ফেসবুকের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বন্ধুবর ডাঃ হিমাদ্রি শেখর মজুমদারের একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল। একটি দৈনিক খবরের কাগজের স্ক্রীনশট।
যেখানে লিখছে এই করোনাযুদ্ধের মোকাবিলায় একদা অগ্রগামী রাজ্য কেরালা এই মুহূর্তে কতটা খারাপ জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে তার কারণটাও।
আজকাল টিভি বড় একটা দেখা হয়ে ওঠে না। দৈনন্দিন আবোল তাবোল খবরে বোঝাই করা টিভি চ্যানেল একইসঙ্গে শ্রুতি এবং দৃষ্টিকটু।
মহামারীর দাপটে যখন সাধারণ মানুষের জীবিকা এবং জীবন দুটিই বিপর্যস্ত হয়ে চলেছে সেখানে প্রয়োজনীয় খবরের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে বাজারি বলিউড এবং আই পি এল এর মতো ক্রিকেট জুয়ার যাবতীয় খবর। চিকিৎসক, নার্স তথা সমগ্র স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন অকুতোভয়ে এই মহামারীর বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন বিপন্ন রেখে ও কাজ করে চলেছেন, তখন তাদের খবরা-খবর পাওয়া যাচ্ছে সংবাদপত্রের কোন এক ভিতরের পাতার কোনে। এই মহামারীর মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও সমান্তরাল ভাবে চলেছে চিকিৎসক দের উপর শারীরিক অত্যাচার। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের চোখের সামনেই।
আর প্রায় রোজই শোনা যাচ্ছে চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের শহীদ হওয়ার খবর। কিন্তু সরকার বা সংবাদমাধ্যম কারো কাছেই নাকি তার সেরকম কোনও তথ্য নেই।
তাই বহুদিনই আমার বাড়িতে কোন খবরের কাগজ ঢোকে না। বন্ধ করে দিয়েছি ডি টি এইচ পরিষেবাও। যতটুকু খবরের আমার প্রয়োজন তা আমি ইন্টারনেট থেকেই পেয়ে যাই। রাজনৈতিক চাপান উতোরে মেতে থাকা টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা আপোষ করা প্রিন্ট মিডিয়া কোনটাই আমাকে আর আকর্ষণ করে না।
মূল খবরটিতে ফিরে আসি এবার। করোনা মোকাবিলায় কেরালার ইনিংসের শুরুটা ছিল জব্বর। মনে রাখতে হবে মহারাষ্ট্রের সাথে কেরালাতেই সর্বপ্রথম ছড়াতে শুরু করেছিল এই মহামারী। মহারাষ্ট্রে রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলেও অত্যন্ত আক্রমণাত্মক উপায়ে কেসের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছিল কেরালা। ‘টেস্ট এন্ড আইসোলেট’ এই অ্যাগ্রেসিভ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে করোনা অনেক চেষ্টা করেও বাড়তে পারছিল না সেখানে, অন্তত এই আগষ্ট মাস পর্যন্ত। কিন্তু বাইশে আগষ্ট থেকে দোসরা সেপ্টেম্বর অবধি চলা ‘ওনাম’ উৎসবের পর কেসের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে সেখানে। এতটাই যে দেশের কোভিড
চার্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কেরালা দ্রুতগতিতে উঠে এসেছে অ্যাক্টিভ রোগীদের তালিকায় চার নম্বরে।
সামাজিক মেলামেশা, একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া, আচমকা বন্ধন মুক্তির আবেগে ভেসে গিয়ে
সেখানে মহামারী আপাতত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সেকেন্ড ওয়েভ শুরু করে দিয়েছে। তবে কেরালার স্বাস্থ্য পরিষেবা দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই মজবুত। তাই ওদের ঘুরে দাঁড়াতে হয়তো সময় লাগবে না।
গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে সুস্থতার সংখ্যা নতুন কেসের তুলনায় বাড়ছে। তাই কমছে অ্যাকটিভ রোগীর সংখ্যাও। দেশের কোভিড চার্টেও ওঠানামা করছে রাজ্য গুলির অবস্থান। যে কারণেই হোক,কোন অঞ্চলে সামাজিক মেলামেশার বাড়াবাড়ি হলেই সেখানে তাল মিলিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। অনেকটা সাপ লুডো খেলার মতো। লাগামছাড়া মেশামেশি মানুষগুলিকে নিয়ে গিয়ে ফেলছে একেবারে ভাইরাসের মুখে।
কিছু কিছু রাজ্য প্রথম ওয়েভ শেষ করে ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় ওয়েভে প্রবেশ করেছে। কেউ দাঁড়িয়ে প্রথম ওয়েভেই।
স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন দুর্গাপুজো নিয়ে চূড়ান্ত আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানী তথা চিকিৎসকদের দল। মণ্ডপে মণ্ডপে উপচে পড়া ভিড়ে ভাইরাসও যে উৎসাহিত হয়ে উপচে পড়বে সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। দুর্গাপুজোর ঠিক ১৪ দিন পরেই হিসেব মতো কেসের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল, যদি না সাধারণ মানুষ নিজেদের সংযত রাখতে পারেন। ঠিক ওনামের পর যেমনটি ঘটেছে কেরালায়। তাই নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকেই এখন সবার নজর।
চিকিৎসক হিসেবে আমরা শঙ্কিত এই কারণেই, যে কেসের সংখ্যা আচমকা যদি বাড়তে শুরু করে, আমাদের পরিমিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা তার ধকল বহন করতে পারবে না। আর সংক্রমণ বাড়লে আমাদের মতো চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীর শহীদ হওয়ার আশঙ্কা আরো বাড়বে। ভারতে যেখানে করোনায় মৃত্যু সাধারণ ভাবে এই মুহূর্তে দুই শতাংশের নীচে চলে গিয়েছে সেখানে চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার বেশ কয়েকগুণ বেশী। তাই স্বাভাবিক কারণেই চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবার শঙ্কিত হয়ে রয়েছেন।
তাই আমাদের সবাইকেই ভাবতে হবে কেরালার ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। একটা দুর্গাপুজো চলে গেলেও, বেঁচে থাকলে আপনি আরো অনেকগুলি দুর্গাপুজো দেখতে পাবেন। একথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে সকলকে।
রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিংয়ের কথা মনে করুন। অফ স্টাম্পের বাইরের বলকে ইনিংসের শুরুতে ব্যাট তুলে ছেড়ে দিতেন উনি। যাতে বাকি ইনিংসের ভিতটা মজবুত করে দেওয়া যায় আর ক্লান্ত হয়ে যায় বোলার।
এবারের দুর্গাপুজোটাকে এভাবেই ছেড়ে দিন। মনে করুন সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমীতে ওই উপচেপড়া ভিড়ে মিশে আছে করোনার বিষাক্ত স্যুইং। ছুঁলেই মহামারীর নাম্বার বাড়তে থাকবে।
সোজা ব্যাটে খেলে যান মাস্ক, স্যানিটাইজার আর ডিস্ট্যান্সিং দিয়ে। ক্লান্ত করে দিন ভাইরাসকে।
ভ্যাক্সিন আসুক বা না আসুক আটকে দিন করোনার পরবর্তী ওয়েভগুলিকে। ধীরে ধীরেই হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হয়ে যাবে। যত সময় যাবে তত দুর্বল হবে ভাইরাস। তখন আমরা স্টেপ আউট করবো স্লগ ওভারে,’বাপি,বাড়ি যা…..’।
ক্যামোফ্লাজ করে যদি বেঁচে থাকতে পারে গোটা প্রাণীজগত, আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মাস্ক পড়ে লড়াই চালাতে পারবো না আরো কিছুদিন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে?
তাই আগামী দুর্গাপুজো আমাদের অ্যাসিড টেস্ট।
এই ওয়েভ যদি আমরা আটকে দিতে পারি রাহুল দ্রাবিড়ের চওড়া ব্যাট দিয়ে, তাহলে পরের দিকে স্টেপ আউটের জন্য প্যাভিলিয়নে অপেক্ষা করে বসে আছে আমাদের সৌরভ, সেহবাগরা।
চালিয়ে খেলার অনেক সময় পাওয়া যাবে তখন।
তাই ভালো থাকুন। বাইরে বেরোলে মাস্ক খুলবেন না একদম। ওটাই একমাত্র আপনাকে আর আমাকে করোনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।
আবার দেখা হবে পরের দিনলিপিতে।
সুস্থ থাকুন সক্কলে।