আমার এমবিবিএস পড়া বাঁকুড়ায়। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজে। রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেল জীবনের পর সে এক অন্য ধরনের আবাসিক জীবন। কড়া শাসনের ফাঁক গলে ফাঁকি দেওয়ার জীবন থেকে এসে পড়লাম শাসনহীন ও নিয়মহীন আবাসিক জীবনে। স্বাদ ও অভিজ্ঞতা, দুইই আলাদা।
বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশনে এক এক ব্যাচের ছাত্র এক একটি হস্টেলে। সেখানকার ভাষায়, বিভিন্ন ‘ভবন’-এ। সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ অপেক্ষাকৃত কম। অনুষ্ঠান বা খেলার মাঠ বাদে সিনিয়রদের সঙ্গে কথাবার্তা সীমিত।
বাঁকুড়ায় আবার জীবন সিনিয়রময়। অনিন্দ্যদার কথা আগেই অনেকবার বলেছি, তাছাড়া সুদীপ্তদা তৃণাঞ্জনদা পার্থদা… কাকে ছেড়ে কার গল্প করি!!
কিন্তু সবার মধ্যে আলাদা করে দুজনের নাম বলতেই হয়। তমোজিৎদা আর বিদ্যুৎদা। আমাদের সময় যারা থার্ড ইয়ার, তাদের তেমন পড়াশোনার চাপ থাকত না। কেননা তারা সদ্য ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা পাস করেছে, যাকে বলে ফ্রি ব্যাচ। কাজেই তাদের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারের বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি হতে পারত। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকি, তখন তমোজিৎদা বিদ্যুৎদারা থার্ড ইয়ার। খুবই দ্রুত এরা দুজন আমার ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড হয়ে গেল।
মেডিকেল জীবনটা কীরকম করে কাটানো উচিত, এ বিষয়ে এই দুজন আমাকে অসামান্য কিছু শিক্ষা দিয়েছিল।
যেমন ধরুন, একেবারে শুরুর দিক। একদিন সকালবেলা রেডি হয়েছি ক্লাসে যাব বলে। তমোজিৎদা এসে হাজির। এসেই প্রশ্ন, কোথাও যাচ্ছিস নাকি? ক্লাসে যাব শুনেই বিদ্যুৎদাকে ডেকে আনল – শুনেছিস, বিষাণ নাকি সকালবেলা অ্যানাটমি ক্লাসে যাবে!! বিদ্যুৎদা তো কথাটা শুনে এমন স্তম্ভিত হয়ে গেল যে দেখে নিজেরই লজ্জা হলো। তারপর আর কী! জমিয়ে আড্ডা… দিনকয়েক এরকম ঘটার পর সকালবেলা রেডি হওয়ার চেষ্টাটাই ছেড়ে দিলাম।
অনেকসময় আবার এমন কিছু ক্লাস থাকত যে যেতেই হতো। যেমন ডি.নাগ স্যারের বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস। বেরোনোর সময় হয়ত দেখতাম, তমোজিৎদাও সেদিন ওয়ার্ডে যাবে – ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে – সকাল সকাল স্নান করার উদ্দেশ্যে রুম থেকে গামছা পরে বেরিয়েছে। তমোজিৎদার রুম থেকে বাথরুমের মধ্যে গোটাছয়েক রুম পড়ে। দুপুরে ফিরে দেখলাম, তমোজিৎদা তখনও বাথরুম অব্দি পৌঁছাতে পারেনি। বিভিন্ন ঘরে স্টপ দিতে দিতে…
ফার্স্ট এমবি-র ফার্স্ট সেমেস্টার পরীক্ষা। মেডিকেল জীবনের প্রথম পরীক্ষা। আগের সন্ধেবেলায় তমোজিৎদা বিদ্যুৎদা হাজির। কী রে? টেনশন হচ্ছে? প্রস্তুতি থাকুক বা না থাকুক, পরীক্ষার ব্যাপারে আমি চিরকালই অকুতোভয়। বললাম, নাহ্, টেনশন হচ্ছে না… কিন্তু সেকথা শুনছে কে! একগাল হাসি নিয়ে তমোজিৎদা বলল, তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে টেনশন করছিস…
অতএব, নাইট শো-তে লাওয়ারিস দেখতে যাওয়া হলো। সাত-আটজন মিলে। সেই সিনেমা হল – বিশ্বকর্মা – বাঁকুড়া থেকে বাইরে। হস্টেল থেকে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার দূরে। নাইট শো শেষ হওয়ার পর হেঁটে ফিরতে হলো। হস্টেলে যখন পৌঁছালাম, রাত্তির তখন প্রায় দেড়টা।
ওই সেমেস্টার পরীক্ষাতেই ফিজিওলজি পরীক্ষার আগে বিদ্যুৎদা একটা অসাধারণ অ্যাডভাইস দিয়েছিল। যথারীতি কিছুই পড়িনি, ক্লাসটাসও করিনি। বেশ লেজেগোবরে দশা। বিদ্যুৎদা বলল, আরে, শুধু এরিথ্রোপয়েসিস (অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা তৈরির ধাপ) পড়ে যা, ওটাই আসবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলাম, আর যদি না আসে? একগাল হেসে বিদ্যুৎদা বলল, তাহলেও তুই এরিথ্রোপয়েসিস লিখে আসবি। কেননা, ওটা যদি না আসে, তাহলে তো তুই কিছুই লিখতে পারবি না। ম্যাডাম ভাববেন, তুই কিছুই পড়িসনি। কিন্তু এরিথ্রোপয়েসিস লিখে এলে ম্যাডাম জানবেন, পরীক্ষায় যেটা এসেছে, সেই উত্তরটা না জানলেও তুই অন্তত এরিথ্রোপয়েসিস-টা পড়ে গেছিস। অলৌকিকভাবে এরিথ্রোপয়েসিস-ই এসেছিল, কিন্তু না এলেও সেটাই লিখে আসতে পারতাম কিনা, এখনও ঠিক বুঝতে পারি না।
এমন সব দাদাদের সুযোগ্য গাইডেন্সে পড়াশোনা করার সুবাদে ডাক্তারি জ্ঞানে কিছু খামতি থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমার ক্ষেত্রে ভরপুর ঘাটতি ছিল।
অ্যানাটমি ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাত্তিরে, ‘বডি দেখা’ একটা বড় ব্যাপার। সিনিয়র দাদারা, অর্থাৎ ঠিক আগের ব্যাচের সিনিয়ররা, শেষবারের মতো প্রস্তুতি ঝালাই করিয়ে দেয়। সেই বডি দেখতে গিয়ে – অর্থাৎ শব-ব্যবচ্ছেদ – সুপেক্স-এর (অর্থাৎ কাঁধ থেকে হাত অবধি) ডিসেকশন দেখার সময় আমি যখন নীরাজনদাকে বললাম, একটু আস্তে আস্তে শুধু নামগুলো বলো, আমি এগুলো প্রথমবার দেখছি, অনেক নাম প্রথমবার শুনছি – বেশ মনে পড়ে, নীরাজনদাই কেমন একটা নার্ভাস হয়ে গেছিল। উলটে আমিই সান্ত্বনা দিলাম, টেনশন কোরোনা, থেমে থেমে বলো, আমি ঠিক মনে রেখে দেব। দিয়েওছিলাম।
তো মোদ্দা কথাটা হলো, ডাক্তারি শিক্ষায় খানিক খামতি রয়ে গিয়েছে অবশ্যই – যদিও পরীক্ষায় মার্কস, চিরকালই, ভালো পেয়ে এসেছি – কী করে, সেটা আমিই বুঝতে পারিনি – কিন্তু জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলিখানা স্নেহ-ভালোবাসা-বন্ধুত্বে উপচে পড়েছে। আরও একবার যদি পড়াশোনা শুরু করতে হয়, তাহলে আবারও এই জীবনটাই বাছব।
তার চাইতেও বেশি করে যেটা বলার, এমন আশ্চর্য হস্টেল-জীবনে নিঃসঙ্গতা একাকিত্ব স্ট্রেস এসব শব্দগুলো জাস্ট মাথাতেই আসেনি। আসার সময় বা সুযোগ, কোনোটাই ঘটেনি।
আজকাল বেশ ঘন ঘন ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার খবর পাই। পড়ার নাকি খুব চাপ। পড়ার কারণে, পরীক্ষার কারণে – স্ট্রেস। মানসিক চাপ। সেই চাপের খবর, অনেকসময়ই, বন্ধুরা জানতে পারে না। সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের সম্পর্ক আজকাল কতখানি ঘনিষ্ঠ, সেও জানি না। কাজেই, তাদের পক্ষে জানার সম্ভাবনা কতখানি, সেও জানি না। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে গুরুত্ব দেবার পাশাপাশি বন্ধুত্ব আর হইহইয়ের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হোক।
এমবিবিএস পড়া শেষ করে বাঁকুড়া ছাড়ার এক দশক বাদে যখন সেই হাসপাতালেই ফিরলাম – এবার শিক্ষক হিসেবে – তখন বিভিন্ন পরিবর্তন দেখে খুবই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। ক্যান্টিন ফাঁকা। হস্টেলের সামনের বেঞ্চগুলোতেও কেউ বসে নেই। আমাদের সময় হস্টেলে নিজের একখানা সাইকেল থাকার কথাও ভাবতে পারতাম না, এখন অনেকেরই নিজস্ব বাইক রয়েছে। আমাদের হাউসস্টাফ ছেলেটির সঙ্গে এটাসেটা কথা বলতে বলতে বুঝলাম, স্মার্টফোন নিয়েই দিনের অনেকখানি সময় কাটায় সবাই। হইহই করে সিনেমা দেখতে যায় না কেউ – মোবাইল আর টরেন্ট তো আছেই – নেহাত খুব ইচ্ছে করলে কেউ কেউ বাইক নিয়ে সিনেমা দেখতে দুর্গাপুর চলে যায়।
বুঝলাম, বুড়ো হচ্ছি। খুবই বিরক্তিকরভাবে, বুঝলি তো, আমাদের সময়… সে একটা সময় ছিল বটে.. টাইপের কথাবার্তায় অভ্যস্ত হচ্ছি…
সেই আমাদের-সময়টা-দারুণ-ছিল মানসিকতা কাটিয়ে উঠেই বলি, পড়াশোনা পরীক্ষা পরীক্ষার মার্কস ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এমবিবিএস-এর এই পাঁচটা বছর একটা আশ্চর্য সময়। পরিণত চিকিৎসক-জীবনে বসে, ফিরে দেখতে গিয়ে যদি মনে হয়, এমন ম্যাজিকাল বছরগুলো স্রেফ পড়াশোনা করে ‘নষ্ট’ করেছি, তার চাইতে আক্ষেপের কথা আর কী-ই বা হতে পারে!
যুক্তি দিয়ে প্রমাণ হয়ত করতে পারব না, তবু বলি – কে জানে, হইহই করার ফাঁকে একটু একটু করে পড়লে, পড়াটা, সম্ভবত, বেশি মনে থাকে। আর তাছাড়া, বেশ কিছু সহপাঠীদের দেখে বুঝেছি, বইয়ে মুখ গুঁজে সারাদিন বসে থাকলেও যে পড়া মনে না থাকার, সেটা তো এমনিতেও মনে থাকবে না, অমনিতেও না। অন্তত হইহইটুকু করা গেলে, সে স্মৃতির রেশ সারাজীবন রয়ে যাবে।