খবরে মাঝে মাঝেই শুনতে পাই হাসপাতাল থেকে দামি ওষুধ আর চিকিৎসার সরঞ্জাম পাচার হয়ে যেতে। এই চক্রের সাথে কারা ওঠাবসা করে তা না জানলেও ওয়ার্ড আর ওটি থেকে তিনখানা তুচ্ছ জিনিস গায়েব হয়ে যাওয়ার পেছনে যে জুনিয়র ডাক্তারদের একটা অংশ জড়িত থাকে তা আমি হলফ করে বলতে পারি। এই তিনখানা জিনিস হলো: ১) সিস্টার দিদিদের কলম (দাম পাঁচ টাকা)
২) ওটির চটি (পদ্মপুকুরের চামড়াহাটে দরদাম করে কিনতে পারলে চল্লিশ টাকা)
৩) লিউকোপ্লাস্ট/মাইক্রোপোর (পাইকারি মূল্য পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা)
তুচ্ছ এবং সস্তা বস্তুর উপর ডাক্তারদের এই অদম্য লোভকে ক্লেপ্টোম্যানিয়া বলা যায় কিনা তা একমাত্র ফরেন্সিক আর সাইকিয়াট্রির বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। আমি শুধু এই বস্তুগুলি উধাও হওয়া থেকে রক্ষা করতে সিস্টার দিদিমণিরা মাথা খাটিয়ে কী কী উপায় বার করতেন সেসব নিয়েই আলোচনা করব।
১) কলম: সিস্টারদের কাছ থেকে কলম নিয়ে রোগীর ফাইলে নোট দেওয়ার পর বেমালুম সেটা পকেটস্থ করাটা অনেক ইন্টার্ন এবং পিজিটি দৈনন্দিন অভ্যাস বানিয়ে ফেলে। সেই ইন্টার্ন বা পিজিটি যদি সিস্টার দিদির ক্রাশ হয় তো আলাদা কথা, নইলে দিনের পর দিন এই অন্যায় তিনি মেনে নেবেন কেন? তাই কিছুদিন পরেই সেই দিদিদের কলমের ব্র্যাণ্ড হয়ে যেত ‘অগ্নি জেল’। কিন্তু ব্র্যাণ্ড ডিমোশনও যখন সমস্যার সমাধান করতে পারত না তখন সেই কলম পান-বিড়ি দোকানের লাইটারের মতো রোল-ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। তাতেও শেষরক্ষা হতো না। আমি এমনও দেখেছি রোল-ব্যাণ্ডেজের সাথে শুধু ঢাকনাটা ঝুলছে কিন্তু কলমটাই বেপাত্তা!
২) ওটির চটি: এটাকে ঠিক চুরি বলা যাবে না। এই বস্তুটি ভুলবশতঃ পায়ে পায়ে হস্টেলে চালান হয়ে যেত। কেই বা ইচ্ছে করে দামি জুতো ফেলে সস্তার চটি পরে ফিরতে চাইবে? তবুও ওটির চটি হারিয়ে যেত এবং পরবর্তীতে তা আটকাতে স্পেশালভাবে চটির অর্ডার দেওয়া হতো। দুই পায়ের জন্য দুই রঙের চটি। ডানপায়ের জন্য সবুজ আর বামপায়ের জন্য লাল। এতে কিছুটা হলেও চটি হারানো কমেছিল।
আরেকভাবে হাসপাতালের চটির সংখ্যা কমে যেত। কারও নতুন জুতো খোয়া গেলে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের চটি পরে চলে যেত কিন্তু সেগুলো আর ফিরে আসত না। আমি এমন একটা ঘটনা জানি যেখানে অর্থোপেডিক্সের একজন নামকরা অধ্যাপক বাধ্য হয়ে হাসপাতালের চটি পরে বাড়ি ফিরেছিলেন। ন্যাশনালের রামমোহন ব্লকে পলিট্রমার পেশেন্টের রেফার দেখতে এসে বাইরে জুতো খুলে তিনি আইটিইউ-তে ঢুকেছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবিষ্কার করেন তাঁর জুতোজোড়া উধাও। এরপর তিনি প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন। তাঁর জুতো কেন ঠিকঠাক খেয়াল রাখা হয়নি সেই অপরাধে ইন্টার্নদের ভর্ৎসনা করতে থাকেন। একজন ইন্টার্ন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে অধ্যাপক বলেছিলেন, “Shut up! My shoes cost more than your monthly stipend.” অবশেষে সিস্টার দিদিরা তাঁকে শান্ত করার পর ভেতর থেকে একজোড়া নতুন স্লিপার দিয়েছিলেন যাতে একটু ভদ্রভাবে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন। আমি বলতে পারব না সেই অধ্যাপক কোন্ ব্র্যাণ্ডের জুতো পরতেন, তবে এটুকু বলতে পারি সেদিন হাওয়াই চটি শুধুমাত্র তাঁর পায়ের আব্রু রক্ষা করেনি, পরবর্তী জীবনে উত্তরোত্তর পদোন্নতিতেও প্রভূত সাহায্য করেছিল। হাওয়াই চটির কৃপাতেই আজ তিনি আরজিকর মেডিকেল কলেজের বিতর্কিত অধ্যক্ষ, যাঁকে সম্প্রতি বদলি করেও কয়েকদিন বাদে ফিরিয়ে আনা হয়। পরিচয় গোপন রাখতেই এর বেশি আর কিছু লেখা সম্ভব হলো না।
৩) লিউকোপ্লাস্ট/মাইক্রোপোর: প্রথমটা কাপড়ের তৈরি এবং পরেরটা আণুবীক্ষণিক ছিদ্রযুক্ত কাগজের তৈরি। উভয়েরই একদিকে আঠা দেওয়া থাকে এবং রোল অবস্থায় পাওয়া যায়। দুটোর ব্যবহারও একই উদ্দেশ্যে: সার্জিক্যাল ড্রেসিং, স্যালাইনের চ্যানেল কিম্বা রাইল্স টিউব ফিক্সেশন। তবে তোলার সময় লোমসহ ছালচামড়া উঠে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয় বলে লিউকোপ্লাস্ট বিগত কয়েক বছরে জনপ্রিয়তা হারায়। বিকল্প হিসেবে বাজারে আসে মাইক্রোপোর। আমরা দুটোই সমানভাবে ব্যবহার করেছি। এখন কথা হলো, চ্যানেল করার পর এই লিউকোপ্লাস্টের রোলটা কীভাবে ইন্টার্নদের প্যান্টের পকেটে চলে যেত সেটা আজও আমার কাছে রহস্যময়। সেই যুগে কিছু ইন্টার্নকে সিস্টার দিদিরা ‘লিউকোচোর’-এর তকমাও দিয়েছিলেন। পরিত্রাণ পেতে এরও একটা দাওয়াই বের করেছিলেন দিদিরা। সকালে ওয়ার্ডে এসেই জুনিয়র দিদিরা সরু সরু করে তিন-চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের লিউকোপ্লাস্ট কেটে দেওয়ালে সাঁটিয়ে রাখতেন। কোনো ইন্টার্ন চ্যানেল করার জন্য লিউকো চাইলে তার হাতে গোটা রোল না দিয়ে দেওয়ালের দিকটা দেখিয়ে দিতেন। একবার আমার সামনে এক বন্ধু মাইক্রোপোরের রোল পকেটস্থ করতেই ওয়ার্ডের মাঝেই রূপমদার ‘বাইসাইকেল চোর’ গানের ভঙ্গিমায় গেয়ে উঠেছিলাম, “মাই মাই মাই মাই মাই মাই ক্রোপোর চো ও ও ও ওর।” এটা শুনে এক দিদি বলেছিলেন, আপনি খুব অসভ্য।”
আজ সিস্টার দিদিদের নিয়ে এরকম অনেক কথাই মনে পড়ছে। জানি না কেন। হতে পারে দীপাবলির লাইটিং-এর জন্য পুরনো ‘টুনি’ গুলো বার করে একটু ঝাড়পোছ করছিলাম বলে।