খুব অল্পদিনের মধ্যে পরপর কিছু জুনিয়র ডাক্তারের আত্মহত্যা পর সামগ্রিকভাবে ডাক্তার সমাজের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কি জন্য দানা বাঁধছে এইরকম অবসাদ? জুনিয়র ডাক্তারের অবসাদের অনেক অনেক কারণ আছে যা ব্যক্তি বিশেষে আলাদা এবং প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ। ক্রমাগত বেড়ে চলা ইঁদুর দৌড়, রোগী র চাপ, সমাজের চাপ, ভোগবাদী সমাজের যাবতীয় ক্লেদ ভার সব কিছু ই একজন নব্য ডাক্তারের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ।
কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে সার্বিকভাবে যে পেশাগত হতাশা কাজ করছে, কর্মোদ্যোগের অভাব দেখা যাচ্ছে, বেড সাইড ক্লিনিকে অমনোযোগ দেখা যাচ্ছে তার পেছনে আমি একজন মেডিক্যাল শিক্ষক হিসেবে এই মেডিক্যাল কোচিং সেন্টার গুলোর প্রত্যক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি। একটা ছেলে বা মেয়ে জন্ম থেকে কোচিং সেন্টারের জন্য বলি প্রদত্ত হয়ে উঠছে। জয়েন্ট ঢোকার আগে কোচিং। ঢুকে পাঁচ বছর পড়া। তারপর আবার কোচিং।
কি এই পিজি এন্ট্রান্স র জন্য মেডিক্যাল কোচিং সেন্টার? এই ধারণা দিল্লি থেকে শুরু। শুরু র দিকে ব্যাপারটা খারাপ যে ছিলো তা নয়। কোন ভালো কৃতী ছাত্র তার পরীক্ষা প্রস্তুতির নোটগুলো জুনিয়র দের পড়াতে শুরু করলো তারপর আসতে আসতে সেখান থেকে কোচিং সেন্টার শুরু হলো। একটা সময় মুদিত খান্না বা অমিত আশীষ র বইগুলি ছিলো অবশ্য পাঠ্য এবং কোন ছেলেমেয়ে চাইলে টেক্সট বই এবং এই বইগুলো র সাহায্যে নিজের প্রস্তুতি করে নিতে পারতো।
যদিও এই পিজি এন্ট্রান্স একটা ব্যবসা ছিলো কিন্তু সেটা বিগত কিছু বছরে একটা অসুস্থ মাত্রাতে পৌঁছে গেছে। এই মূহুর্তে প্রতিটি কোচিং সেন্টার চাইছে একে অপরকে টেক্কা দিয়ে নিজের ব্যবসা ধরে রাখতে। সেই ব্যবসার ক্লায়েন্ট হলো মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রী। অতএব একটাই উপায় মেডিক্যাল শিক্ষা জীবনের শুরুর দিন থেকে বিজ্ঞাপনী এবং অন্যান্য মগজধোলাই।
একটা ছেলে এমবিবিএস এ আসার পর পর ই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করে। সেখানে প্রতিযোগীতা থাকে। কিন্তু সেই প্রতিযোগীতা সুস্থ প্রতিযোগীতা। যে ছেলে বা মেয়ে ভালো পড়ছে বা ক্লাস করছে ভালো নাম্বার পাচ্ছে তারা একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকছে। কিন্তু যে ছেলে টা রাত ওবধি একটু পড়ার বহির্ভূত বিষয় নিয়ে পড়ছে, মোটামুটি একটা নাম্বার পেয়ে পাশ করছে সেও কিন্তু পুরো সিস্টেমে মধ্যেই থাকছে। তার জন্য সে কখনো নিজেকে ছোট বোধ করছে না।
সমস্যা হলো এই কোচিং সেন্টার গুলো শুধু মাত্র নিজের ব্যবসা কে নিশ্চিত করতে প্রথম বর্ষ থেকে এমবিবিএস র ছেলেকে বোঝাতে শুরু করছে এমবিবিএস করে কিন্তু কিছু হবে না। অথচ সে তখন এমবিবিএস টাই করে ওঠেনি। তার আগে থেকেই কাগজ লিফলেট বা অন্য কিছু র মাধ্যমে ফিসফিস করে একটাই মন্ত্র কানে গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। ফলে যে অনার্স পায় সে আরো চাপ নিচ্ছে। তাতে পড়া বাড়ছে না। দেখা গেলো যে শুধু পড়ার আনন্দে পড়াশুনো করে ভালো রেজাল্ট যা করেছিলো সেও অযথা টেনশন করছে কারণ শয়তানের বাণী কানে ঢুকে গেছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। যারা মাঝামাঝি তারা হাল ছেড়ে দিচ্ছে হবে না তখন তখন আর কি হবে পড়ে।
জীবনে হাজার উত্থান পতন হলেও আমি আমার ডিগ্রি বা কোর্স নিয়ে ভাবিত ছিলাম না। এমবিবিএস র পরে কোচিং না নিয়ে গান বাজনা কেন করেছিলাম সেই চর্বিত চর্বন বা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি র কথা বলতে বসিনি। তবে মনে আছে একটি বিখ্যাত কোচিং সেন্টারের মার্কেটিং ম্যানেজার যাকে এন আর এস থেকে নর্থ বেঙ্গল সব জায়গা তে দেখা যেতো, সে আমার ঘরে ঢুকে যখন বললো এমবিবিএস করে কিছু হবে না আমি পাশ ফিরে শুলাম। সে বললো এর কিছু হবে না। আমার খুব বেশী কিছু হওয়ার কথা ছিলো না কিন্তু সেই কোচিং ইন্সটিটিউট উঠে গেছে এবং এখন সেই লোকটি অন্য কোম্পানী তে সেলস ম্যান। তার ভালো হোক এটা কাম্য আমার।
এরপর যতবার কোচিং সেন্টার গুলো র প্রোমোশনাল ক্লাসে গেছি একটাই জিনিস দেখেছি একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়ের মধ্যে। একটা অদ্ভুত ইনসিকিওরিটি তৈরী করা। বক্তা নিজে ডাক্তার, নিঃসন্দেহে ভালো শিক্ষক এবং পাশাপাশি সুচতুর ব্যবসাদার। প্রতিটি প্রোডাক্ট বিক্রি হয় মানুষের একটা ইনসিকিওরিটি থেকে। সেই ব্যাপারে বিশদ যাচ্ছি না। তবে যে ছেলেগুলো র নিজের ক্ষমতা ছিলো পড়াশুনো করে নিজেই পিজি এন্ট্রান্স এ চান্স পাওয়ার সেই ছেলেটা কে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে নিজের ক্লায়েন্ট বানানো ই হল এই কোচিং সেন্টারের লক্ষ্য। আর সে ব্যাপারে এরা সফল। প্রতিটি ছাত্রছাত্রী কে এরা সফলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কোচিং ছাড়া পিজি তে চান্স সম্ভব না এবং পিজি না করলে জীবন বৃথা। দীর্ঘ কুড়ি বছরের চেষ্টাতে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা সফলভাবে সমস্ত মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সত্যি বলতে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মা ছেলে ডাক্তার হয়েছে এতেই অনেকটা খুশি থাকে। মাঝে মাঝে গাঁইগুই করে বিয়ে আর এমডি র জন্য। কিন্তু এই যে ভয়ানক চাপ সেই কাজ টা ব্যবসায়ী সংস্থা গুলো এখন প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করছে। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে পিজি এন্ট্রান্স পরীক্ষার ইনডাকশন ক্লাস। ভাবুন যার আরো তিন বছর এমবিবিএস টাই পাশ করতে বাকি সে দ্বিতীয় বর্ষ থেকে পিজি এন্ট্রান্স র প্রস্তুতি নিচ্ছে। চতুর্থ বর্ষে USMLE র। শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবসার জন্য কি ভাবে এই অসুস্থ ব্যবস্থার ফাঁদে ছেলেমেয়ে গুলো বন্দী হচ্ছে।
ফলে সাধারণ ক্লাস ফেলে ছেলে মেয়ে গুলো ইনডাকশন প্রি ইনডাকশন ক্লাস করছে। ওয়ার্ডে যাচ্ছে না। রোগী দেখছে না। সারাদিন কানের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না।
এদিকে পুরোনো শিক্ষক , যাদের জ্ঞান প্রশ্নাতীত, তারা রাজী নয় নতুন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি কে আপন করতে। আমরা স্টেট ফ্যাকাল্টি সার্বিকভাবে তাদের সর্বভারতীয় পরীক্ষাতে যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য তৈরী করতে পারছি না। এখনো পড়ানোর ধরন নব্বই র দশকে পড়ে আছে। বলতে খুব খারাপ হলেও সত্যি টিচার ট্রেনিং দিতে আসা লোকটাই ইংরেজী বলতে চারবার তোতলাতে থাকে। সেখানে এসি হলে আই প্যাড থেকে নোটপ্যাড খুলে চোস্ত ইংরেজি তে সুন্দরভাবে আলু সেদ্ধ কেই mashed potato with low salt butter, and freshly picked green chilly from garden বলে যখন কেউ পড়াচ্ছে সবাই সেদিকে পতঙ্গের মতো ঝুঁকে যাচ্ছে। কিন্তু গোটা কোর্সের আসল উদ্দেশ্য ডাক্তার হওয়া যার জন্য সবথেকে বড় শিক্ষক একটা রোগী। এই কথা টা ছেলেমেয়ে রা ভুলে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য খুব সন্তর্পণে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইন্টার্ণশিপের টাকায় গোয়া ট্রিপ স্কুবা ডাইভিং না করে, নতুন জীবনের প্রথম কষ্টার্জিত টাকা কোচিং সেন্টারে র খাতায় জমা করে সারাদিনে সাত ঘন্টা ক্লাস করছে। সাত ঘন্টা ক্লাস একদিনে। কতটা অবৈজ্ঞানিক এবং মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী এই প্রশ্ন তুলতে কেউ নেই। একটা বিষয় কখনো কোনোদিন দু থেকে তিনদিনে এরকম ভয়ানক ক্লাস করে শেখা যায় না। উল্টে কি হচ্ছে আমি কত কম জানি এই অনুভূতি নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে আসছে। কানের কাছে একটাই কথা বাজছে এমবিবিএস করে কিছু হবে না। এক বছর কোচিং করে যখন কিছু হলো না তখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে চেম্বারে রোগী দেখবে বা আইসিইউ করবে সেই জোরটা ও থাকছে না।
পরীক্ষা তে প্রশ্ন ও করা হয় প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনের জ্ঞানের বাইরে গিয়ে সমান্তরাল বিশ্ব থেকে। এবং ধারণা করা যায় এর পুরোটাই কোচিং সেন্টার ফান্ডেড। যাতে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে কোচিং সেন্টারের কাছে যেতেই হয়। ইদানিং আবার সেভাবে কোন ভালো এম সি কিউ বই ওবধি নেই বাজারে। কি ভয়ানক। পরীক্ষার প্রশ্ন সাধারণ ছেলে রা জানবে না অথচ কোচিং সেন্টার জানে।
সার্বিকভাবে প্রতিটা জুনিয়র ডাক্তারের জীবন থেকে স্বাভাবিক ছন্দ টা হারাচ্ছে এই পিজি র ইঁদুর দৌড়ে। যারা মানসিকভাবে সুস্থ তারা লড়াই টা জিতে যাচ্ছে। যারা একটু দুর্বল তারা অবসাদে ভুগছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সার্বিকভাবে ফার্স্ট ইয়ার থেকে জুনিয়র ডাক্তার ওবধি একটা ছেলে কে মগজ ধোলাই করে তাকে আর্থিক এবং মানসিক ভাবে ছিবড়ে করে দেওয়ায় কোচিং সেন্টারের অনবদ্য ভূমিকা দেখেও আমরা নীরব। হয়তো এই ইঁদুর দৌড়ে না থাকলে সে দিব্যি নিজের মতো থাকতো। বেড সাইড ক্লিনিকে যেতো। আরেকটু আনন্দ করে পড়তে যেমন আগে পড়েছে সবাই। ইঁদুর দৌড়ে আর যাই হোক ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না এই কথাটা কে বোঝাবে। কে বোঝাবে শুধু এমবিবিএস র জীবন একেবারেই খারাপ না। এমডি করতে হবে। নিশ্চয় করতে হবে। তবে দু চার বছর পরে করলে কিচ্ছু হবে না। এটা বলার মতো নেই। আবার এই ভয়ানক ইঁদুর দৌড়ে সেটা বললে অপ্রিয় ও হতে পারার সম্ভাবনা থাকে।
অবসাদ এবং তার প্রতিকার, আত্মহত্যা কি ভাবে আটকানো যায় সেগুলো বিশেষজ্ঞ র পরামর্শ ই একমাত্র নেওয়া উচিত। এটা আমার নিজের ভাবনা থেকে মনে হয়েছে সমস্ত কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ হলে ছাত্র থেকে জুনিয়র ডাক্তার সবাই একটু চাপমুক্ত হয়। সাথে চিকিৎসক ডাক্তারের ও উচিত শিক্ষা পদ্ধতি র ব্যাপারে একটু আপডেট হওয়ার মানসিকতা নিয়ে আসা।
বস্তুত এই প্রহেলিকার মধ্যে গোটা জুনিয়র ডাক্তার রা যে আজ ঘুরছে তার জন্য আমাদেরই দায়।