো।
ক্যান্সারের রোগী প্রলয়বাবু ব্লাড প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করে দিয়েই এই বিপত্তি নিয়ে এসেছেন হঠাৎ ।
এইসব চিন্তা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোলে কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা একেবারেই অন্যরকম লাগে।বিশ্বকাপের বাজারে এই মাঝরাতেও অনেক বাড়িতে টেলিভিশন চলছে এখন। হৈ হৈ করে পার্টিতে মজেছে অর্ধেক পৃথিবী। আলো আঁধারে হাসপাতালের পার্কিং লট থেকে, দূরের আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলির খুদে খুদে জানালা থেকে রাতের অন্ধকারে চুঁইয়ে পড়ছে উচ্ছ্বাসের আলো। জেগে রয়েছে আনন্দের পল অনুপল।
সেখানে একই ধরিত্রীর অন্যপাশে হাসপাতালের আই সি ইউ-তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা খেলছেন আরও কিছু মানুষ। কফি শপে বা অন্য কোন পেশায় এই রকম ‘অড জব’ করে জীবন যুদ্ধে টিঁকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শৌনকের মতো যুবকেরা। কিছু চিকিৎসক মধ্যরাতের নীরবতার মাঝে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কোন মৃত্যুপথ যাত্রীর হাত আঁকড়ে ধরার।
তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভাবেই ঘুরতে থাকে ঘড়ির কাঁটা। কেটে যায় দিন, মাস আর বছর। এই বৈপরীত্য নিয়ে বেঁচে থাকার নামই তো জীবন। তাই না?
আকাশের দিকে তাকাই আবার। খুদে খুদে তারার দল উঁকি মারছে আধো অন্ধকার থেকে। ফুটফুটে চাঁদটা বোধহয় হাসপাতাল বিল্ডিং-এর অন্য পাশে গিয়ে লুকিয়েছে।
ইঞ্জিন স্টার্টের আওয়াজে নৈঃশব্দ্য ভেঙে যায় খানিক। হেড লাইটের আলোয় পরিষ্কার পথঘাট। মাঝরাতের বাইপাসে চলমান ভারী ভারী ট্রাকগুলিকে সাথে নিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা।
আবার কাল ফিরে আসার জন্য, একবুক আশা নিয়ে।