সময় ফুটফাটা করে দিয়েছে ফ্রাউ জেটকিনের শরীর কিন্তু এখনো একটা বড় কাজ বাকি আছে। ব্যথা বেদনা নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার থেকে অনেক দরকারি কাজ। ৭৫ বছরের রোগ জীর্ণ শরীরটা নড়েচড়ে বসলো মস্কোর রোগ শয্যায়। জার্মান রাইখস্ট্যাগ (সংসদ)-এর একজন আইনি পথে নির্বাচিত সভ্য হিসেবে ৩০শে আগস্ট ১৯৩২ এ বার্লিন পৌঁছতে হবে জেটকিনকে।
এমবুলেন্সে করে স্টেশন। সেখান থেকে ১০০০ কিমি দূরের যাত্রা শুরু হল। জোশওয়ালা সব তরুণ কম্যুনিস্ট গার্ডরা টহল দিল ট্রেন পাছে জার্মান ফ্যাসিস্টরা বুড়ি ঠাকুমা জেটকিনকে কিছু না করে বসে।
ট্রেনের জানালার বাইরে ছোট ছোট খোপকাটা রংবেরঙের গ্রামগুলোর মতোই রঙিন জেটকিন ঠাকুমার অতীত ইতিহাস। ১৮৮০-এর দশকের শেষ আর ১৮৯০-এর গোড়া থেকেই উনি ইউরোপীয় সোশ্যালিস্ট আর কম্যুনিস্ট সংগঠনের সদস্য, ঝোঁকটা ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মার্ক্সবাদী সংস্কারের মাধ্যমে নারীমুক্তির পথ খোঁজা।
রাইখস্ট্যাগের বাইরে বিক্ষোভরত হইচই করনেওয়ালা সব পার্টিকর্মীকে হিটলার তাঁর টুথব্রাশ মার্কা গোঁফের ফাঁকে চেঁচিয়ে সাবধান করেছিলেন যে ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টির কোনো সাংসদ যেন ভুলেও জেটকিন ঠাকুমার মাথাভরা পাকচুলের একগাছিও স্পর্শ না করে। এডলফ হিটলারের ফরমান।
অগাস্ট ৩০, বেলা তিনটে, নাৎসি সমর্থকদের চিৎকার টিটকারী এর মধ্যেই স্ট্রেচার থেকে জেটকিন ঠাকুমাকে টেনে তুললো তাঁর কমরেডরা। মুস্কো জওয়ান এক কমরেডকে পাশে নিয়ে লাঠি ঠুক ঠুক করে রাইখস্ট্যাগের সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন জেটকিন ঠাকুমা।
হাততালি আর জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়লো কম্যুনিস্ট সাংসদরা আর বাকিরা চুপ, গোমড়া মুখে কেউ না দেখার ভান করে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছেন।
ঠিক ওই মুহূর্তের জন্য জেটকিন ঠাকুমার হাতের মুঠোয় ছিল প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। বিশাল ক্ষমতা। উনি ঘামে ভেজা কপালটা একবার মুছে নিলেন। জলের গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক জল। থরথরে হাতে স্পিকারের ঘন্টাটা তুলে বাজিয়ে দিলেন।
কাঁপা কাঁপা গলায় জেটকিন ঠাকুমার সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শুরু হল, “সদনের নিয়মাবলী অনুযায়ী একটি নতুন অধিবেশনের সূচনা করবেন সংসদে উপস্হিত সবচেয়ে প্রাচীন সদস্য। আমি জন্মেছিলাম ১৮৫৭ সালের ৫ই জুলাই। আমার চেয়ে প্রাচীন কেউ, কোনো সদস্য আছেন না কি এই সদনে?”
কিছু গলা খাকরানী আর পা ঘষটানোর আওয়াজ ছাড়া গোটা সংসদ সদনে তখন অদ্ভুত নীরবতা। গায়ের গরম চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে শুরু হল জেটকিন ঠাকুমার সেই আগুন ঝরানো বক্তৃতা। মাঝে মাঝে তাঁর গলার আওয়াজ বসে যাওয়াতে তাঁর কমরেডদের মিনতি, “এবার বন্ধ করুন”। সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ঠাকুমার আওয়াজ, ” নেইন, নেইন, আই উইল স্পিক। আমি বলবো।”
রাইখস্ট্যাগে এটাই জেটকিন ঠাকুমার শেষ ভাষণ। এরপরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। কম্যুনিস্টদের ধরে ধরে খুন করা হয়। কিছু ভাগ্যবান দেশান্তরী হয়ে প্রাণে বাঁচেন।
যে কজন মুষ্টিমেয় সোশালিস্ট/কম্যুনিস্ট নেত্রীর জন্য আজকাল সারা পৃথিবী জুড়ে ৮ই মার্চ “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” পালন স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁদের মধ্যে ওই বুড়ি ঠাকুমা জেটকিন অন্যতম। লেনিন যাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, “The German Communists have only one good man and that is a woman: Zetkin.”
আর লেনিনকে নিয়ে তাঁর লেখা বই ছিল ভগৎ সিং-এর সেই জেল কুঠুরীতে পড়া শেষ বই।
৫ই জুলাই। ক্লারা জেটকিনের জন্মদিন। আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন ও সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত সেই মানুষটির জন্মদিনে তাঁর মতো করে শপথ নিতে হবে। আজকের দিনে কিছুতেই ভুলে যাওয়া যাবে না সেই ৭৫ বছরের বুড়ি ঠাকুমার কম্পিত কন্ঠস্বর। “আমাকে বলতে হবে, আমি বলবই”। চেনা ও অচেনা ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
কমরেড ক্লারা জেটকিন অমর রহে।