আমার কলেজ এই মেডিক্যাল কলেজ। অ্যাডমিশন নিয়েছিলাম প্রায় ৫০ বছর আগে। আমার কলেজের সন্তানসম ছাত্ররা একটি সামান্য দাবী তুলেছে – গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে ছাত্র ইউনিয়নের অধিকার সাংবিধানিকভাবে এখনও স্বীকৃত সেখানে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতে হবে। এক এবং একমাত্র দাবী। কর্তৃপক্ষ অনড়, কারণ “উপর মহল” থেকে কোন সবুজ সংকেত নেই। ১৯৭৭ সালে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের আগেও এরকম পরিস্থিতি ছিল, যদিও ইতিহাস কখনও হুবহু একরকম হয়না। কিন্তু সেসময়ে সামাজিভাবে একটি সক্রিয়, জীবন্ত এবং সংবেদী নাগরিক সমাজ ছিল। ছিল পার্টি সংগঠনের বাইরে একটি তৃতীয় পরিসর। এজন্য ১৯৮০-র দশকে ওরকম কলকাতা কাঁপানো জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন হতে পেরেছিল। ১৯৯০-এর দশকের গোড়াতেও হয়েছিল আরেকবার জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন। সেসময় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন কিছু এলাকায় আমরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমাদের কথা, আমাদের মূল দাবী জানিয়েছিলাম। আমরা অনুরোধ করেছিলাম, অন্তত ১ ঘন্টার জন্য সন্ধে রাতে এলাকাকে নিষ্প্রদীপ রাখার জন্য। সেসমস্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন। আমরা শিহরিত বোধ করেছিলাম। তারপরে সময়ের নিয়মে আমরা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে গেছি। মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। রয়েছে ছাত্ররা, জুনিয়র ডাক্তার আর শিক্ষক অধ্যাপকেরা। রোগীদের চিকিৎসা পাবার ব্যাপারে কি খুব পরিবর্তন হয়েছে? আমাদের নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
কিন্তু এসমস্ত পুঞ্জীভূত ঘটনা সত্ত্বেও আজকের ছাত্রদের দাবী লঘু হয়ে যায়না। একটি প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য বর্তমান অনশন-আন্দোলন আলাদা গুরুত্ব দাবী করে। যখন অজস্র দুর্নীতি নিয়ে ক্রমাগত কোর্টের হস্তক্ষেপ হচ্ছে, টিভির পর্দায় রসিয়ে আলোচনা হচ্ছে তখন শহরের এই নাগরিকদের কাছেই অনুরোধ করব – এই বাচ্চা ছেলেগুলোর চোয়াল কষে লড়াই, অপ্রাপ্তি, কখনও হয়তো স্বপ্নভঙ্গের হতাশাও একটিবারের জন্য কান পেতে শুনুন, চোখ খুলে দেখুন। কোথায় রয়েছে আমাদের নাগরিক পরিসর? কোথায় বহুচর্চিত তৃতীয় পরিসর? শিক্ষকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য প্রার্থীরাও এক অসম্ভব সময় খোলা আকাশের নীচে আন্দোলন করে চলেছে। আমরা দাঁড়িয়েছি পাশে? এ পরিসর সমাজ থেকে হারিয়ে গেলে রাষ্ট্র তার সর্বব্যাপী আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়। তখন আমরা কোথায় যাব? সত্যিই কি যাবার কোন জায়গা খুঁজে পেয়েছি আমরা? এক অতল গহ্বরের দিকে যাত্রা করছিনা তো আমরা? সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমাদের স্বাভাবিক সত্তার ইচ্ছামৃত্যু ডেকে আনছিনা তো আমরা? তারপরে? ইতিহাসের কাহিনী কিভাবে লেখা হবে? ভেবে দেখেছি?
২০০ ঘন্টা হয়ে গেল অনশনের। দুজন ছাত্র রীতিমত অসুস্থ হয়ে কেউ আইসিইউ-তে, কেউ ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হয়েছে। বোলান গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা জয় গোস্বামীকে আমার কুর্নিশ। এঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছাত্রদের দাবীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এঁরা ব্যতিক্রম রয়ে গেলেন। অন্যসব নামী মানুষ যাঁরা নন্দীগ্রাম থেকে বিভিন্ন সময়ে কলকাতার রাজপথ আন্দোলিত করেছেন তাঁরা কেন হারিয়ে যাবেন? এর উত্তর কি খুব স্পষ্ট? গণতান্ত্রিক পরিসর চাওয়া, গণতন্ত্রের দাবী তোলা কি অন্যায্য? অসঙ্গত? অসাংবিধানিক?
এ প্রশ্নগুলো আজ আমাদের ভাবা এবং তোলা ভীষণ জরুরী। আগামীকাল বেলা ৩টের সময় মেডিক্যাল কলেজে কনভেনশন ডেকেছে প্রতিবাদী ছাত্ররা। আপনাদের আসা বড়ো প্রয়োজন। প্রয়োজনে রাজপথই আবার মানুষের আশ্রয় দাঁড়ায় প্রতিবাদের জন্য। পথেই হয় এ পথ চেনা!
আসুন আপনারা। গণতন্ত্র হারিয়ে গেলে জীবনের অনেক কিছুই ভবিষ্যতে একটা একটা করে হারিয়ে ফেলবেন। ভেবে দেখবেন নিশ্চয়ই।
ছাত্রদের এই নূন্যতম দাবি মেনে নিতে কতৃপক্ষের আপত্তি কিসের বুঝিনা। শাসকের এরকম একগুঁয়ে মনোভাব গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করে যা ভাবি ডাক্তারদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে উদাসীনতার জন্ম দিতে পারে।
আসলে বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কলেজের নির্বাচন বন্ধ আছে, বিভিন্ন পুরসভা, সমবায়,এর সাথেই নতুন করে মেডিকেল কলেজ। নাগরিক সমাজ সচেতন ভাবেই ভীষন মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবেই চলছে। সরকারি শিক্ষা ব্যাবস্থা টাকেই বানিজ্য করে দিতেই কেন্দ্রীয় প্রকল্প। সেই কারনেই সহযোগিতা মুলক বৈরিতার ককটেল চলছে।
আন্দোলন শেষ। রাষ্ট্রশক্তি সংগঠিত। নাগরিক সমাজ উৎসাহী নন। সুকান্তও আজকে জন্মালে আঠেরো বছর নিয়ে কবিতা লিখতেন কিনা সন্দেহ তৈরী হয়। শুধু কিছু ছেলে মেয়ে যাদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও আছে, আজও স্বপ্ন দেখে। বেঁচে থাকার আনন্দ ঐখানেই।
আর ভরসা আপনাদের মত মানুষদের লেখা, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।