খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল এই সপ্তাহটা। ভেবেছিলাম মহামারীর চাপে বোধ হয় আপাতত দৈনিক সার্জিক্যাল কেসের সংখ্যায় ভাঁটা পড়তে চলেছে। হাসপাতালে একের পর এক ওয়ার্ড যখন কোভিড রোগীতে ভরে উঠছে আর কমে যাচ্ছে নন কোভিড রোগীর পরিষেবার পরিসর, তখন তো সেটাই হওয়ার কথা।
আগের সপ্তাহ থেকেই হাসপাতালে অন্য বিভাগের চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের টেনে নেওয়া হচ্ছে সংক্রমণ মোকাবিলায়। যা সময়ের দাবি মেনে একদমই স্বাভাবিক। আমাদের মত সার্জিক্যাল স্পেশালিটির ডাক্তাররাও নেমে পড়েছি সরাসরি সংক্রমণের চিকিৎসায়, বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ডিউটি রোস্টার।
মেডিসিনের সাথে নিউরোসার্জারি অথবা কার্ডিওথোরাসিকের ডাক্তাররাও যেমন ওয়ার্ডে নেমে পড়েছেন কোভিড মোকাবিলায়, গাইনোকলজির চিকিৎসকরাও ঠিক তেমন ভাবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন ইমার্জেন্সিতে মহামারীর চিকিৎসায়। অ্যানেস্থেটিস্টরা দায়িত্ব নিয়েছেন HDU সামলানোর।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন আর চিকিৎসকদের আলাদা পরিচয় বলে কিছু নেই। সব মিলেমিশে একদম একাকার। ডাক্তারদের ছোট খাটো জমায়েতে এখন আলোচনায় শুধুই স্টেরয়েড, অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট,অক্সিজেন থেরাপি অথবা ভ্যাকসিনেসন। তবে ওই যে, ভাবনা আর বাস্তবে সব সময় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা, কোভিড ব্যতিরেকে গোটা সপ্তাহ জুড়েই চললো আমাদের সার্জারি।
ভাইরাস সংক্রামিত রোগী বেশ কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের স্ট্রোকের সমস্যা নিয়ে এসে পড়ছেন ইমার্জেন্সিতে। তাদের মধ্যে দু জনকে অপারেশন করতে হলো এ সপ্তাহে। সার্জারি র পর দুজনের অবস্থাই অবশ্য এখন স্থিতিশীল।
আরো দু টি ব্রেন টিউমারের অপারেশন হলো এই কোভিডের বাজারেও।এক বয়স্কের ঠিক পরের দিনই এক যুবকের ।তারসাথে গতানুগতিক মেরুদণ্ডের সার্জারি তো রয়েছেই। তাই, পজিটিভ রোগী বেড়ে যাওয়াতে এখন প্রায়শই আমাদের রাউন্ডে যেতে হচ্ছে কোভিড আই সি ইউ গুলোতে। সার সার বেডে ভেন্টিলেটেড রোগী যে কোন ইন্টেন্সিভ কেয়ারে একটা সর্বত্র পরিচিত দৃশ্য।
কোন চিকিৎসকের কাছেই তা বিস্ময় উদ্রেক করার মতো ঘটনা নয়।
কিন্তু এই সংক্রমণে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে ভাইরাসের উপস্থিতি। মেঘনাদের মতো যাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু সে ঘিরে রয়েছে আপনার চারপাশে। আপনি বুঝতে পারছেন যে বন্দুক তাক করা রয়েছে ঠিক আপনার মাথার উপর, একটু বেচাল হলেই ঠিকরে বেরিয়ে আসবে অগ্নিশলাকা…….! তাই এই ইন্টেন্সিভ কেয়ার স্বাভাবিক নয়।
একটা দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে ডাক্তার, সিস্টার অথবা স্বাস্থ্যকর্মী দের। ভিতর ঢুকলেই ফেস শিল্ড,মাস্ক আর গ্লাভসে গ্ল্যাডিয়েটরের মতো চেহারা সবার।কোন প্রসিডিওর করার আগেই পরে নেওয়া হচ্ছে সার্জিক্যাল গাউন অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী পিপিই।
এই পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করতে হলে দরকার শারীরিক সক্ষমতার সাথে প্রচণ্ড মানসিক দৃঢ়তা। যদিও যারা এখানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন,তাদের সে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা আছে। তবুও তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে রোজ কাজ করলে যা হয়, মাঝে মাঝেই মেজাজ বিগড়োচ্ছে অনেকের। তা সামলে নিয়েই বাকিদের কাজ করে যেতে হচ্ছে।
এইসব কথাই মনে পড়ছিলো সেদিন কোভিড আই সি ইউ তে থাকা আমাদের রোগীর মাথার ড্রেসিং সরিয়ে, ড্রেন পাইপটি বার করতে করতে। ভাবছিলাম এই যে একটা জ্যান্ত অতিমারীকে আমরা আমদের দেশের উপর দিয়ে ঝড়ের মতো বয়ে যেতে দেখছি, যা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে, রোগীদের মতোই ভেন্টিলেটরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে,এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
তরঙ্গের পর তরঙ্গের আঘাতে একদম দিশাহারা মানুষ। একবার বাড়িতে ঢুকতে পারলে একেকটি পরিবারের বেশ কিছু সদস্যকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ এর মতো। খুব কম সময়ের মধ্য প্রচুর মানুষকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা থাকায়, রোগের চাপে প্রায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে, দীর্ঘদিনের দুর্বল দেশের স্বাস্থ্যপরিকাঠামো। আর এর ফলশ্রুতিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ডাক্তার সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। আমাদের সারাদেশে এখনো পর্যন্ত প্রায় এক হাজার চিকিৎসক মারা গিয়েছেন সংক্রামিত হয়ে।
চিকিৎসকের মৃত্যু তে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্য পরিষেবা।
কারা চিকিৎসা চালাবে এর পর? কতগুলি ঢেউ আসবে আর? আমরা কেউ জানি না!
তাই এই মুহূর্তে একমাত্র উপায় ‘মাস ভ্যাকসিনেশনের’ মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে সচেষ্ট হওয়া। শতাব্দীপ্রাচীন ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কয়েকদিনের মধ্যেই যে পুনরুজ্জীবন লাভ করবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। যে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দকে স্বাধীনতার পর থেকে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই বাড়ানো সম্ভবপর হলো না, সেই ত্রুটিকে একেবারে নগ্ন করে দিয়ে গেল ভাইরাস। সারি সারি সংক্রামিত রোগীদের মাঝে দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে , মনে হয় অজান্তেই যেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকছি। যদিও আমাদের ভবিষ্যৎ কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে, তা আমরা কেউ জানিনা; তবুও এই সংক্রমণের ঝড়ের মাঝে অন্য স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে একজোট হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা একটা অন্য অভিজ্ঞতার জন্ম দিচ্ছে।
কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসছি যখন দেখা হয়ে গেল আমাদের পালমোনলজিস্ট, কোভিড টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার সুস্মিতার সঙ্গে। সুস্মিতা আমার মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র। ছোটখাটো চেহারা হলেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তবে আজ ওকে একটু অন্যরকম লাগছে। দীর্ঘদিন লড়াইয়ের অবসাদ কি ঘিরে ফেলছে ওকেও? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম।
“না দাদা, এত ফোন কল আসছে যে রাত্রে ঘুমাতে পারছিনা। আর তুমি হয়তো জানো না আমার নিজেরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে।”
হেসে ফেললো সুস্মিতা।
“আর জানো, ঠিক এই জন্যই পালমোনলজি নিয়েছিলাম।”
আমরা সবাই জানি যে নিজে শ্বাসকষ্টের রোগী হয়, সে সবথেকে ভালো বুঝতে পারে শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা। একজন ডাক্তার হলে তো কোন কথাই নেই। আর এই ভাইরাস মূলত সংক্রামিত করছে ফুসফুসকে এবং বাড়িয়ে দিচ্ছে শ্বাস নেওয়ার সমস্যা। তাই যে কোনো শ্বাসকষ্টের রোগীর ক্ষেত্রে, তা ডাক্তার বা যেই হোক না কেন; এই রোগ সমস্যা সৃষ্টি করবে আরো অনেক বেশি। হাসির কারণটা আমার বোধগম্য হলো এবার! ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমরা যে এই মহামারীতে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে সাথে লড়ে যাচ্ছি নিজেদের সব ব্যক্তিগত যুদ্ধগুলিও। কে তার খবর রাখে!
কিন্তু সম্মুখ সমরে তো আর পিছপা হওয়ার জায়গা নেই কারো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সকলের। পরিবার-পরিজন সব ভুলে গিয়ে এ এক ব্যক্তিগত লড়াই এখন আমাদের। যেন মনে হচ্ছে ফুটবল খেলার মাঠে পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরে একের পর এক ফ্রি কিক মারছে ভাইরাস। আমরা ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ওয়াল তুলে রেখেছি। পিছনে গোল লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সংক্রামিত মানুষ তথা দেশের জনগণ।
সবাই নির্দেশ দিচ্ছে পিছনে দাঁড়িয়ে। “এদিক সামলাও…….,ওদিক সামলাও…….”
গোলপোস্ট কভার করার জন্য আমরা সকলে একবার বাঁদিকে সরছি, আরেকবার ডানদিকে! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে করেই হোক এই গোল করা প্রতিহত করতেই হবে। তবে এই দ্বিতীয় ঝড় ধীরে ধীরে কমে আসছে সারা দেশের মতো এই রাজ্যেও। তাই সপ্তাহের শেষের দিকে কোভিড ওয়ার্ড গুলির সংখ্যা কমানো শুরু হয়ে গিয়েছে প্রায় সব হাসপাতালেই। সেটাই ভালো খবর। উৎসাহব্যাঞ্জক।
তবে এর মধ্যেই আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে পরবর্তী ওয়েভের। ভ্যাক্সিনেশন ড্রাইভ, অক্সিজেন আর জীবনদায়ী ওষুধের জোগান বাড়িয়ে ফেলতে হবে যেরকম ভাবেই হোক। তৃতীয় ওয়েভ কি নতুন উপসর্গ নিয়ে আসবে তা আমাদের জানা নেই। এই মারণ ভাইরাস প্রথম থেকেই তার সংক্রমণের মুন্সিয়ানায় চমকে দিচ্ছে সকলকে। সামনে আর কি চমক অপেক্ষা করে আছে কে জানে!
তাই ভালো থাকুন। সাবধানে থাকুন সব।
পরের সপ্তাহে সংক্রমণের হার আরো কমে যাওয়ার প্রত্যাশা থাকলো।
তবে প্রস্তুতি শুরু হোক পরের রাউণ্ডের জন্য। এখন থেকেই।