পুরনো সম্পর্ক আর পুরনো গান, এগুলি বোধহয় সত্যিই কোনদিন পুরনো হওয়ার নয়। নিজের অজান্তেই তারা ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে স্মৃতির পাতা থেকে নেমে আসে জীবনের মাঝে। চমক দিয়ে যায় আটপৌরে অস্তিত্বকে।আর যদি তাদের সহাবস্থান ঘটে যায়, ফেলে আসা যৌবনের কোন এক স্মৃতিবিজড়িত প্রাঙ্গণে, স্থান মাহাত্ম্যেই তখন তা হয়ে ওঠে এক বিরল সুখকর অভিজ্ঞতা।
আর ঠিক তেমনটাই ঘটলো আমার সাথে গত রবিবার সন্ধ্যায়। সাধারণত প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিয়ম করে অনুষ্ঠিত হয়ে চলা আমাদের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের রিইউনিয়ন, এবার কোভিডের চাপে পিছিয়ে এসে পড়েছিল এপ্রিল মাসের কাঠফাটা গরমে। তিনদিনের এই পুনর্মিলন উৎসবের প্রথম দুদিন যাবো যাবো করেও, যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। খবর এসেছে, শহরে থাকা ক্লাসের বন্ধুরা সেখানে গিয়েছে তাদের সময় সুযোগ মতো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠিয়েছে পুরনো কলেজের নতুন হয়ে ওঠার ছবি আর তার সাথে ঘটতে থাকা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানের।
সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতায় থাকলেও কাজের চাপে দীর্ঘদিন যাওয়া হয়নি কলেজের রিইউনিয়নে । ডাক্তারদের পেশাদারী জীবনে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় কেউই চল্লিশ বছরের আগে স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারেন না।এবং তাই স্বাভাবিক কারণেই বন্ধুবান্ধবদের অনুপস্থিতির জন্য একটা বয়স অবধি যোগ দিয়ে ওঠা হয় না এই সব মিলন মেলায়।
কিন্তু বিগত কিছুকাল যাবৎ বদলেছে সময়। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে বয়স আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মনের ভিতর জমে থাকা স্মৃতির মিছিল। অধুনা কোভিড মহামারি খুব দ্রুত বদলে দিয়েছে জীবনের সমীকরণটাকে । আগামীকাল কে থাকবে আর কে থাকবে না সবটাই এখন আরও বেশি করে উপরওয়ালার হাতে। জীবন দর্শন তাই খুবই প্রাঞ্জল বর্তমানে।
সেই কারণে এবার ঠিক করেছিলাম অন্ততপক্ষে একটি সন্ধ্যায় দেখতেই হবে পুরনো কলেজটাকে। ব্যাচমেটদের সাথে দেখা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু যদি কারো সাথে দেখা নাও হয়, মঞ্চের এক কোনে চেয়ার টেনে বসে, নস্টালজিয়ার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকবো খানিকক্ষণ। কোন এক রবিবারের অলস সন্ধ্যায় তাও কি কম পাওয়া? যৌবনের পাঁচটা বছরে, এই যে আনন্দ বিষাদে কাটিয়ে যাওয়া সময়, কেন জানি আজ বড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।
এম বি বি এস পাস করে বেরোনোর পর প্রায় তিরিশটা বসন্ত কেটে গেছে আমাদের। অতীতের দামাল ছেলেমেয়েরা বর্তমানে সবাই মাঝবয়েসী, জীবনের জটিলতা পেরিয়ে, কেউ অভিজ্ঞ স্থিতধী কেউ বা যন্ত্রণাকাতর বিরক্ত। কয়েকজন আবার ইতিমধ্যেই জীবনের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন পরপারে। তাছাড়াও রয়েছে বহমান কোভিড মহামারি, যা ডাক্তারদের জীবনের সমস্যা বাড়িয়ে চলেছে প্রতিটি তরঙ্গে।
এই সব ভাবতেই ভাবতেই এগিয়ে চললাম কলেজের দিকে। পিছনের মাঠে যেখানে কলেজের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে প্রচুর খেলেছি এককালে, সেখানেই এবার গাড়ি পার্কিং-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে দেখলাম। গাড়ি রেখে ধীর লয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলেজে ঢুকেই বুঝতে পারলাম- বাইরে যতই ঘর্মাক্ত গ্রীষ্মের অত্যাচার থাকুক না কেন, গেটের ভিতরে চিরবসন্ত বিরাজমান।
আলো ঝলমলে সন্ধ্যা সময়টা যেন আটকে রেখেছে নব্বইয়ের দশকে।
দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি, কলেজের মধ্যবর্তী দুটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বাঁধা রয়েছে দুটি মঞ্চ। তার একটিতে শুরু হয়ে গিয়েছে রিইউনিয়নের শেষ অনুষ্ঠান। তিনদিন ধরে ঘটে চলা বিবিধ শিক্ষামূলক সভা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটবে আজকের এই জলসার মাধ্যমে। যার মূল আকর্ষণে রয়েছেন বিখ্যাত গায়ক অমিত কুমার।
ঢুকেই অবশ্য খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না ক্লাসমেটদের। বুঝতে পারলাম সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছেন সমকালীন বন্ধুবান্ধবদের। তারপর পারস্পরিক আলিঙ্গন সেরে শুরু হয়ে গেল খুনসুটি আর পুরনো দিনের কথাবার্তা। সবার চোখেমুখেই যেন লেগে আছে সেই হারানো সুর। “বন্ধু,কি খবর বল? কতদিন দেখা হয় নি!”
যদিও আমাদের ক্লাসমেটদের একটা বেশ বড়সড় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, এবং তাতে সবাই সময় সুযোগ মতো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে থাকেন, তাহলেও বিগত দু বছর এই মহামারির তাণ্ডব, দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাকে যে বিলীন করে দিয়েছিল সেটা অনস্বীকার্য। তাই দীর্ঘ না দেখা সময়ের পর, এই আচমকা মিলনে সকলেই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। সবার মুখেই অনেক দিনের জমে থাকা কথার খই ফুটছে।
এদিক ওদিক যে দিকেই তাকাচ্ছি চারিদিকে চেনামুখের ছড়াছড়ি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, বেশিরভাগ মানুষের নাম মনে করতে পারছি না! অবশ্য খানিক বাদেই বুঝলাম শুধু আমি নই, কেউই সেটা পারছে না।
একটি ছেলে এসে দেখলাম আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরছে এক এক করে।
তাকে বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করতে হলো ভাই, তুমি কোন ব্যাচ? আমাদের জুনিয়র না সিনিয়র?
ভিড়ের মধ্যে কেউ বললো জুনিয়র, কেউ বললো সিনিয়র। যাক গে তাতে আলিঙ্গন করার অবশ্য কোন বাধা রইলো না।
এদিকে গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে স্টেজের উপর। একজন অল্পবয়সী তরুণ রাহুল দেব বর্মণের পুরনো সব গান গাইছেন, আর সেই সুরের মাদকতায় মনে হচ্ছে যেন ধীরে ধীরে পিছিয়ে চলেছে টাইম ফ্রেম।
মঞ্চের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিড়ের মাঝে রয়েছেন সব বয়সের মানুষেরা, কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়সী থেকে শুরু করে প্রৌঢ় নারী পুরুষের দল, যাঁরা কোন এক কালে ছাত্র ছিলেন এ কলেজের। সবার চোখই খুঁজে বেড়াচ্ছে পরিচিত সব মুখেদের। তাঁরা ব্যাচমেট হতে পারেন, হতে পারেন অন্য কোন প্রিয় সম্পর্কের মানুষ, সিনিয়র বা জুনিয়র।
অতি পরিচিত সমসাময়িকদের দেখতে পেলেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে সবার মুখ আর বদলে যাচ্ছে শরীরের ভাষা। মনে হচ্ছে “পুরনো সেই দিনের কথা…..” গানটি যেন সেলুলয়েডের পর্দা থেকে নেমে এসেছে আমাদের কলেজের মায়া ভরা এই সন্ধ্যায়।
ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে দেখা হলো সমীর, সুব্রত, জয়দীপ্ত, শুভায়ু আর সুদীপ্তারুণের সঙ্গে। কত দিন পর দেখা হলো আমাদের সেই সময়ের কলেজ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন শিলাজিৎদার সাথে। মনে পড়ে গেল সিউড়িতে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিরুদ্ধে আমাদের সেই ম্যাচের কথা।
-“এখনো ক্রিকেট খেলিস তুই?” দাদার প্রশ্ন।
-“ক দিন আগেও খেলেছি হাসপাতাল টিমে।” বললাম আমি।
দেখা হলো পরমার্থদা, সমুদ্রদাদের সাথে। কুশল বিনিময় আর আলিঙ্গন চললো আবারও।
রিইউনিয়নের এবারে সম্পাদক তিবরদার সাথে মোলাকাত হলো একেবারে মঞ্চের সামনে এসে। কন্যাদায় গ্রস্ত পিতার মতো হাবভাব হয়ে গেছে তিনদিনের এই অনুষ্ঠান সামলাতে গিয়ে।
আমার কোভিড পজিটিভ হয়ে বাড়িতে আইসোলেটেড থাকার সময় রিউনিয়ান ম্যাগাজিনে লেখা দেওয়ার জন্য খুঁচিয়েছে খুব। লেখা দেওয়ার পর এখন আমার পালা ওকে খোঁচানোর। ম্যাগাজিন পাঠিয়ে দেবে কথা দিল সেখানেই। ক্লান্ত মানুষটাকে বিরক্ত করলাম না এরপরে।
আর ডি বর্মণের গান গাওয়া ছেলেটি ততক্ষণে নেমে পড়েছেন স্টেজ থেকে।এবার উঠছেন অমিত কুমার।
আমি আর সুদীপ্তারুণ, দুই গান প্রেমিক এগিয়ে গেলাম মঞ্চের সামনের দিকে একটু ভালো বসার জায়গার আশায়। দুটো ফাঁকা চেয়ার জুটেও গেল।
বসার সাথে সাথেই লক্ষ্য করলাম পাশের চেয়ারেই বসা একটি চেনা মুখের মেয়ে। আমাদের জুনিয়র, এক সময়ে কলেজের সুন্দরীদের মধ্যে একজন। বয়সের সাথে ওজন বেড়েছে বটে কিন্তু ঔজ্জ্বল্য কমেনি এতটুকু।
-“কি রে কেমন আছিস?” আমি কুশল বিনিময় শুরু করলাম।
-“ভালো।” মৃদু হাসি। “দাদা, তোমার নামটা?” সলজ্জে প্রশ্ন করলে সে।
-“পার্থ..” বলতে শুরু করলাম আমি।
-“গুপ্ত। ফোর্টিসে আছ না? অনেক রোগা হয়ে গেছো। আর চেহারাটাও অনেক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে তোমার।” মুখ টিপে হাসি।
বুঝতে পারলাম, না চিনতে পারাটাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। স্মার্টনেসটা তারিফ করার মতোই।
এদিকে স্টেজে আমাদের মাঝবয়সটাকে কৈশোর যৌবনকালে নিয়ে যাচ্ছেন অমিত কুমার। যার শুরু হল বালিকা বধূ সিনেমার জনপ্রিয় সেই গান ‘বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়’ দিয়ে।
তারপর আসতে লাগলো একের পর এক সেই ফেলে আসা সময়ের হিট এবং হট গানের দল। ‘ইয়ে জমি গা রাহি হ্যায়’ থেকে ‘রোজ রোজ আঁখো তলে’।
ক্লাসমেটদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এদিকে একের পর এক অনুরোধ আসতে শুরু করেছে ফেসবুক লাইভের। অপটু হাতে তাই করে যাচ্ছি আমি আর সুদীপ্ত। এই সন্ধ্যার নস্টালজিক পরিবেশ যাতে যতটা সম্ভব পৌঁছে দেওয়া যায় বন্ধুদের কাছে। আমাদের চোখ দিয়ে ওরাও অনুভব করুক এই পুনর্মিলন উৎসবের স্বাদ। টেকনোলজির মাধ্যমে সেই ছবি পৌঁছে যাক ইউরোপ, আমেরিকার চেনা অচেনা শহরে, তাদের সময়মতো। এভাবেই এই বিশেষ দিনে জুড়ে থাক সবাই।
গান শুনতে শুনতেই আমার আনমনা চোখ পড়লো মঞ্চের পার্শ্ববর্তী কলেজ বিল্ডিংগুলির উপর। মনে পড়ছে নীচের লেকচার থিয়েটারগুলোর উপরে তখন ছিল বিভিন্ন প্রি এবং প্যারাক্লিনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট আর ওই এক কোনে ছিল ফিজিওলজির পরীক্ষাগার। আমরা বলতাম ব্যাঙ নাচানো ল্যাব।
এখনো সেরকম আছে কিনা কে জানে!
পিছনের সাদা রঙের বাড়িটা নিশ্চয়ই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের! মনে হচ্ছে যেন এখনো একইরকম আছে। এক্ষুনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবে সাদা অ্যাপ্রন গায়ে কোন এক ডিসেকসন ব্যাচ।
সবচেয়ে মজার ফার্স্ট ইয়ারের কত সময় কেটেছে সেখানে। নতুন সদ্য পরিচিত ছেলেমেয়েরা একসাথে চোখ বড় বড় করে জীবনে প্রথমবার দেখছে ফর্মালিনে চোবানো মানুষের মৃতদেহ। এরপর শুরু হবে ডিসেকসন ক্লাস। মানুষের শরীরের চুলচেরা বিশ্লেষণ। সময় যত এগোবে তীব্র সেই গন্ধের সাথে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠবে সবাই, কেটে যাবে ভীতি। আড্ডা বসবে শ্বেতপাথরের টেবিলের চারপাশে।
কঙ্কাল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মানুষের খুলি কখন যে হোস্টেলে ছেলেদের পড়ার টেবিলে সিগারেটের আ্যাস্ট্রে হয়ে উঠবে তার খেয়াল থাকবে না কারো। ঘরের দেওয়ালে ঝুলন্ত কঙ্কালের নাম কেউ দেবে ‘নিবারণ’! মড়া কাটতে কাটতেই কেউ পড়বে প্রেমে।
আচমকাই মনে পড়লো আমাদের অ্যানাটমির মাস্টারমশাই ডাক্তার নায়েকের কথা। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার পর সেই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের ফ্রিজেই রাখা হয়েছিল উনার মরদেহ, যার উপরতলায় স্যার ডিসেকসন ক্লাস নিতেন। পরের দিন সৎকার করতে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলাম স্যারকে। কষ্টে খুব কেঁদে ছিলাম সারারাত।
বিল্ডিংটার তলায় ছিল ডোমেদের থাকার জায়গা। তাদের মধ্যে ‘ঈশ্বর’ নামে এক ডোম আমাদের ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারিং করতো। ডোমেরা এখনো সেখানে থাকে কি না কে জানে?
লক্ষ্য করলাম ক্যানটিনের পাশের লম্বা শিমূল গাছটার পাতার ফাঁকে, সব আলোকে ম্লান করে দিয়ে, রাতের আকাশে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।
এই সেই কলেজ ক্যানটিন, যার গল্প শুরু হলে আজ আর শেষ হবে না।
ওদিকে মঞ্চে উনসত্তর বছর বয়সী তরুণ অমিত গাইছেন, নব্বই দশকের সুপারহিট ‘তেজাব’ সিনেমার বিখ্যাত সেই গান। ” কহেদো কে তুম হো মেরি ওয়ারনা……..,জিনা নেহি, মুঝে হ্যায় মরনা…..”
পিছনের স্ক্রিনে তখন তরুণ অনিল কাপুর আর মাধুরী দীক্ষিতের অসাধারণ কেমিস্ট্রির আগুন। গান আর চলতে থাকা ভিডিও যেন এক মুহূর্তে পৌঁছে দিল সেই সময়ে।
আমাদের থার্ড ইয়ার শুরু হয়েছে। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে রোম্যান্টিক সম্পর্ক ভাঙা গড়ার খেলা চলছে তখন। চূড়ান্ত প্রেমময় সে এক পরিবেশ। সেইসব কলেজ প্রেমের সফল এবং অসফল কাহিনী গুলি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক এক করে। তাদের অনেকেই এখনো আছে বন্ধনে, কেউ বা ভেসে গিয়েছে অনেক দূরে। সেই সব সম্পর্কের শুরু তো এখানেই।
কিন্তু বাস্তবে যে ফিরে আসতেই হবে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। অনুষ্ঠানও প্রায় অন্তিম লগ্নে। ফিরতে হবে বাড়ি, কাল সোমবারে কাজের চাপ রয়েছে সকাল থেকেই। আবার দেখা হবে কথা দিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে তাই বিদায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে এগিয়ে চলেছি।
কে যেন খবর দিলে গেটের পাশে আগের অডিটোরিয়ামটা এখন আর নেই, নেই উঠে যাওয়া ঘোরানো সিঁড়িটাও।
মন খারাপ হলো খুব। ওই স্টেজে পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচটা নাটকের শো করেছিলাম আমরা। কত দিন আর সন্ধ্যা যে কেটে গেছে সেখানে নাটকের মহলায়। তুমুল তর্ক হয়েছে চায়ের পেয়ালায়। চোখ বন্ধ করলেই এখনো সেই আলোকিত মঞ্চ দেখতে পাচ্ছি, দেখছি অন্ধকারে চেয়ারে বসে থাকা কালো মাথার সারি। কানে আসছে দর্শকদের সরস মন্তব্য আর হাততালির আওয়াজ। গ্রিন রুমে বসে মেক আপের মধ্যেই ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে নাটকের পার্ট। প্রপস, ঝোলানো মাইকের ফাইনাল পজিশন ঠিক করা হচ্ছে যত্ন করে। ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য রেডি করা হচ্ছে টেপ রেকর্ডারকে।
কম্পিটিশনের দিন থাকতো বাড়তি এক চাপা উত্তেজনা। নির্দেশনার দায়িত্ব থাকতো বলে মাথা ধরে যেত ঠিক শোয়ের আগে।
গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছি। পাশের পুরনো ছোট শিব মন্দিরটাকে খুঁজে পেলাম না কোথাও।
পিছনে মাইকে অমিত কুমারের গলা ভেসে আসছে। সম্ভবত শেষ গান গাইছেন অনুষ্ঠানের। ‘পথের খোঁজে, পথের মাঝেই……, হারিয়ে গেছি আমি,…..হো.., হারিয়ে গেছি আমি…..!’ চিনতে পারলাম। ‘আপন আমার আপন’ সিনেমার সুপারহিট গান।
পিছন ফিরে তাকালাম একবার। আলো ঝলমলে কলেজ ক্যাম্পাস। আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে। নাহ্, আবার ফিরে আসতে হবে একদিন। হ্যাঁ, খুব শিগগিরই।