‘শূন্যের মাঝে অমৃতকলস’ নামের এক বই পড়া সদ্য শেষ হল। হাতে এসেছিল কয়েকদিন আগে। এতদিন আমার গিন্নির দখলে ছিল। আমি মাত্র গতকালই নিজের দখলে পেলাম তাকে। সত্যিই অমৃত কলস। এই যে চারপাশে বয়ে যাওয়া জীবন, যেন পলকাটা হিরের মত। লেখিকা Rupa Sengupta অনবদ্য সুললিত গদ্যে প্রতিফলিত করেছেন তাঁর আশৈশব দেখা শ্রীরামপুরের কলোনি জীবনকে।
সেই অর্থে বললে তিনি হচ্ছেন দেশত্যাগীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের।
রূপা লিখেছেন, প্রথম প্রজন্মের টিকে থাকার লড়াই। দ্বিতীয় প্রজন্মের সেই লড়াইয়ের শরিক হয়ে বড় হওয়ার গল্প। তাদের প্রতিষ্ঠিত বা অপ্রতিষ্ঠিত হওয়া। খাদ্য খাবার, শিক্ষা-সংস্কৃতির খুঁটিনাটি খবরের খোঁজ। কলোনিজীবনের দৈনন্দিন ঘাত, প্রতিঘাত, অতিথি, অভ্যাগত। স্তরে স্তরে গড়িয়ে চলা রাজনীতি। চরকা থেকে রেডবুকে যা গড়িয়ে গেছে, গড়িয়ে গেছে নেতাজি-মুগ্ধতা থেকে গান্ধী-বিরূপতায়। এই এত সবের ঝিলিক এসেছে, হিরের ঝলকেরই মত। অনেকটাই লেখিকার নিজস্ব স্মৃতিভাণ্ডার থেকে আর বাকিটা বড়দের কাছ থেকে শুনে।
সত্যিই অমৃতের স্বাদ পেলাম যেন! এই অমৃতের স্বাদ সবাইই পাক, ‘গাঙচিল’ প্রকাশিত এই ‘শূন্যের মাঝে অমৃতকলস’ বইয়ে।
এই যে কলোনি যার একটা বড় অংশ জবরদখল কলোনি, তা নিয়ে আমারও কিছু বলার আছে।
★
জবর-দখল কথাটা ভাবতে গেলেই জবর কথাটার মানে কী, এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঝিলিক মারে।
‘মা তোমার বুদ্ধি তো জবর’
মনীশ ঘটকের ‘কুড়ানি’ কবিতাটার এই লাইন সকাল থেকে মাথায় ঘুরছে।
ভালো কথা, সেই কবিতাটা একবার পড়বেন নাকি, আবারও?
★
কুড়ানি
– মনীশ ঘটক
স্ফীত নাসারন্ধ্র. দু’টি ঠোঁট ফোলে রোষে,
নয়নে আগুন জ্বলে। তর্জিলা আক্রোশে
অষ্টমবর্ষীয়া গৌরী ঘাড় বাঁকাইয়া,
“খট্টাইশ, বান্দর, তরে করুম না বিয়া।”
এর চেয়ে মর্মান্তিক গুরুদন্ডভার
সেদিন অতীত ছিলো ধ্যানধারণার।
কুড়ানি তাহার নাম, দু’চোখ ডাগর
এলোকেশ মুঠে ধরি, দিলাম থাপড়।
রহিল উদ্গত অশ্রু স্থির অচঞ্চল,
পড়িল না এক ফোঁটা। বাজাইয়া মল
যায় চলি; স্বগত; সক্ষোভে কহিলাম
“যা গিয়া! একাই খামু জাম, সব্রি-আম।”
গলিতাশ্রু হাস্যমুখী কহে হাত ধরি,
“তরে বুঝি কই নাই? আমিও বান্দরী!”
২
পঞ্চদশী গৌরী আজ, দিঠিতে তাহার
নেমেছে বিদ্যুত্গর্ভ মেঘের সম্ভার।
অনভ্যস্ত সমুদ্ধত লাবণি প্রকাশে
বিপর্যস্তদেহা তন্বী; অধরোষ্ঠ পাশে
রহস্যে কৌতুকে মেশা হাসির আবীর
সুদূর করেছে তারে — করেছে নিবিড়!
সান্নিধ্য, সুদুর্লভ, তবুও সদাই
এ-ছুতা ও-ছুতা করি বিক্ষোভ মেটাই।
গাছের ডালেতে মাখি কাঁঠালের আঠা।
কখনো সখনো ধরি শালিক টিয়াটা।
কুড়ানিকে দিতে গেলে করে প্রত্যাখ্যান
“আমি কি অহনো আছি কচি পোলাপান।”
অভিমানে ভরে বুক। পারি না কসাতে
সেদিনের মতো চড়, অথবা শাসাতে।।
৩
ছুটিতে ফিরিলে দেশে কুড়ানি-জননী
আশীর্বাদ বরষিয়া কন — “শোন মণি,
কুড়ানি উন্নিশে পরে, আর রাহি কত?
হইয়া উঠতেয়াছে মাইয়া পাহাড় পর্বত।”
“সুপাত্র দেহুম” — কহি দিলাম আশ্বাস
চোরাচোখে মিলিল না দরশ আভাস।
ম্লানমুখে, নতশির, ফিরি ভাঙা বুকে,
হঠাৎ শুনিনু হাসি। তীক্ষন সকৌতুকে
কে কহিছে—“মা তোমার বুদ্ধি তো জবর!
নিজের বৌয়ের লাইগা কে বিসরায় বর?”
সহসা থামিয়া গেল সৌর আবর্তন,
সহসা সহস্র পক্ষী তুলিল গুঞ্জন!
সহসা দক্ষিণা বায়ু শাখা দুলাইয়া
সব কটি চাঁপাফুল দিল ফুটাইয়া।।
★
দেখুন কাণ্ড। কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। কথা তো হচ্ছিল, জবরদখল কলোনির ওই ‘জবর’ কথাটা নিয়ে! জবর কথাটার অর্থ নিয়ে যে দ্বিধা তা নিয়ে।
কেন দ্বিধা? খুলে বলি।
টিভিতে দেখলাম কারা যেন রাজনীতিতে জবরদস্ত টক্কর দিয়েছে অন্য কাদের। আর তারপরই অন্য এক মাধ্যমে ব্যক্তিগত নির্দেশ এল আমার খুব কাছের এক প্রিয়জনের,- চারপাশের এই জবরদস্তির পলিটিক্স নিয়ে ফেসবুকে তোমার একটা কথাও যেন না শুনি।
আচ্ছা, স্নেহমাখানো এই নির্দেশের জবরদস্তির মধ্যেও মাখানো আছে যে দুরন্ত ভালোবাসা, সেটা বুঝব না? আমি কি তত নির্বোধ এক অমানুষ? আমাকে কী ভাবেন আপনারা?
এই সব নানান ভাবনার মধ্যে ‘জবর’ কথাটা মাথায় ঢুকে পড়ল। আদতে বিদেশি এই শব্দটার মধ্যে কত যে শেড লুকিয়ে আছে।
এবার আসল কথায় ঢুকি। এই বাংলার নতুন ইহুদিদের কথা। যাঁরা বহুবার বহু দফায় সীমান্ত পেরিয়ে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছেন। বিভিন্ন সময়ে। স্রেফ প্রাণধারণের তাড়নায়। এসেছেন সাতচল্লিশে পঁয়ষট্টিতে একাত্তরে আরও বিভিন্ন সময়ে। কখনও বা দেশ ভেঙেছে। কখনও মসজিদ বা মন্দির। আর প্রত্যেকবার তাড়া খেয়ে, তারা এসেছে। প্রাণভয়ে সীমানা পার হয়ে কাতারে কাতারে পুরুষ ও নারী এসেছে।
অতীতে বহুবার দুঃখ আর গর্বের সঙ্গে বলেছি আমি বাঙাল। শুধু বাঙাল না, কাঠ বাঙাল।
সেই অর্থে কিন্তু নয়। না, এমন কী আমার মা ও ওদেশ দেখেননি। তবু পাঠক বাবু-বিবিদের জানাই বহিরাগত এই আমরা, ‘পূর্ব’বঙ্গের লাঞ্ছনার ইতিহাস সমেত এই ‘পশ্চিম’বঙ্গের ভার বাড়িয়েছি। মজার কথা, আজ যে বা যাঁরাই বহিরাগতদের নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁরাও বহুলাংশে আমার মত, এই দেশে, কী বলে ওই বহিরাগতই।
বাবা মা মুর্শিদাবাদে থাকতেন। সেই সময় স্থানীয় মানুষ কেউ কেউ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতেন, ‘ও আপনারা পাকিস্তানি?’
কচুরিপানার সঙ্গে অন্য বৃক্ষ-গুল্মের তফাত কী বলুন তো? বহু তফাতের মধ্যে সব চেয়ে বড় তফাতখানি হল, কচুরিপানার শেকড় আছে কিন্তু শেকড়ের পায়ের তলায় মাটি নেই। তাই সে সারাজীবন ভাসমান। হয় তো বা মাটি খোঁজে সেই দুঃখী শেকড়। অনেকেই পায় না। আমাদের পরিবারেরও ইতিহাস তাইই।
কিন্তু বাঙালদের এক বড় অংশ, তার মধ্যে আমার নিকটাত্মীয়রাও আছে, যারা প্রাণভয়ে কিম্বা আক্ষরিক অর্থে বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে এসেও কচুরিপানা হয়ে থাকতে চায়নি। তারা উৎপাটিত শেকড়ের জন্য মাটি খুঁজেছে।
অবধারিত ভাবে মরে যাওয়াই যে বহিরাগতদের উচিত ছিল অথবা বলা চলে ভবিতব্য ছিল, তারা জবরদস্ত এক বাঁচার প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় জবরদস্তি করেছে। তাদের কুপার্স ক্যাম্পে, দণ্ডকারণ্যের মানা ক্যাম্পে, আন্দামানে আরও কোথায় কোথায় না পাঠানো হয়েছে। এই বাংলার কোণায়কানায়। মেয়েরা আব্রু খুইয়েছে। ছেলেরা অসামাজিক কাজে জড়িয়েছে। তবু জবর খবর হল তারা পায়ের নীচে মাটি খুঁজেছে। সেইরকম ভাবে ভাবলে পেয়েওছে। আমার সেই বহিরাগত পূর্বপুরুষদের সাহসী একাংশ তথাকথিত শান্তিময় এই বাংলার বহু আনাচে কানাচে তৈরি করেছে জবরদখল কলোনি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, বেআইনি জবরদখল। জমিদারের জমি, সরকারের খাস জমি। ওপার থেকে আসা সবাই সাহসী ছিল না। সেই ভীতুরা পারেনি। হয় তো বা সুযোগও পায়নি। যেমন আমাদের পরিবার। কিন্তু হাড়-হাতিয়ার কিছু মানুষ পেরেছিল। আজকের বাঘা যতীন, নেতাজিনগর, বেলঘরিয়া, শ্রীরামপুর, বারাসত, দত্তপুকুর, হাবরা অশোকনগর আরও কত জায়গায় যে রয়েছে, সেই সব জেদ করে মনের জোরে এবং কখনও বা গায়ের জোরে দখল করা কলোনিগুলো।
এদের কতকগুলি বিপুল আভিজাত্য অর্জন করেছে কলকাতার গা ঘেঁষে থাকার ভৌগোলিক কারণে। নেতাজিনগর, বিজয়গড়, যাদবপুর, দমদম এমনকি বেলঘরিয়া খড়দার কিছু কলোনি এখন বহুতলগ্রাসে। সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পে বাজার-হাট-মলে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাল্লা দিচ্ছে সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে এদেশে আসা বালিগঞ্জ, এলগিন রোড, আলিপুরের সম্পন্ন বাঙালদের সাথে।
এই দ্বিতীয়োক্ত সম্পন্ন বাঙালেরা স্পষ্টতই ‘বহিরাগত’ নন। তাঁরা আগমার্কা আইনি অভিবাসী। তাঁদের রাত জেগে, কাদাতে পা গেঁথে জমিদারের লেঠেল আর রাষ্ট্রীয় ঠ্যাঙারেদের ঠেকাতে হয়নি। তাঁদের ছেলে মেয়েরা প্রথম থেকেই কনভেন্টে পড়েছে। সংস্কৃতির সুতীব্র আলো ছিল তাঁদের চত্বরে। হাতে ছিল বিলেত যাবার টিকিটও।
আমি বলছিলাম জবরদখল কলোনি তৈরি করা বাঙালদের কথা। তাদের প্রথম প্রজন্ম জেদের বশে গোঁয়ার্তুমি করে দখল করা জমি পাহারা দিয়েছে, প্রাইমারি স্কুল বানিয়েছে, মদ চোলাই করেছে, বেশ্যা হয়েছে, ওয়াগনব্রেকার হয়ে গুলি খেয়েছে, স্কুলে কলেজে ভালো রেজাল্ট করে গেছে অফিস কাছারিতে ইস্কুলে কলেজে হাসপাতালে। কেউ তারা বিলেত আমেরিকাও গেছে। এখন তাদের চতুর্থ প্রজন্ম মিশে গেছে এই দেশের ইতিহাসে। তারা আর জবরদখলকারী নয়। কিন্তু বাংলাময় ছড়িয়ে থাকা লেনিননগর, সুকান্ত কলোনি, আরও কত নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই জবরদখলের ঘাম রক্ত আর চোখের জলের ইতিহাস।
আমার পরিবার ওদেশ থেকে আসার পর মাটি খোঁজার এই জবরদখল অভিযানে সামিল হতে পারেনি সাহসের আর সুযোগের অভাবে। আগেই বলেছি।
বাবু-বিবিদের জানাই, অন্যতর জবরদখলও তো হয়। হয় না? সম্পর্কে, ভালোবাসায়, আর যাপনে। সেই রকম জবরদখলে জড়িয়েছে এক বাঙাল। সে আপনারা আমাকে বাঙাল এমনকি বহিরাগত বলেও যত ঠাট্টা গালমন্দ করুন না কেন।
আমার আত্মীয় সেই নির্লজ্জ বেআইনি জবরদখল কলোনি বানানো লোকগুলোর মত রাত জেগে আমিও পাহারা দিই রোজ।
আমার ব্যক্তিগত জবরদখল কলোনিটুকুকে।