চার্লস ফ্রান্সিস কগল্যান ছিলেন তাঁর সময়কার একজন খ্যাতিমান সেক্সপীয়রের নাটকের অভিনেতা। তিনি ১৮৪১ সালে কানাডার পূর্ব উপকূলের প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৯ সালে হঠাতই একদিন অভিনয় করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তিনি আমেরিকার টেক্সাসের বন্দর শহর গ্যালভাস্টনে মারা যান।
যেহেতু তাঁর শহরের থেকে গ্যালভাস্টনের দূরত্ব অনেক তাই তাঁর অনুগামীরা তাঁকে টেক্সাসেই সমাহিত করেন। টেক্সাসে ১৯০০ সালে একবার মারাত্মক সামুদ্রিক ঝড় আসে। তাতে সেই কবরখানা তছনছ হয়ে যায়। কগল্যানের কফিন সমুদ্রে ভেসে যায়। ১৯০৮ সালের অক্টোবরে প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপের এক জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে কগল্যানের কফিন ভেসে আসতে দেখেন। তাঁকে উদ্ধার করে তাঁর কফিনকে আবার সেই চার্চের চত্বরে সমাধিস্থ করা হয় যেখানে কগল্যান ব্যাপ্টাইজড হয়েছিলেন।
প্রায় নয় বছর পরে ৩৫০০ মাইল সামুদ্রিক পথ অতিক্রম করে কগল্যানের লঝঝরে হয়া আসা কফিন তাঁর বাড়িতে ফিরে এসেছিল।
এই কোইনসিডেন্স বা সমাপতনকে আপনি কী বলবেন? এটা নেহাতই কাকতালীয় নাকি এর মধ্যে কিছু রহস্য আছে? নাকি এটা বিভিন্ন সম্ভাবনার খেলা, যে খেলাই দুটো সম্ভাবনা র্যানডমলি কাছাকাছি এসেছে। বিজ্ঞান একে ব্যাখ্যা করতে পারে না তাই অস্বীকার করে এই বলে যে এটা আমাদের প্যারানর্ম্যাল বা পরাবাস্তবতার দিকে নিয়ে যায় যা কিনা সিউডোসায়েন্স। যাঁরা এতে বিশ্বাস করেন তাঁরা বলেন এটি দৈবাদিষ্ট ঘটনা। এভাবেই দৈব আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কেউ কেউ বলেন অন্য গ্রহের জীবের কথা। প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা।
কী আছে এই কোইনসিডেন্সে? কেনই বা তা এত ঘনঘন আসে আমাদের জীবনে? এর রহস্যই বা কী? সবচেয়ে বড় কথা আপনি কি এর অলৌকিক সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেন? আমি আমার ঈশ্বর সংক্রান্ত ভঙ্গুর ধারণার মতই একে নিয়েও খুব বিপন্ন। তাই একবার একে নিয়ে কিছু ভাবতে চাই। জানতে চাই। আমার জীবনেও এই কোইনসিডেন্সের ছড়াছড়ি। ভেতরে যাবার আগে আমার নিজের কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা আপনাদের জানিয়ে দিই।
আমি এখন যেমন একটু-আধটু লিখতে পারি ছোটবেলা থেকেও সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ ছিল। এই অনুরাগ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথম যে জ্ঞানী মানুষটিকে দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম তিনি আমাদের বাংলার শিক্ষক তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। মফস্বলের শিক্ষক হয়েও তাঁর মধ্যে বাঙলা, ইংরিজি এবং সংস্কৃতে অসম্ভব দক্ষতা ছিল। আমাদের মত রাজ্য বা দেশ বলেই তিনি হয়ত একটি সাধারণ স্কুলের শিক্ষক হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে যান।
অবসরের অনেক আগেই জিভের ক্যানসারে তাঁর মৃত্যু হয়। মুখে পান আর নস্যি ছাড়া তাঁকে আমি কখনও দেখি নি। অসম্ভব রুচিশীল কেতাদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবি পরা মানুষটি একজন সুলেখক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগেই জীবনানন্দের ওপর তাঁর বহুদিনের গবেষণালব্ধ বইটি প্রকাশিত হয়। আমার সেটি পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। পাই নি। আনন্দবাজারে বইটির ওপর একটি সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল।
কেটে গেছে বছর কুড়ি। কলেজ স্ট্রিটে গেলেই ওনার কথা মনে হত। কতবার ক্লাসে যে তিনি কলেজ স্ট্রিটের কথা বলতেন। একদিন এমনি ফুটপাথে কলেজস্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে কি মনে হওয়ায় দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ল স্যারের বইটা। যে বইটার কথা এতদিন আমার মনে ছিল। বহু খোঁজ করেও পাই নি। পাবার কথাও নয়। এক সাধারণ স্কুল শিক্ষকের অপ্রচলিত বইয়ের খবর কে আর রাখবে? মাত্র দশ টাকায় সেই বইটা সেদিন আমি কিনে নিলাম।
এই ঘটনায় আমি এত প্রভাবিত হয়েছিলাম যে সেই মুহূর্তের কলেজ স্ট্রিট চত্ত্বর, বইয়ের দোকান, পুরনো উত্তর কলকাতা যেন এক অলৌকিক সম্ভাবনা নিয়ে সেদিন আমার সামনে এসে হাজির হয়েছিল। আমার নিজেকে মনে হয়েছিল এই বিপুল মহাবিশ্বের মধ্যে যে একটি বিন্দু পৃথিবীতে আমার জীবন সেই বিরাট পৃথিবীর ততোধিক ক্ষুদ্র এক বাঙালি যুবকের জীবনের সাথেও কোথায় যেন এক অলৌকিকতা জড়িয়ে আছে। একটা কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ। আমার মত এক অতি সাধারণ মানুষের সাথে বিশ্ব নিখিলের। আর কারো কাছে এই অলৌকিকতা একটা র্যানডমনেস হতে পারে। আমার কাছে আমার চেতনায় সেদিন এর গুরুত্ব অপরিসীম ছিল।
মাস্টারমশায়ের বইটির নাম ‘জীবনানন্দের কবিতায় আদিরূপকল্প’। বইটি শুরু হয়েছে ইয়ুং কথিত ‘আর্কিটাইপ’এর ধারণার সাথে। যে ইয়ুং কোইনসিডেন্স নিয়ে অনেক লিখে গেছেন। তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ‘সিনক্রোনিসিটি’। আমরা সেসব নিয়ে আমাদের আলোচনায় আসব। এই ক্ষেত্রে কী আশ্চর্য সিনক্রোনিসিটি দেখুন। যে বই আমি কোনোদিন চোখে দেখি নি, বইয়ের লেখক মারা গেছেন কমবেশি বছর কুড়ি আগে, সেই কাঙ্খিত বইটি আমি পেয়ে গেলাম ফুটপাথে।
মাসখানেক আগে এক ভদ্রমহিলা একটি বাচ্চাকে দেখাতে নিয়ে এলেন। তার গায়ে হাতে পায়ে লাল র্যাশ। মুখে-জিভে ঘন সাদা আস্তরণ। এক ডাক্তার দেখিয়ে এনেছেন। কমে নি। আমি বাচ্চাদের এখন দেখি না। তাই জ্ঞান নেই। সাধারণ ওষুধ দিয়ে ছবি তুলে নীলেন্দুদাকে পাঠালাম। নীলেন্দু শর্মা মালদার ডার্মাটোলজির হেড। আমরা মালদায় একই ঘরে থাকি। দাদা দেখেই লিখলো ‘হ্যান্ড ফুট মাউথ ডিসিজ’। আমি বললাম, জ্বর নেই কিন্তু। দাদা বললো, হতেই পারে। কিছুদিন বাদে মহিলাটি আবার তাঁর মেয়েকে একই সমস্যা নিয়ে দেখাতে এলো। আমি তখন কনফিডেন্ট।
মাস খানেক বাদে একদিন দুজনে ঘরে বসে গল্প করছি। কথায় কথায় পাবলিকেশনের কথা উঠল। দাদার প্রচুর কাজ আছে। তিনি হঠাতই বললেন, তাঁর অন্যতম কাজ ছিল কলকাতায় ‘হ্যান্ড ফুট মাউথ ডিসিজ’কে প্রথমবার সনাক্ত করে পাবলিকেশনের জন্য পাঠানো। উনি এক অত্যন্ত দুঃখের কথা বললেন, আমাদের দেশে ভাইরোলজিক্যাল টেস্টের জন্য একমাত্র জায়গা পুনের ভাইরোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট। এই অসুখ নিয়ে তখন সারা ভারতে মাত্র দুই একটি পাবলিকেশন ছিল। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কিছুই ছিল না।
উনি তাই নিজে তাঁর পেশেন্টদের থেকে তিরিশের ওপর স্যাম্পল সংগ্রহ করে নিজের খরচে কোল্ড চেইন বজায় রেখে সেই সব স্যাম্পল পুনেতে পাঠান। তাঁরা তাঁকে কিছুই জানান নি। বেশ কয়েকমাস পরে দাদা দেখেন পুনের ইন্সটিটিউউটের লোকেরা তাঁর স্যাম্পল নিয়ে সেই রোগের কথা একটা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করেছে। সেখানে কোথাও তাঁর নাম নেই। একদম নীচে অ্যাকনলেজমেন্টে খুব ছোট করে তাঁর নাম লেখা। এই হল আমাদের দেশ। দাদা আইনের পথে না গিয়ে নিজে তাঁর ক্লিনিক্যাল কেসগুলোকে নিয়েই অন্য একটি জার্নালে পাবলিশ করেন। উনি দীর্ঘদিন এই ঘটনার কারণে অবসন্নতা কাটাতে পারেন নি।
কী অদ্ভুত দেখুন আমি এতশত না জেনে এমন একজনকেই আমার রুগির ছবিটি পাঠালাম যিনি কলকাতার মধ্যে প্রথম এই রোগটিকে নিয়ে আজ থেকে বছর কুড়ি আগে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। অথচ এই পুরো ব্যাপারটা আমার অজানাই ছিল। সেদিন ঘটনাচক্রে কথায় কথায় সেই কথা না উঠলে আমি জানতেও পারতাম না। একে আপনি কোইনসিডেন্স না বলে কী বলবেন?
গত মাসে ফেসবুকে আকাশে ওরিনয়েড উল্কাপাতের ওপর একটি পোস্ট দিয়েছেলাম। সেখানে রাতের আকাশে আমার ক্যামেরায় তোলা কালপুরুষ বা ওরিওনের ও তার কোমরবন্ধের তিনটি বিশেষ তারা আলনিতাক, আলনিলাম ও মিনতাকার ছবি পোস্ট করি। সেই ছবি দেখে সুনেত্রা সাধু নামে একজন বন্ধু-লেখিকা উল্লেখ করেন যে তাঁদের বাংলায় নাম নাকি ঊষা, অনিরুদ্ধ ও চিত্রলেখ। সত্যিই আমি এই নামগুলো জানতাম না। বেশ কিছুদিন ধরেই স্মৃতিবিভ্রমে ভুগছি। তাই অনিরুদ্ধ নামটিকে এই বলে মনে রাখলাম যে ওই নামে আমার একজন রুগি-বন্ধু-মাস্টারমশাই চেনা আছে।
সেদিন মালদা থেকে ফিরছি। গৌড় তখনো ছাড়ে নি। হঠাৎ করে মনে করার চেষ্টা করলাম দেখি তো আমার তারা তিনটের নাম মনে পড়ছে কিনা? খুব সহজেই আমার চেনা ‘কিউ’ অনিরুদ্ধের নাম মনে এল। যেই না তার নামটি মনে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফোন অনিরুদ্ধের। ওর বউয়ের ঠান্ডা লেগেছে। ফোনে কিছু ওষুধ বলে দেয়া যায় কিনা। আমি ওর সাথে কথা বলে বাকরুদ্ধ হয়ে চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ। এও হয়? এমন কোইনসিডেন্স এত ঘটে? একি টেলিপ্যাথি?
কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম কোইনসিডেন্স নিয়ে লিখব। কিছু পড়াশুনো করছি। কাল থেকেই এটিকে লেখা শুরু করলাম। সকালে মালদায় ক্লাসে পড়াচ্ছি। হঠাৎ একজন ফোন করল, ডাক্তারবাবু আমি রবীন্দ্রপল্লী থেকে বলছি। আমার দিদি মেয়ের কাছে নিউ টাউনে গেছে। খুব পেটে ব্যাথা। একজন বলেছে ডি কোলিক ইঞ্জেকশন দিতে। দেবো?
এমন ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতেই হয়। আমি বললাম, শুধু ডি কোলিক না দিয়ে একটা র্যানট্যাকও সঙ্গে দিন। ঘন্টাদুয়েক বাদে আবার ফোন। ডাক্তারবাবু আমি ওমুকের বোন ওমুক নিউ টাউন বলছি। আপনাকে সকালে ফোন করা হয়েছিল। ইঞ্জেকশন দিয়েও ব্যথা কমছে না।
আমি বললাম দেখুন তাহলে হয়ত ওনার গল ব্লাডারে পাথর হয়ে থাকতে পারে। হার্টের ব্যথাও হতে পারে। আপনি হাসপাতালে ভর্তি করে ইউ এস জি আর ই সি জি করান। তারপর ভুলে গেছি। বিকেল চারটের সময় যখন ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হচ্ছি একজন ছাত্র বেমক্কা জিজ্ঞাসা করল, স্যার একটা কথা আছে। প্যানক্রিয়াটাইটিসে কি সার্জারি করাতেই হয়?
আমি বললাম না, না। তা কেন। তবে অনেক সময়ই দেখা যায় প্যানক্রিয়াটাইটিসের সাথে রুগিদের গলস্টোন থাকে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই অপারেশন করাতে হবে।
বিকেলে মালদায় ‘কোইনসিডেন্স’ নিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছি। পাঁচশ শব্দের মত লিখে বন্ধ করলাম। আজ রাতে বাড়ি ফিরব। বাকিটা ঠিক করলাম বাড়িতে ফিরে লিখব। বসে বসে ভাবছিলাম এই যে লিখছি এই লেখার সাথে কি এই মুহূর্তে কিছু কোইনসিডেন্স ঘটতে পারে?
সাথে সাথেই মোবাইল বেজে উঠল। ডাক্তারবাবু, আপনাকে সকালে মার জন্য ফোন করেছিলাম না। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। ইউ এস জি তে আপনি যা বলেছিলেন সেই গল ব্লাডারে স্টোনই ধরা পড়েছে। তার সাথে প্যানক্রিয়াটাইটিসও ধরা পড়েছে। মাকে কী এখন ভর্তি রাখতেই হবে?
তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আমার মনে একই সাথে আনন্দ ও বিস্ময়। কাল রাতে আমার যা অভিজ্ঞতা হল তা সহজে ভোলার নয়। আপনাদেরও নিশ্চয়ই এমন অভিজ্ঞতা আছে। এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই থাকে। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এবার কিছু কথা বলব। যাঁরা এ নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা কী বলছেন।
আমাদের আলোচনায় চলে আসবে ‘ই এস পি’ বা এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপশন, টেলিপ্যাথি, এলিওন, প্যারালাল ইউনিভার্স, কোয়ান্টাম থিওরি, জ্যোতিষ, হাত দেখা, পাথর, গ্রহণ, ধুমকেতু, ভূত-প্রেত, ভাগ্য এসব অধিকাংশ অবৈজ্ঞানিক ও কিছু বৈজ্ঞানিক আলোচনা।
চলুন জীবনের রহস্যে প্রবেশ করা যাক।
দারুন