অমিক্রন, অমিক্রন। সারা বিশ্বজুড়ে আপাতত ত্রাসের কারণ। বাংলা তথা সারা ভারতের বেশিরভাগ জনগণ যখন মাস্ক খুলে, সামাজিক দূরত্বকে দূরে সরিয়ে রেখে পুজো আরা নানারকম আনন্দ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে; রিভেঞ্জ ট্যুরিজমের নামে ফ্লাইট বুকিং আর ছোট, বড়, মাঝারি সব ধরনের হোটেলেই স্থানাভাবের ছাপ হয়ে উঠছে স্পষ্ট, ঠিক তখনই খারাপ খবর ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে উৎপাত শুরু করেছে কোভিড ভাইরাসের নতুন মিউটেটেড প্রজাতি। যার সংক্রামিত করার শক্তি নাকি সমকালীন ডেল্টা ভাইরাসের থেকে অনেক টাই বেশি। আর বিজ্ঞানসম্মত নাম B.1.1.529। ঠিক এইরকম ই বলছেন বিজ্ঞানীরা।
এতদিনে আমরা সবাই জেনে গিয়েছি যে কোভিডের সেই স্পাইক প্রোটিনটিই হচ্ছে সব নষ্টের মূল, কারণ তা ব্যবহার করেই ভাইরাস ঢুকে পড়ে আক্রান্তের শরীরে। আর ঠিক সেই স্পাইক প্রোটিনেই প্রায় বত্রিশ রকম মিউটেশন করে আরও ক্ষমতাশালী হয়েছে এই নতুন মিউট্যান্ট।বাড়িয়েছে তার সংক্রমণ করার ক্ষমতা। যাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে বিজ্ঞানীরা নামকরণ করেছেন গ্রীক বর্ণমালার পঞ্চদশ বর্ণ অমিক্রনের নামে, যা কিনা এই মুহূর্তে WHO-এর পরিভাষায় variant of concern, সংক্ষেপে VOC। মোদ্দাকথা অত্যন্ত চিন্তাজনক।
ইন্টারনেট আর গ্লোবালাইজেশন এর যুগে সারা পৃথিবী একত্রিত এখন।উড়োজাহাজ আর মানুষের চলাচলের ক্ষেত্র এখন আর স্থান, কাল আর পাত্রে থেমে নেই। তবে ভালো খবরের তুলনায় খারাপ খবর ছোটে দাবানলের মতো। তাই এ খবর সুদূর আফ্রিকা থেকে এদেশে আসতে দেরি করেনি এতটুকুও।
আগের ওয়েভের ডেল্টা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কথা আশাকরি আমাদের সকলেরই মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই ডেল্টা বা তার মিউটেশন গত মে মাসে আমাদের সবাইকে এই বয়ে চলা অতিমারীর সবচেয়ে মারাত্মক সময় দিয়ে গেছে। আক্রান্ত মানুষে উপচে পড়েছে হাসপাতাল, আলমারি থেকে বেরিয়ে পড়েছে দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার কঙ্কাল। অক্সিজেনের অভাবে দেশজুড়ে মানুষের হাহাকার।
সিঁদুরে মেঘ জমেছে আবার। এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা নাকি ডেল্টার চেয়ে তুলনায় অনেক বেশি। নতুন সংক্রমণে ডেল্টাকে দ্রুত সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে অমিক্রন। অন্তত নব্বই শতাংশ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এরকমই খবর দিচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা।
দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবোয়ে, নামিবিয়া ছাড়াও অমিক্রনের সংক্রমণের খবর আসছে ইজরায়েল, হংকং, বেলজিয়াম থেকেও। তাই গত বুধবার থেকেই আফ্রিকার দক্ষিণভাগ থেকে আগত সমস্ত উড়ান বন্ধ করে দিয়েছে অন্য সব দেশ। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সীমানা বন্ধ করে দিয়ে সংক্রমণকে খানিক পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সর্বত্র।
তবে এই অমিক্রন যে আমাদের দেশে এখনও এসে পড়েনি তা বলার মতো সময় অবশ্যই আসেনি। যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস, হয়তো জিনোম সিকোয়েন্সিং-এ ধরা পড়েনি এখনো। তাদের খুঁজে পাওয়াটা নাকি শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
প্রশ্ন উঠেছে আমাদের ভ্যাকসিন এবং তথাকথিত হার্ড ইমিউনিটি কতটা লড়াই করতে পারবে এই অমিক্রনের বিরুদ্ধে। এবং আবারও সেই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই। ঝড় চলে যাওয়ার পরেই হয়তো বোঝা যাবে ক্ষয়ক্ষতি।
আপাতত সারা বিশ্বজুড়ে ত্রাস। শেয়ার মার্কেটগুলিতে ধ্বস নেমেছে সবার আগে। তেলের দাম পড়েছে বিশ্ববাজারে। খারাপ সময় আসতে চলেছে হয়তো।
তাই, ভ্যাকসিন এখনো যদি কেউ না নিয়ে থাকেন, নিয়ে নিন চটপট। মনে রাখতে হবে আফ্রিকার গরীব দেশগুলো কিন্তু সেই অর্থে ভ্যাকসিনেসনে অনেকটাই পিছিয়ে। যেখানে আমাদের দেশে অনেক রাজ্যেই কোল্ড স্টোরেজে পড়ে রয়েছে অব্যবহৃত ভ্যাকসিন। পূর্ব ইউরোপেও সেই ‘ভ্যাকসিন হেসিটেন্সি’ এখনো কাজ করে যাচ্ছে। মাস্ক ব্যবহারেও রয়েছে অনীহা। যার ফল হাতে হাতে মিলেছে। এই মুহূর্তে গোটা ইউরোপ জুড়ে কোভিড বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
সেপ্টেম্বরে প্রতি সপ্তাহে ৭ লাখ থেকে রোগীর সংখ্যা এসে পৌঁছেছে ২৬ লাখে। শুরু হয়েছে আবার লকডাউন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভ্যাকসিন বুস্টার দেওয়া শুরু করেছে সেরকম আমাদের দেশে এখনো শুরু হয়নি। তবে আমার মনে হয় সারা পৃথিবীর মানুষকে অন্তত একটা ভ্যাকসিন ডোজ দেওয়া দরকার, বুস্টার শুরু করার আগে।সারা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ ভ্যাকসিন না পেলে এই অতিমারীকে কিন্তু স্তব্ধ করা যাবে না। নতুন নতুন মিউট্যান্ট নিয়ে ফিরে আসবে কোভিড। নতুন নতুন জায়গা থেকে, আমাদের অনবধানতার সুযোগ নিয়ে।
তাই আবার সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। আবার সকলকে ফিরে যেতে হবে কোভিড সুরক্ষায় আর সংযমের জীবনে। মাস্ক, স্যানিটাইজেসন আর ডিসটেন্সিং-এ। নিজেদের সাথে অন্যদের বাঁচাতে। অন্তত, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ঝড় কেটে যায়।
ভালো থাকবেন সকলে। আজ এই পর্যন্ত। অন্য কোন দিন আবার ফিরবো নতুন লেখা নিয়ে।