গত দেড় মাস আগে অক্টোম্বর মাসের এক সকাল। ঘুম থেকে উঠে বুনুয়েলের আত্মজীবনী ‘শেষ দীর্ঘশ্বাস’ খুলে পড়ছি। রান্নার দিদি চা দিয়ে গেছে টেবিলে। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় প্রাচীন অভ্যাসের বশে ফেবু খুলে বসলাম। দেখি কবিবন্ধু অনুপম ওর প্রোফাইলে ‘বুনুয়েল বুনুয়েল’ এই কবিতাটা পোস্ট করেছে। এটি ওর ‘অনুপম % মানুষরা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। আগেই পড়া। অবাক হলাম।
একটু স্ক্রোল ডাউন করতেই দেখলাম আরেক কবিবন্ধু নীলাব্জ ‘মায়াজম’ নামে এক ওয়েবম্যাগে তার একটি নতুন কবিতা প্রকাশ করেছে। ‘কাঁচ বিষয়ক আলোচনা’। অনেকদিন বাদে ওর কবিতা পড়লাম। তাই মন্তব্য করলাম, ‘অনেকদিন বাদে তোমার কবিতা এল। স্মৃতির রিহার্সাল হল’।
আবার একটু নীচে নামতেই দেখি ওর আরেকটি কবিতা। যেটি প্রথমটির একদিন পরে পোস্টিত। ‘সমাবকলন’। সেখানে একটি লাইন আছে, ‘অথচ স্মৃ নামের ধাতু, যে আলাপে বারবার, ঝালিয়ে নিচ্ছে…’।
কয়েক সেকেন্ড আগেই ওর কবিতায় স্মৃতিবাচক মন্তব্য করলাম। তার পরেই এই ‘স্মৃ’ ধাতুর উল্লেখ। বুনুয়েলের সাথে বুনুয়েল। সবকিছুই এক মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই। জানালা দিয়ে অলৌকিক শারদ আলো প্রবেশ করছে আমার ঘরে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে আমি জীবনের প্রমিত সম্ভাবনার কথা, আশাবাদের কথা আরেকবার ভাবতে বসলাম।
এই যে শব্দের সাথে শব্দের, ধারণার সাথে ধারণার কোইনসিডেন্স তা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আকছার ঘটে। আমার ক্ষেত্রে তো হরদম হয়। নতুন কোনো শব্দ শিখলে তা বাংলাই হোক বা ইংরিজি, জানার পরে সর্বত্র তার উপস্থিতি লক্ষ্য করি। কয়েকদিন আগেই ‘অপিচ’ শব্দটি প্রথম শিখি। তারপর সর্বত্রই অপিচ। অপিচ ‘অপিচ’। অনেকে বলেন এটা মনোযোগের জন্য ঘটে। শব্দটা যখন শেখা হয় তখন তাতে নতুন করে মনোযোগ বাড়ে। আসলে শব্দটি আগেও চারপাশে ছিল। আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। হতে পারে, তবে এটা এত সাধারণ কোইনসিডেন্স, যে অবাক না করে যায় না।
ঠিক এমনটাই ঘটে কোনো গানের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করে কোনো গানে আগ্রহী হলে চারপাশে শুনতে পাওয়া যায় এই গান। সকলের কাছে সেটি র্যানডম কোইনসিডেন্স হলেও আমাকে ব্যাপারটার রহস্যময়তা খুব আকর্ষণ করে। এমনভাবেই আপনি কোনো বিষয় নিয়ে যদি লাইব্রেরিতে খোঁজ করেন তবে দেখবেন কোনো কিছু নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে প্রায় হতাশ হয়ে যখন ছেড়ে দিয়েছেন তখন বেমক্কা এমন কোনো বই পেয়ে যাবেন যাতে আপনি আপনার অনুসন্ধানের সুলুক পেয়ে যাবেন। এই কোইনসিডেন্স অ্যাকাডেমিকদের মধ্যে খুব হয়। ইয়ুং একে বলেছিলেন ‘লাইব্রেরি এঞ্জেল’। ইয়ুং খুব আশাবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি কোইনসিডেন্সকে শুধু কোইনসিডেন্স বলেই থেমে থাকেন নি। ইয়ুং-এর কথায় বিস্তৃতভাবে আমরা পরে আসছি।
এই যে লেখাটা লিখছি প্রথম কিস্তিতে আমি সুনেত্রা সাধু বলে আমার এক ফেবুর বন্ধু-লেখিকার কথা উল্লেখ করেছিলাম। যাঁরা সেটি পড়েছিলেন তাঁদের মনে থাকার কথা। উনি গতকাল আমার মেসেঞ্জারে ওনার এক আশ্চর্য কোইনসিডেন্স-এর কথা আমাকে জানান। আমি ওনার অনুমতি নিয়েই আপনাদের এই ঘটনাটার কথা জানাচ্ছি। ওনার জবানিতেই ঘটনাটি শুনুন-
“এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার একটি উপন্যাস ৪৫ সপ্তাহ ধরে একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বেশ কিছু পাঠকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় যাঁরা নিজের ভালোলাগা আমায় ব্যক্তিগত ভাবে জানাতেন। তার মধ্যে একজন এতটাই একাত্ম হয়ে পড়েন যে উনি ভাবতে শুরু করেন উনিই গল্পের চরিত্র। গল্পের চরিত্রের নাম ছিল আভেরী। মেয়েটি তার মতো হীরের নাকছাবি পরতে শুরু করে, এবং প্রতি পর্বের পর আমাকে মেসেজ করে জানান চরিত্রের ভাবনা ঠিক কীভাবে মিলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও বিষয়টা নিয়ে আমার অস্বস্তি হতে শুরু করে।
পরবর্তী উপন্যাস যখন শুরু করি তখন বলেন এইরকমটাই ওনার শৈশবে ছিল। উনি বিন্নি নামক চরিত্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করছেন। আমার তখন বেশ বিরক্ত বোধ হত।
গত জুলাই মাসে একটি বড় গল্প লিখতে শুরু করলাম, যার চরিত্র উৎসা সদ্য বিধবা। লিখে মনে মনে করলাম এই গল্প পড়ে নিশ্চয় বলবে না আমি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছি।
ঠিক সেই দিন রাতে একটি কমন বন্ধু মেসেজ করে জানালো গতকাল রাতে ওর স্বামী হঠাৎই মারা গেছেন।
আমার এত অপরাধবোধ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না। সেই গল্প আমি তখন জমা দিতে পারিনি।
গতমাসে পাঠিয়েছি”।
লেখিকা প্রথম যে ধারাবাহিক উপন্যাসের কথা বলেছেন তার নাম ‘হীরের হৃদয় রহস্য’। তা সম্প্রতি বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।
এই যে মর্মান্তিক কোইনসিডেন্স এর ব্যাখা আপনি কিভাবে করবেন? উনি যে মেয়েটির কথা বলেছেন যে কিনা তার চরিত্রের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছে তা নিয়ে বাস্তব ও সাহিত্যে অনেক লেখাপড়া আছে। এটিকে সম্ভবত ‘ডপেলগ্যাঙ্গার সিন্ড্রোম’ বলা যেতে পারে। এটিও নিজে থেকেই একটি কোইনসিডেন্স-এর উদাহরণ।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখুন সুনেত্রাদেবীর উল্লেখ করা ঘটনায় মেয়েটির ক্ষেত্রে যে কোইনসিডেন্স ঘটে চলেছে সেটি একধরনের আর লেখিকার লেখার সূত্র ধরে মেয়েটির জীবনে যে কোইনসিডেন্স ঘটেছে সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি আরেক ধরনের। এই উদাহরণটিকে বলা যেতে পারে ‘কোইনসিডেন্স ইন কোইনসিডেন্স’। একটি সমাপতনের মধ্যে আরেকটি সমাপতন। আমরা এই কোইনসিডেন্স-এর শ্রেণীবিভাগ নিয়েও আলোচনায় আসব।
‘ডপেলগ্যাঙ্গার’ একটি জার্মান শব্দ। এর অর্থ ‘একটি কাল্পনিক বা বাস্তব অবিকল দ্বিতীয় অস্তিত্ব’। এটি একটি কোইনসিডেন্স।
এই অসুখটি নিয়ে ডক্টর পিটার ব্রুগার কাজ করেছিলেন। তাঁর রুগিদের মধ্যে অনেকেই এই অসুখের শিকার ছিল। তাঁরা মনে করতেন তাঁদের এক দ্বিতীয় অস্তিত্ব সবসময় তাঁদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বা তাঁদের বিরক্ত করছে। তাঁদের ক্ষতি করতে চাইছে। একজন রুগি তার কল্পিত জোড়কে নিয়ে এতই বিব্রত হয়ে পড়ে যে তার হাত থেকে নিস্তার পেতে নিজেকে গুলি করে হত্যা করেছিল।
সাহিত্যে এই ডপেলগ্যাঙ্গার সিন্ড্রোমের দুটি ক্লাসিক উদাহরণ হল দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ডাবল’ এবং অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পোট্রেট অফ ডোরিয়ান গ্রে’। ডক্টর ব্রুগার এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে উল্লিখিত দুই খ্যাতিমান লেখকও সম্ভবত ডপেলগ্যাঙ্গার সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের উপন্যাসে ওই দুই চরিত্রের মাধ্যমে নিজেদেরকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
ব্রুগারের মন্তব্যের বিরোধিতা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে দস্তয়েভস্কি স্নায়বিক অসুখের শিকার ছিলেন। তিনি এক অদ্ভুত রকমের বিরল ‘টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির’ শিকার ছিলেন যার নাম ‘এক্সট্যাটিক এপিলেপ্সি’। তিনি নিজে লিখেছিলেন, সেই মৃগির খিঁচুনি হবার পরে হয়ত সবে কয়েক মিনিট বা সেকেন্ড পার হয়েছে কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই তিনি যেন তাঁর সমগ্র জীবনের অভিব্যাক্তি ও উপলব্ধি নিখুঁতভাবে অর্জন করতেন। তাঁর এই মৃগিরোগ নিয়ে ‘ইডিয়ট’ উপন্যাসে তিনি প্রিন্স মিশকিনের চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অন্তিম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’ কারো মতে তাঁর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনের উপন্যাস। তাই ব্রুগারের ধারণা সত্যিও হতে পারে।
আর শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে মাথার অসুখ বা খ্যাপামো খুব সাধারণ ঘটনা। একজন সেই অর্থে ‘সুস্থ’ লেখক বা শিল্পীও তার ব্যক্তিগত জীবনে আর পাঁচজনের চোখে মোটেও ‘স্বাভাবিক’ নন। তিনি একজন অস্বস্তিকর। সমাজ তাঁকে কোথায় রাখবে বুঝে পায় না। জয়েস তাঁর মেয়ের সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে সারাজীবন জেরবার হয়েছিলেন। নানা জায়গায় দেখিয়েও সুরাহা হয় নি। এই মেয়েকে নিয়ে তাঁর এবং স্ত্রীর মধ্যে বাক-বিতন্ডা লেগেই থাকত। তিনি শেষে তাকে তখনকার দিনের খ্যাতিমান সাইকোলজিস্ট কার্ল ইয়ুং-এর কাছে নিয়ে যান। জয়েস ততদিনে ‘ইউলিসিস’ লিখে ফেলেছেন। সচরাচর তিনি নিজের বই কাউকে উপহার হিসেবে দিতেন না কারণ তাঁর উপন্যাসের দুরূহতা নিয়ে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন। ইয়ুং এর পান্ডিত্যের কারণে তিনি তাকে হয়ত বইটা দ্যান।
বইটা পড়ে ইয়ুং মন্তব্য করেন, বাবা ও মেয়ে দুজনেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।
তবে কোইনসিডেন্স যে সবসময় অসুস্থ মনেই ঘটে এমন ভাবাটা অন্যায়। বরং উল্টোটাই সত্যি। গবেষণায় দেখা গেছে যারা জীবনে সহজেই কোইনসিডেন্স খুঁজে পায় তারা খুব আশাবাদী মানুষ। তারা জীবনের ওপর সহজে ভরসা হারায় না। মানুষ যখন এমন বোধ করে যে এই বিরাট বিশ্ব চরাচরে সে একা নয় কোথাও যেন এই মহাবিশ্বের একটি ‘অন্য মন’ বা ‘একক মন’ আছে যাকে ইয়ুং আর পাউলি বলেছিলেন ‘উনাস মুন্ডুস’। সেই অদৃশ্য মনের সাথে সে নিজের যোগ খুঁজে পায়। সেই মন তার সাথে যোগাযোগ করে তাকে একটি লক্ষ্যের দিকে চালিত করে। সে পথ হারায় না।
বিজ্ঞান আমাদের বস্তুজগতকে দেখার একটা চোখ দিয়েছে। সেই চোখ দিয়ে দেখারও একটা নিজস্ব মাপকাঠি আছে কিন্তু সেটাই অক্ষয় নয়। মানবিক চেতনা বা কনসাসনেসের ব্যাপারে সে কিছুই বলতে পারে না। আমাদের বৌদ্ধিক ও জৈবনিক সুখের জন্য এই বোধটা জরুরি। তাই সে যতই বলুক না কেন যে ‘কোইনসিডেন্স লাইস ইন দ্য আই অব দ্য বিহোল্ডার’ যত সময় যাচ্ছে ততই আরেক বিজ্ঞানী ও কোইনসিডেন্স নিয়ে গবেষণা করে নিন্দিত আর্থার কোয়েসলারের কথাই ক্রমশ সত্যি হয়ে উঠছে।
‘যত দিন যাচ্ছে প্যারাসাইকোলজি তত বেশি করে বিজ্ঞানের অভিমুখে চলেছে আর বিজ্ঞান কোয়ান্টাম তত্ত্বের হাত ধরে অধিবাস্তবতার দিকে যেতে চাইছে’। কথাটা যে মিথ্যে নয় আমরা সেটিকে বিচার করে দেখব।
শেষ করি একটি মজার কথা বলে। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার থেকে তিন বছরের জুনিওর একটি ছাত্র আমাদের নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। মানিক কাটুরোকা। আমি প্রথম দিন তাকে দেখে চমকে গেছিলাম। সেসময় তার সাথে আমার চেহারায় এতটাই মিল ছিল। এরপর যখন আমি সাত বছর কলকাতার ন্যশনাল মেডিকেল কলেজে ছিলাম তখন ক্যান্টিনে ওর সাথে দেখা হত কথা হত। আমার মনে এক অন্যরকম অভিব্যাক্তি হত ওর সাথে কথা বলে। এখন ও নেফরোলজিস্ট হিসেবে খুব নাম করেছে।
আমাদের চেহারার মিল কোথায় যেন আমাদের মনের নৈকট্য নিয়ে আসত। মানিক ছিল আমার ডপেলগ্যাঙ্গার।
(চলবে)
এই লেখা পড়তে পড়তে নিজের জীবনের অনেক ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে।👍👍