শুরুটা দেখে অনেকে চমকে যেতে পারেন। ভাবতে পারেন একজন শিক্ষিত মানুষের এ হেন শব্দ চয়নের কি কারণ?বাংলা ভাষায় বিরক্তির মনোভাবকে প্রকাশ করার মতো প্রতিশব্দের তো অভাব নেই! তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। লেখা এগোনোর সাথে সাথেই পরিষ্কার হয়ে যাবে এই নামকরণের সার্থকতা।
কাল সারাদিন ধরে আউটডোর চলছিল আমাদের। দিনের শেষ কনসালটেশন এসে উপস্থিত। হাতে একতাড়া ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট নিয়ে হাজির দুটি কমবয়সী ছেলে। রোগী সম্পর্কে তাদের দাদু, ভর্তি আছেন রাঁচির কোন এক হাসপাতালে। ভেন্টিলেটরে রয়েছেন আপাতত। এরা কলকাতায় এসেছে মূলত বৃদ্ধের চিকিৎসায় আর কিছু করা যায় কিনা তা জানতে।যদি করণীয় কিছু বাকি থেকে থাকে তবে রোগী কে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে আসবে এই হাসপাতালে তৎক্ষণাৎ। বয়স্ক মানুষটির মাসখানেক আগে করোনা সংক্রমণ হয়। ৭৫ বছর বয়সেও লড়াই করে দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ঝটপট। দিন তিনেক আগে বাড়িতে কথা জড়িয়ে যায় আচমকাই। হাসপাতালে ভর্তি হতে হতেই অজ্ঞান হয়ে যান বৃদ্ধ এবং সেই থেকে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ভেন্টিলেটরের সহায়তায় রয়েছেন।
উনার ব্রেন স্ক্যানে পাওয়া গিয়েছে অনেকগুলি স্পট। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে মেটাবলিক এনসেফালোপ্যাথি। কোভিড সংক্রমণের বাই প্রোডাক্ট। শরীরের ইমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কেও আঘাত হেনেছে কোভিড। অথচ মানুষটি কোভিড নেগেটিভ হয়েছেন ঠিক দিন পনেরো আগে।
ছেলেদের বলে দেওয়া হলো রোগীর চিকিৎসা সেখানেই চালিয়ে যাবার জন্য। এখানেও এর বেশি কিছু করা সম্ভবপর হবে না বলে।
আজ এক সিনিয়ারের সাথে কথা হচ্ছিল সার্জনস রুমে। আমাদের হাসপাতালে জেনারাল সার্জারি করেন। কথায় কথায় জানালেন তার এক বন্ধুস্থানীয় ভদ্রলোক কোভিডের কবলে পড়ে ভর্তি হয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালে। মাঝবয়সী মানুষটি ইন্টেনসিভ কেয়ার হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন প্রায় ১৭ দিন বাদে, নেগেটিভ হয়ে। দুর্বলতা থাকলেও অনেকটাই সুস্থ অবস্থায়। বাড়িতে ফেরার ৭ দিন বাদে আবার জ্বর এবং আবার হাসপাতালে ভর্তি। বুকের সিটি স্ক্যানে দেখা গেল পালমোনারি ফাইব্রোসিস। কোভিডের প্রদাহে ফুসফুস দুটি শুকিয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এবার আর সুস্থ হয়ে ফিরে আসা হলো না ভদ্রলোকের। চলে গেলেন চিরদিনের মতো।
তাই একবারে কোভিড সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারছেন না অনেকেই। শরীর থেকে ভাইরাস বেরিয়ে গেলেও যে হাইপারইমিউন রেসপন্স তৈরী করে ফেলছে কোভিড, ডিফেন্স সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে তার ফল অনেকের ক্ষেত্রেই হচ্ছে সুদুরপ্রসারী। বিশেষত যাদের রয়েছে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ অথবা কিডনির অসুখ।
কোন বয়সের রোগীর ক্ষেত্রে এই ‘সাইটোকাইন ‘ ঘূর্ণিঝড় শুরু হবে শরীরের ভিতর তা বলা যাচ্ছে না কোন চিকিৎসকের পক্ষেই। আর এখানেই আচমকা জিতে যাচ্ছে কোভিড। ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জীবন।
তাই কাছাখোলা অবস্থায় জনগণের এই বিপজ্জনক ভাবে বাজার হাটে ভীড় বাড়ানো বা দীঘা মন্দারমণির সুইমিংপুলের জলকেলির দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে মনে হয় মহামারীতে অসুস্থ মানুষ আর আনন্দপ্লাবনে ভেসে যাওয়া এই পাবলিকেরা যেন দুটি আলাদা পৃথিবীর। সেখানে দুঃখ নেই,মৃত্যু নেই আছে শুধুই সুখের ফল্গুধারা।
একদিকে রয়ে গেছেন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীর দল যারা প্রতিদিন নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন আর অন্যদিকে রয়েছে জীবনের যাবতীয় ফূর্তি আলিঙ্গনের জন্য প্রস্তুত পাবলিক।
‘মহামারী বলে কিছু নেই ওটা গোল্লায় যাক’
-‘এটা তৈরী করেছে ডাক্তার আর WHO, ভয় দেখিয়ে পয়সা কামানোর জন্য’
-‘যারা মরার তারা এমনিই মরবে’
-‘যাদের হওয়ার তাদের এমনিতেই হবে’,
-‘মাস্ক হচ্ছে প্ল্যাসিবো,রোগ ছড়ানো ঠেকাতে এর কোন ভূমিকা নেই’–এই সমস্ত কথাবার্তায় ভরে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাংশ।
উত্তেজিত জনগণ মাস্ক ছাড়া বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়, হাটে বাজারে, শপিং মলে অথবা বসে পড়ছে ক্যাফেতে গায়ে গা ঠেকিয়ে। মাস্ক ছাড়া ফটো আপলোড হচ্ছে ফেসবুকে আর হোয়াটসঅ্যাপে। গর্বিত কুশীলবদের কানে, গলায় অথবা কপালে উঠেছে মাস্ক। নাক আর মুখ না দেখিয়ে তো ছবি তোলা যায় না!
‘দ্যাখ শালা ভাইরাস, কেমন দিলাম তোকে!’
বডি ল্যাংগুয়েজে একদম স্পষ্ট সেই ভাব।
শুধু আমরা ডাক্তাররা জানছি হাসপাতালের ভিতরে কি ঘটছে। কি চলছে আই সি ইউ তে। ঠিক কতদিন পরেও মানুষকে ফিরে আসতে হচ্ছে আবার হাসপাতালে। সংকটজনক রোগীর সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে অনেক কম। শতকরা পাঁচ ভাগের কাছাকাছি। রোগ ছড়িয়ে পড়লে সেই পাঁচভাগ কিন্তু বীভৎস চেহারা নিতে পারে। ১০০ জনের ক্ষেত্রে যেটা পাঁচজন, সেটা ১ লাখ বা ১ কোটির মধ্যে কজন হবেন তার হিসাবটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আমাদের দেশের ইন্টেন্সিভ কেয়ারে পাওয়া যাবে তো প্রয়োজনীয় বেড?
একটা কথা স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে। কোভিড মহামারী নিয়ে একমাত্র মতামত জানাতে পারেন চিকিৎসারত ডাক্তারেরা, চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা। তাই এর বাইরে যারা এটাকে মহামারী নয় hoax,পয়সা খাবার ধান্দা বলে ফেসবুকে মহাপুরুষের মতো জ্যোতি ছড়াচ্ছেন, পাবলিককে উসকানি দিয়ে হাটবাজার গরম করছেন অথবা দীঘা মন্দারমণির জলকেলির ছবি আপলোড করাচ্ছেন এদের সবাইকে আমি এটাই মনে করি।
ঢ্যামনা।।