সবেমাত্র সকাল দশ টা বেজেছে। শম্বুক গতিতে গাড়ি চলছে রুবি হাসপাতালের সামনে দিয়ে।জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা। বুঝলাম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। কারণ এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খবর পড়ছিলাম মুঠোফোনের খবরের কাগজের পাতায়। কেসের সংখ্যা আবার বাড়ছে দেশে। ওমিক্রণের কোন এক মিউট্যান্ট ভাইরাস দেশে ঢুকে সংক্রমণের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলছে। খবর বলছে কাল সারাদেশে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ কোভিডে সংক্রামিত হয়েছেন।
জানালার বাইরে আবার চোখ গেল। গোটা বাইপাস জুড়ে লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। লম্বা ট্রাফিক জ্যাম। এরকম সাধারণত এই সময়ে হয় না।
মনে পড়ছে ফেলে আসা গত দু বছরের কথা। জনবিরল রাস্তাঘাট, এক্কাদোক্কা গাড়ি, খোলা ট্রাফিক সিগনাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া হাসপাতালে।
মাঝে মাঝে শুধু সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছুটে যাওয়া, আর মাঝে মাঝে অচেনা মরদেহ নিয়ে শববাহী গাড়ির একাকী ঢিমেতালে চলন। আমফানের পর অন্ধকারে ডুবে থাকা রাজপথ, রোগ, মৃত্যু আর বেকারির সহাবস্থান।
তখন নিরন্তর চাইতাম মানুষ ফিরে আসুক, গাড়িঘোড়া ফিরে আবার ভিড় জমাক রাস্তায়। নিরিবিলি ভারি অসহ্য লাগতো একেক সময়।
অতিমারির মাত্রা কমেছে এখন। বড় বড় তরঙ্গগুলি ক্ষতি করে দিয়ে গেছে অনেক। তার রেশ কাটানোর চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে।
এবারের কোভিড সেই অর্থে যেন খুব জোরদার নয়। এখনো সেই রকম হারে মানুষ মারতে পারছে না বলে পাত্তা পাচ্ছেও না বিশেষ। আর একদমই টেস্ট না হওয়াতে কোভিড রোগীর যে সংখ্যা খবরে দেখাচ্ছে,তা একেবারেই হাস্যকর। সন্ধ্যার চেম্বারে বসলেই মালুম পাওয়া যাচ্ছে সেটা।
প্রচুর মানুষ আসছেন জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে, বিশেষত বাচ্চারা। তার মধ্যে বেশ কয়েকজনের দু এক দিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছে গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা। তবে যাদের সেইরকম কোন শারীরিক অসুবিধা নেই (শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) তাঁরা সুস্থ হয়ে উঠছেন দ্রুত। যাঁরা ভাগ্যক্রমে কোভিডকে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন আগের ওয়েভগুলিতে তাঁরা কিন্তু পটাপট অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এই হালকা চালে ঘুরে বেড়ানো ভাইরাসের সংক্রমণে।
আমার বাড়িতে ঠিক এই ঘটনাই ঘটলো। পাঠক বন্ধুরা জেনে থাকবেন কিছুদিন আগেই আমি কাশ্মীর গিয়েছিলাম। বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম আমার বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়িকে। ফিরে এসে দেখি শ্বশুরমশাই হাল্কা কাশছেন। আমার ডাক্তারি মনে সন্দেহ বাসা বাঁধলো। খবর পেয়েছিলাম আমাদের রান্না করার মহিলাও মাঝে একদিন সামান্য শরীর খারাপের জন্য কামাই করেছে। আর ঠিক তাই, দু দিনের মধ্যে জ্বর,কাশি আর স্বাদ চলে গেল শ্বশুরমশায়ের। তার সাথেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন শ্বাশুড়ি মা। আমার বাড়িতে উনারা একটা ঘরে আইসোলেটেড থাকলেও আমার স্ত্রী সোমা তাঁদেরকে দেখাশোনা করছিলেন।
আর আমার ধারণাকে আবার সঠিক প্রমাণিত করে, স্বাদ গন্ধ চলে গিয়ে জ্বর, কাশি নিয়ে খুব
দ্রুত সংক্রামিত হলেন স্ত্রী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সোমার এর আগে কোভিড হয়নি, গত ডিসেম্বরে আমার এবং আমার মেয়ের করোনা হওয়া সত্ত্বেও।
বাড়িতে ঘরের তুলনায় রোগী বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে আর কাউকেই আইসোলেট করা সম্ভব হলো না। আমি এবং আমার স্ত্রী এক সাথেই থাকতে লাগলাম। স্ত্রী এবং কোভিড উভয়ের সাথেই সহবাস।🙂
এখানে এটাও জানিয়ে দেওয়া দরকার যে আমরা সকলেই কিন্তু নিয়মমাফিক বুস্টার বা প্রিকশনারি ভ্যাকসিন নিয়েছি গত এপ্রিল মাসে। আর শ্বশুর শ্বাশুড়ির ২০২০ তে কোভিড হয়ে গিয়েছিল তার আগেই।
এইখানেই এবারের মিউট্যান্ট ভাইরাস জিতে যাচ্ছে। মারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে, হয়ে উঠেছে তীব্র সংক্রামক। বাড়িতে ঢুকলে সবাইকে পজিটিভ করে দিয়ে যাচ্ছে। পুরনো কোভিডের অ্যান্টিবডি এখানে সুরক্ষা দিতে পারছে না।
সোমার সাথে আমার সাতদিন থাকা সত্ত্বেও আমার কিন্তু বিশেষ কিছু হল না। হয়তো গা বা মাথা ব্যথার মতো সাব ক্লিনিক্যাল ইনফেকশন বা নিকট অতীতে কোভিড সংক্রমণ এবং ভ্যাক্সিনেশনের জন্য শরীরে তৈরি হাইব্রিড ইমিউনিটি এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল আমায়। সোমাও
সুস্থ হয়ে উঠলো তারপর।
চারিদিকের খবর কিন্তু একটু চিন্তা বাড়াচ্ছে। বাচ্চাদের সাথে বড়রাও সংক্রামিত হচ্ছেন সমান ভাবে। হাসপাতালে আমাদের কোভিড যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া পালমনোলজিস্ট সুস্মিতা আক্রান্ত হলেন। সংক্রামিত হলেন আমার সিনিয়র নিউরোসার্জন থেকে জুনিয়র নিউরোলজিস্ট। শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় সুস্মিতাকে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলাম সকলে। শেষ পর্যন্ত সবাইকে স্বস্তি দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে সংক্রামিতরা।
এর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন ভ্যাক্সিন বা আগে ঘটে যাওয়া ইনফেকশন নতুন মিউট্যান্টের সংক্রমণ রুখতে পারবে না। ক্রিটিকাল কোভিড আটকে দিতে পারবে শুধু। আর বারবার সংক্রমণ হলে লং কোভিডের সম্ভাবনা বাড়বে রোগীর।
এই সব চিন্তা করতে করতে লক্ষ্য করলাম গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাধাচূড়া গাছটা ফুলে ভরে উঠেছে। মেঘ কাটিয়ে আকাশে রোদ্দুরের আভাস দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম, গাড়ি চলুক,মানুষের ভিড়ে ভরে থাক রাস্তাঘাট আর দোকানপাট।
জানি, কোভিডের ছোট ছোট তরঙ্গ আসবে কিছু মাস পরে পরেই, মারণ হার না বাড়াতে পারলেও সংক্রামিত করার শক্তি নিয়ে। মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা র মতো হয়ে যাবে এ ভাবেই। আর সেই সংক্রমণ রুখবার জন্য নিতে হবে ভ্যাকসিন, বার্ষিক’ ফ্লু শট ‘ নেওয়ার মতো। বয়স্ক এবং আপাতত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজন মতো বছরে এক বা দু বার নিতে হবে বুস্টার।
সাংবাদিক খবর শেষে লিখছেন, সরকার বাহাদুর এবার নাকি নড়ে চড়ে বসেছেন কোভিডের জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং ভ্যাকসিনেশন ড্রাইভ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। যা দেরি হলেও স্বাগত।
রাস্তায় ভিড় থাকলে কোভিড থাকবেই। তাই সোস্যাল ডিসটেন্সিং এখন আর সম্ভব নয়। তবে যেটা সম্ভব সেটা মাস্কের ব্যবহার। বিশেষত বাজারে, ভিড়ে আর হাসপাতালে।
বয়স্কদের আর শারীরিক অসুবিধা থাকলে কম বয়সীদের অবশ্যই নিতে হবে বুস্টার ডোজ।বছরে একটি বা দুটি। যেরকম সরকারের নির্দেশাবলী থাকবে, ঠিক সেরকম।
এই ভাবেই ধীরে ধীরে এন্ডেমিক হয়ে যাবে কোভিড। আমরাও বেরিয়ে আসতে পারবো
অতিমারির ভ্রূকুটি থেকে।
ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন সকলে। প্রয়োজন হলে আবার ফিরে আসবো কোভিডের দিনলিপি নিয়ে।