‘আমার সন্তান যে থাকে দুধে ভাতে’—বাঙালি মায়ের এই আকুতি কখনও প্রকাশ পেয়েছে কাআব্যে-সাহিত্যে, কখনও দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনে, আক্ষেপ আর অনুযোগের ভাষায়—‘এই পরীক্ষার আগের কয়েকটা মাস যদি ছেলেটাকে অন্তত সকাল—বিকেল দুটো গ্লাস দুধ দিতে পারতাম…।
দুধের প্রতি আমাদের অনুরাগ বড়ো প্রাচীন, বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের শরীর-স্বাস্থ্য গড়ে না ওঠার পেছনে, অঙ্কে যথেষ্ট নম্বর না পাওয়ার পেছনে, দুধ না-খাওয়া বা না খাওয়াতে পারাটা একটা গুরুত্বপুর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত বাঙালি মা-বাবাদের কাছে। দুধের প্রতি আমাদের এই ‘শ্রদ্ধাভক্তি’ কি যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত? দুধ কি এতটাই জরুরি? এটা কি অপরিহার্য একটি খাদ্য-সামগ্রী?
আমাদের দেশে দুধের অভাবটা বহুদিনের, তাই হয়তো এর প্রতি আকর্ষন্টা এত বেশি। অবশ্য খাদ্য হিসেবে দুধের কিছু বাড়তি গুণাগুণ রয়েছে—তুলনায় অন্য যে কোনো খাবারের থাকে। যেমন দুধে মোটামুটি ভাবে ছ’মাসের কম্বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদান মজুত রয়েছে। দুধে রয়েছে প্রোটিন, ফাট ও কার্বোহাইড্রেট ৯শর্করা); রয়েছে কিছু ভিটামিন ও খনিজ (মিনারেল)। দুধের প্রোটিনের একটি বাড়তি সুবিধা হলো শিশুদের হজমের ক্ষেত্রে এটি সহায়ক। যেহেতু এতে মোটসামুটি সব ধরণের প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে তাই একে বলা হয় পুর্ণাঙ্গ খাবার বা কমপ্লিট ফুড। তবে এটি বাড়ন্ত বাচ্চা বা বয়ষ্কদের ‘পুর্ণাঙ্গ’ বা কমপ্লিট খাবার নয়। শুধু দুধ খেয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় না বা শরীইরের পরিপুর্ণ পুষ্টির জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে পাঁচ-ছ মাসের পর থেকেই বিভিন্ন ধরণের শক্ত খাবার দেওয়া শুরু করা হয়। এবং মোটামুটি এক থেকে দেড় বছর বয়সের মধ্যে তাকে একজন পুর্ণবয়স্ক ব্যক্তি যে ধরণের খাবার খায় তাতে অভ্যস্ত করে তোলাটাই হলো বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া। এটা না করে শুধু দুধ খাইয়ে গেলে বাচ্চাদের পুষ্টী এবং শরীর ও হাড়ের গঠন ঠিকমতো হয় না। মনে রাখা দরকার দুধে যথেষ্ট লোহা ও ভিটামিন-সি নেই। আমাদের শরীরের সঠিক পুষ্টির জন্য প্রয়োজন কতগুলি উপাদানের। মূল উপাদানগুলি হলো—প্রোটিন (আমিষ), ফ্যাট (চর্বি), ও কার্বোহাইড্রেট (শর্করা), যার থেকে আমাদের শরীর তার প্রয়োজনীয় তাপ ও শক্তি গ্রহণ করে। এ-ছাড়া প্রয়োজন কিছু ভিটামিন ও খনিজের। এগুলি খুব অল্পমাত্রায় প্রয়োজন হয়। আর আমাদের শরীর এর সমস্ত কিছুই আহরণ করেবিভিন্ন ধরণের খাদ্যদ্রব্য থেকে। কোনো একটি বিশেষ খাদ্যে এই সবই সঠিক অনুপাতে থাকে না, একজন সক্ষম পুর্ণবয়স্ক মানুষ সাধারণ ভাবে বিভিন্ন ধরণের খাবার খেয়ে থাকে, আর এইসব খাদ্যের সংমিশ্রণ থেকেই প্রয়োজনীয় সব উপাদান আমরা পেয়ে যাই। ভাত, ডাল, শাকসবজি খেলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান মিলে যাবে। ধরা যাক প্রোটিনের কথা; প্রোটিন শুধু দুধে নয়, ডাল, গম, শাকসবজি, বাদাম, ডিম, মাছ-মাংসেও রয়েছে এবং উৎকর্ষের নিরিখে ডিম বা মাছের প্রোটীন দুধের থেকে উন্নতমানের এবং পরিমাণেও অনেক বেশি।
যদিও দুধের প্রোটিন চাল বা ডালের প্রোটিনের থেকে উৎকৃষ্ট, কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে এতে প্রোটিন অনেক কমই থাকে। কিছু কিছু খাদ্যের প্রোটিনে সব ধরণের অ্যামাইনো অ্যাসিড (প্রোটিন ভেঙে এটা তৈরি হয়) থাকে না। কিন্তু ধরা যাক চাল ও ডালের কথা। দু;টোতেই কিছু কিছু প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের ঘাটতি রয়েছে,
খাদ্যদ্রব্য
প্রোটিনের পরিমাণ জৈবিক মান (BV) প্রোটিন আত্মীকরণের হার (NPU)
(শতাংশে) (শতাংশে) (শতাংশে)
গোরুর দুধ ৩.২ ৮৫ ৮১
ডিম ১৩.৩ ৯৮ ৯৬
মাছ ১৮-২১.৫ ৮০ ৭৭
মুগ ডাল ২৪.৫ ৬২ ৫২
চাল ৮.৫ ৭০ ৬৫
বাদাম ২৬.৭ ৫৪ ৫০
কিন্তু দুটো যখন একসঙ্গে খাওয়া যায় তখন একের ঘাটতি অপরে পুষিয়ে দেয়।
এবের যদি ফ্যাট-এর কথায় আসা যায় তবে দেখা যাবে, দুধে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ; বাদাম ইত্যাদিতে এর কয়েকগুণ বেশি রয়েছে। তাছাড়া আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো দুধ থেকে তৈরি করা মাখন-ঘি ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড-এর পরিমাণ অনেক কম, যা অনেক বেশি মাত্রায় উদ্ভিজ্জ তেলে পাওয়া সম্ভব (পাম তেল, বাদাম তেল, সর্ষের তেল ইত্যাদি)।
ভিটামিন প্রায় সব খাদ্যদ্রব্যেই কিছু না কিছু ছড়িয়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে দুধের কোনো বিশেষত্ব নেই, আর খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অনেকে অবশ্য দুধের ‘ক্যালসিয়াম’ নিয়ে গদ্গদ হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত বলে নিই চাল, ডালেও ক্যালসিয়াম রয়েছে, রয়েছে আরও বহু খাদ্যদ্রব্যে। সাধারণের মনে এর ‘অভাববোধ’ হরেক কায়দায় সৃষ্টি করা হয় এবং ক্যালসিয়াম টনিক/ট্যাব্লেটের বাজারও তাই বাড়বাড়ন্ত। সম্প্রতি বিজ্ঞাপনে মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হরলিকস বাজারে এসে গেছে। কি কি খাদ্যবস্তু খাওয়া দরকার তা ঠিক করা হয় সুষম খাদ্যের চিন্তা-ভাবনা থেকে কারণ এটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সুষোম খাদ্য নানান ধরণের খাদ্যদ্রব্যের সমাহারে তোইরি হয়। এটা ঠিকই স্বাভাবিক ভাবে আমাদের খাবার-দাবারের চল তৈরি হয় একজনের রুচি, মানসিকতা এবং সেই ব্যক্তির বাসস্থানের উপর যা সেই অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যগুলির উপর ভিত্তি করে খাদ্যাভাস গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ভাবেই এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অঞ্চলে—যা সেখাঙ্কার কৃষি ব্যবস্থা ও সংস্কৃত অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ওপর থেকে তা চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতাটাই অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু আমাদের দুর্বলতা ও অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়েই কখনও প্রোটিন, কখনও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বা টনিকের ফলাও কারবার ফাঁদে ধুরদ্ধর ব্যবসায়ীরা। কারও দুধ খেতে ভালো লাগ্লে তিনি অবশ্যই তা খেতে পারেন।কিন্তু এটি একটি ‘পূর্ণাঙ্গ’ খাদ্য, এই যুক্তির জোরে তাকে দুধে আসক্ত করাটা আদৌ যৌক্তিক বলা চলে না। বর্তমান জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে পড়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ তার রুচি ও সেই অঞ্চলের প্রচলিত খাদ্যাভাস ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি অপবিজ্ঞানের ঢালাও প্রসার ঘটাচ্ছে কোম্পানিগুলো। হরেক রকমের ‘তত্ত্বে’-র আমদানি হচ্ছে দেশে-বিদেশে মূলত নতুন বাজার তৈরির তাগিদ থেকে। ক্রেতাকে বিভ্রান্ত ও অসহায় করে তুলে মুনাফার পাহাড় গড়া তখন অনেক সহজ হয়। সাধারণ মানুষ এ সব গাঁজাখুরি গল্পে মজে যান। পূর্ণাঙ্গ বা কমপ্লিট খাবারের প্রতি মোহ সৃষ্টির পেছনেও কাজ করছে সেই একই ব্যাবসায়িক স্বার্থে। সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন এক কূহক।
আমাদের মনে এক অদ্ভুত ধারণা জন্মে গেছে যে, শরীরের প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদানগুলি কোনো একটি বিশেষ খাদ্য থেকে নিতে হবে। তাই কোন খাদ্যটি তুলনামূলক ভাবে অপরটির থেকে বেশি খাদ্যগুণের অধিকারী তা খুঁজে বার করার চেষ্টা করা হয়। এই ধারণাকে মূলধন করে ধূর্ত ব্যবসায়ীরা হাজির হয়ে পড়েন বাজারে—বড়ো বড়ো হরফে তারা বিজ্ঞাপন দেয়—‘দুধে আছে ১৭ টি, আমাদের এই কৌটোতে রয়েছে ২৩ টি কি ৩৩টি খাদ্যগুণ…’। ‘কমপ্লান’ এমন একটি খাদ্য। এর জনক হলেন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি গ্লাক্সো। এছাড়া আরও বহু কোম্পানি এই বিশ্বাস্কে কাজে লাগিয়ে বাজার মাৎ করছেন। এই সব বহুজাতিক কোম্পানির ব্যাবসার রকমফেরে চমতকারিত্ব রয়েছে। যখন দেখে ওষুধের ব্যাপারে লোকেরা একটু সজাগ হয়ে পড়েছে বা যখন ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে সোরগোল উঠেছে বিশ্বজুড়ে তখন তারা তা আঁচ করে, শুরু করে হয়তো ‘বেবিফুড’ বা শিশু খসদ্য তৈরি করতে, ফলাও কারবার ফাঁদে মিথ্যে প্রচার চালিয়ে। বুকের দুধ বন্ধ করে মায়েরা তখন ছোটেন এই সব টিনের দুধ কেনার জন্য। কেঊ হয়তো নেমে পড়েন প্রোটিন্সমৃদ্ধ খাবার তৈরি করতে। বাজারে চলে আসে ফাইজারের ( একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি) ‘প্রোটিনেক্স’। ‘প্রোটিন’ খাওয়ানোর হিড়িক পড়ে যায় ঘরে ঘরে। গ্লাস্কো-র প্রচার অভিযানে আর একটু বেশি অভিনবত্ব রয়েছে। তারা শুধু প্রোটইন’-ই জোগাচ্ছে না, শরীরের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপাদান প্যাক করে দিচ্ছেন কৌটায়—তুলনায় বোঝাচ্ছেন দুধের থেকেও তা কত বেশি গুণে ‘গুণী’। তাই আর দুধের প্রতি দুর্বলতা কেন, কমপ্লান ধরুন, কমপ্লানের ভক্ত হয়ে পড়ুন। আর একটি কথা বেশ বড়ো হরফে কৌটার গায়ে লিখে থাকে তারা—‘দুধে মেশানোর প্রয়োজন নেই’। দুধের প্রতি সাধারণের দুর্বলতাটুকু বেশ ভালো ভাবে ভাঙ্গিয়ে তারা দুধের জায়গায় আনতে চাইছে ‘কমপ্লান’। এদেশের বিশেষত ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলিতে, যেখানে দুধের ঘাটতি সর্বাধিক, সেখানে দুধের বিকল্প কোনো খাদ্যদ্রব্যের প্রতি প্রলোভন সবথেকে যে বেশি কার্যকর হয়, তা ইতিপূর্বে দেখা গেছে। এ কারণেই এই সব অঞ্চলে ‘হরলিকস’ এর সব থেকে বড়ো বাজার। যেখানে দুধের প্রাচুর্য নেই, সেখানে দুধে মিশিয়ে খাওয়ার কোনো খাদ্য সহজে বাজার পাবে না, তা তারা ভালো করেই জানে—আর সঙ্গে যদি এ-ও বলা যায় যে, তা দুধের থেকেও বশি গুণসম্পন্ন তবে তো কথাই নেই। তাদের বিজ্ঞাপনের আর দু’টি শব্দ বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ। বিজ্ঞানসম্মত পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যপানীয়’। আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ শব্দটি ভারে কাটে। আর ওই ‘পূর্ণাঙ্গ’ খাদ্যের প্রতি আমাদের দুর্বলতার কথা তো আগেই বলেছি। দুধ ‘পূর্ণাঙ্গ’ খাদ্য অতএব কমপ্লানকেও যদি ওই ছকে ফেলে দেওয়া যায় তবে বাজারমাতের আরও একটি স্বর্ণ সম্ভাবনা যে ফল্প্রসূ হতে পারে, তা তাদের ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে ঠিকই ধরা পড়েছে।
এবার দেখা যাক, ওই বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যটিতে কি কি বস্তুকণা রয়েছে। এতে রয়েছে প্রোটিন ২০ শতাংশ। বলা হয়েছে, ‘প্রোটিনের সেরা মিল্ক প্রোটিন’। মিল্ক প্রোটিন যে সেরা প্রোটিন, এটি শুধু তাদের বিজ্ঞানেই লেখা রয়েছে। পুষ্টিবিজ্ঞানের কোথাও এটি লেখা নেই (আগেই দেখানো হয়েছে ডিমের প্রোটিন সবার সেরা)। তাদের ওই ২৩ টি উপাদানের মধ্যে রয়েছে ‘চোখ ধাঁধানো’ মিনারেল ক্যালসিয়াম। এতে ভিটামিন-ই এবং ‘কে’ যে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে মেশালো তা জানতে গেলে তাদের তৈরি বিশেষ কোনো এক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের বই ঘাঁটতে হবে। এতে আরও রয়েছে ভিটামিন-ডি। যে দেশের মানুষের পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেয়ে থাকে ( আমাদের চামড়ায় সূর্যালোক পড়লে ভিটামিন-ডি তৈরি হয়) সেখানে আলাদা ভাবে ভিটামিন-ডি শরীরে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে কি? বিশেষত বাচ্চারা যদি খোলা আকাশের নীচে দৌড়ঝাঁপ করে। উলটে অতিরিক্ত ভিটামিন-ডি থেকে নানান ধরণের ক্ষতি—যেমন কিডনীতে পাথর জমা, রক্তে কোলেস্টেরল বাড়া, ক্ষুধা নষ্ট করে দেওয়া ইত্যাদি ঘটাতে পারে। এতে রয়েছে একটি ভিটামিন যৌগ যার ক্যালসিয়াম পেন্টোথেনেট—এই ভিটামিনের অভাবে ভুগতে এ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মানুষ্কে দেখা যায়নি। রয়েছে ভিটামিন বি-১২; এদেশে এর অভাবেও কেঊ ভোগেন বলে জানা যায়নি। বিশেষ জেনেটিক কারণে সাদা চামড়ার লোকেদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যায় এই রোগ দেখা যায়। সেখানেও এই ভিটামিন মুখে খাইয়ে লাভ নেই, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিতে হয়। এছাড়াও এতে রয়েছে ‘কোলিন’। ‘কোলিন’ ব্যবহারের কোনো বাড়তি লাভ নেই এবং এতে মেশানো রয়েছে আয়োডিনও, যা এদেশের মানুষজনের আয়োডাইজড লবণ থেকে শরীরের প্রয়োজনীয় আয়োডিন পেয়ে থাকে। তাই নতুন করে এ দেশের ছেলেমেয়েদের আয়োডিন খাওয়ানোর এই আজব তত্ত্ব কি করে গ্ল্যাস্কো কোম্পানির মাথায় এল তা একমাত্র তারাই বলতে পারবে।
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত আয়োডিন গ্রহণে শরীরে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরেও তারা দাবি করবেন এটি বিজ্ঞানসম্মত! শুধু বিজ্ঞানসম্মত নয় তারা বলছেন এটি একটি ‘সুপরিকল্পিত সম্পুর্ণ আহার’—পরিকল্পনার বলিহারি! আর ‘সম্পুর্ণ আহার’ বলতে কি তারা এই বোঝাতে চাইছেন যে, এটি খেলে আর কিছু খেতে হবে না? অথচ ১০০ গ্রাম কমপ্লান-এ তাদের দেওয়া হিসেব দেখাচ্ছে—আমিষ আছে ১০গ্রাম, চর্বি ১৬ গ্রাম, শর্করা ৫৫ গ্রাম। পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাদ্যদ্রব্যে কী পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে নীচের তালিকায় দেখুন।
খাদ্যদ্রব্য
প্রোটিনের পরিমাণ (%) ১ কিলোর দাম (টা) ১০০ গ্রা প্রোটিনের দাম (টা) ১০০ গ্রা থেকে কিলোক্যালোরি জৈবিক মান
মুগ ডাল ২৪.৫ ৬০ ১১০ ৩.০০ ৩৪৩
ডিম ১৩.৩ ৯৮ ৬.৫০ ১৭৩
বাদাম ২৬.৭ ৫৪ ১২০ ৪.৫০ ৫৬৭
আটা ১২.৭ ৫০ ৩০ ১.৭০ ৩৪১
কমপ্লান ২০.০ ৬০ ৪৬.০০ ৪৫০
আর ওই ১০০ গ্রাম কমপ্লান জোগায় ৪৫০ কিলো ক্যালোরি, অর্থাৎ প্রতি দু’শো গ্রামের কৌটায় পাওয়া যাচ্ছে ৯০০ কিলো ক্যালোরি। আপনার ১৪ বছরের বাচ্চার দৈনিক প্রয়োজন প্রায় ২৫০০ কিলো ক্যালোরি। তার মানে সকাল-বিকাল-রাত্রে দুশো গ্রামের তিঙ্খানি পুরো কৌটো উপুড় করে ঢেলে দিতে হবে আপনার ছেলের মুখে, আর এর জন্য কত খরচ পড়বে তা আপনি হিসেব করে নিতে পারেন। ‘বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের চাই কমপ্লান’ এই প্রচারে গলে গেলে আপনার ভাঁড়ারটিই কার্যত যে বাড়ন্ত হয়ে যাবে এবং বাড়ন্ত বাচ্চার বিশেষ কোনো যে উপকারে আসবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আপনি হয়তো বল্বেন—তা কেন, সকাল-বিকেল মাত্র ২৫ গ্রাম করে ৫০ গ্রাম খাওয়াবেন বাচ্চাকে। এতে অবশ্য একটা মানসিক পরিতৃপ্তি পাবেন এই ভেবে য্র, বাচ্চাকে ‘দামী কিছু’ খাওয়াচ্ছেন। চাই কি এতে আপনার পরিবারের স্ট্যাটাস কিছু বাড়বে, এটাও ধরে নিতে পারেন। এর বেশি কিচ্ছুটি হবে না। এতে সারাদিনে তারা যা পাবে তা হলো ৫ গ্রাম প্রোটিন ও ৮ গ্রাম ফ্যাট এবং ২২৫ কিলো ক্যালোরি। স্রেফ একটা ডিম থেকে প্রায় ওই পরিমাণ প্রোটিন এবং এর প্রায় দেড়্গুণ ফ্যাট পাবেন আপনি। উৎকর্ষের নিরিখে ডিমের প্রোটিন দুধেরও ওপরে তা তো আগেই বলেছি। ১০০ গ্রাম আটার রুটির থেকে এর চেয়েও বেশি প্রোটিন এবং এর প্রায় দেড়্গুণ ক্যালোরি পেয়ে যাবেন। স্রেফ ৫০ গ্রাম বাদাম খাওয়ালে আপনার ছেলে এর থেকে বেশি প্রোটিন, অনেক বেশি ফ্যাট এবং অনেক বেশি ক্যালোরি পেয়ে যাবে এবং তা পাবে অনেক সস্তায়।
আসলে উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচ আর ছয়ের দশকে ইউরোপে জমে ওঠা গুঁড়োদুধ তৃতীয় বিশ্বে চালান করার তাগিদে শুরু হয়েছিল এই ‘প্রোটিন’ সমৃদ্ধ খাবার তৈরির ছক। ইদানীং অবস্থাটা আবার ঘোরালো হয়ে উঠেছে। এত পরিমান দুধ ইউরোপের দেশগুলিতে জমে যাচ্ছে যে, কিছুদিন আগে পশ্চিম জার্মানি সমস্যার সমাধান করতে ২০ লক্ষ দুগ্ধবতী গাই জবাই করেছে—তাতেও খুব একটা সুরাহা হবে না। এখন কি করে ওই গুঁড়ো দুধ কিছু হাবিজাবি এবং রংচং মিশিয়ে নতুন নামে এশিয়া-আফ্রিকার বাজারে চালানো যায় তারই কসরত চলছে। তাই হয়তো নতুন উদ্যমে গ্লাস্কো উঠেপড়ে লেগেছে। টিনে পুরে সেই গুঁড়ো দুধই তারা বেচতে চাইছে নতুন নামে আর কয়েকগুণ দামে—যার নাম কমপ্লান—আর এর জন্য কম প্লান তারা আঁটে নি। আটঘাট বেঁধে এদেশের মানুষদের ধোঁকা দেবার সমস্ত রাস্তাই ব্যবহার করছে তারা এবং অত্যন্ত ‘সুপরিকল্পিত’ ভাবে। মনে রাখবেন, এই সব বরো পকেট্মারদের উদ্দেশ্যে কোনো সাবধান বাণী বাসে কিংবা ট্রামে কোথাও দেখতে পাবেন না—আপনিই একমাত্র লিখে দিতে পারেন ওদের এই সব কৌটোর গায়ে বেশ বড়ো বড়ো হরফে ‘পকেট্মার হইতে সাবধান’। নইলে ঠকবেন আপনি কিংবা আপনার কোনো বন্ধু বা শুভানুধ্যায়ী।