উলুবেড়িয়া মহকুমার গ্রামীণ জনসংখ্যার এক বড় অংশ জরির কাজ করেন। সত্যি বলতে কি এই এলাকার প্রধান অসংগঠিত শিল্প হল জরি-শিল্প। কেবল এই এলাকায়ই নয়, উলুবেড়িয়া মহকুমার জরিশিল্পীরা কাজ করতে যান দিল্লী-বম্বে-গুজরাট-ব্যাঙ্গালো র নানা শহরেই। চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়ায় শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমাদের কাছে যাঁরা রোগী হিসেবে আসেন পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে তাঁদের অনেকেই জরি-শিল্পী।
যে প্রধান সমস্যা নিয়েই তাঁরা ডাক্তারখানায় আসুন না কেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই দেখা যায়—অধিকাংশ ঘাড়ে ব্যথা, কোমর-ব্যথায় ভুগছেন।
SEWA (Self Employed Women’s Association) নামের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুজরাটের এক শহরের মহিলা জরিশিল্পীদের স্বাস্থ্যসমীক্ষা করেছিলেন। বছর কুড়ি আগে আমরা ঠিক করলাম পুরুষ-নারী দুধরনের জরি-শিল্পীদের নিয়েই একটা সমীক্ষা চালাবো।
২০০০-২০০১ সালে যে সব জরি-শিল্পীরা রোগী হিসেবে আমাদের ক্লিনিকগুলোতে আসেন, তাঁদের নেওয়া হয়েছিল এই পাইলট সমীক্ষাতে। আমরা দেখেছিলাম কেবল পুরুষ আর নারী নন, বিশাল সংখ্যক শিশুশ্রমিকও রয়েছে এই শিল্পে।
সমীক্ষায় দেখা গেল—জরি-শ্রমিকদের বাঁচার মতো রোজগার করতে হলে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়। খাটিয়ার মতো দেখতে একটা কাঠের ফ্রেমে কাপড় লাগানো থাকে, তার পাশে বসে ফ্রেমের নীচে পা মেলে বা হাঁটু মুড়ে বসে তাঁদের কাজ করতে হয়। কাজের জায়গার অধিকাংশেই বিদ্যুৎ ছিল না সমীক্ষার সময়, যেখানে ছিলও বা সেখানে কম পাওয়ারের বাল্বের আলোয় কাজ করতে হত। পরিবারের মহিলা-পুরুষ-শিশুরা একসঙ্গে কাজ করলে করেন নিজেদের বাড়ীতেই, যে ঘরে কাজ করেন সেটাই অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের থাকার ও রান্না করার ঘর। অনেক ক্ষেত্রে ওস্তাগর পুরুষ জরি-শিল্পীদের দিয়ে কাজ করায় নিজের জায়গায়, যে জায়গাকে কারখানা বলে। ঘর হোক বা কারখানা—সব মিলিয়ে কাজের পরিবেশ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর।
দেখা গেল তাঁরা ভোগেন ঘাড়ে ব্যথায়, অনেক সময় ব্যথা হাতে নামে, কখনও হাতে ঝিনঝিনি বা অবশভাব থাকে। ব্যথা হয় কোমরে, ব্যথা অনেক সময় পায়ে নামে, পায়ে ঝিনঝিনি বা অবশভাবও থাকে। কবজি ও আঙ্গুলের গাঁটগুলোতে ব্যথা হয়। চোখ দিয়ে জল পড়ে, অনেক ক্ষণ কাজ করার পর চোখ ধোঁয়াটে হয়ে যায়। চালশে চল্লিশ বছর পেরোলে হওয়ার কথা, এঁদের মধ্যে তা দেখা গেল তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই। এই যে সমস্যাগুলো সেগুলোকে বলে repeatitive strain injuries—একই কাজ বার বার করার ফলে হওয়া আঘাত।
এছাড়া আমরা দেখলাম এঁদের শ্বাসতন্ত্রের জীবাণুসংক্রমণ হয় বেশী। দেখা যায় যক্ষ্মা এবং স্ট্রেপ্টোকক্কাস জীবাণু থেকে হওয়া রিউমাটিক জ্বর। তাছাড়া দুর্বলতা, বদহজম, ওজন কমতে থাকা দেখা গেল। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেশী মানুষ একসঙ্গে কাজ করা, দারিদ্রের জন্য অপুষ্টি এবং যথাযথ পানীয় জলের অভাব এই সব সমস্যার কারণ।
জরিশিল্পীদের মানসিক সমস্যার মধ্যে পাওয়া গেল— অনিদ্রা, অবসাদ ও উদ্বেগ। দারিদ্র, কম রোজগার, পুঁজির অভাব, জরির কাজের চাহিদার ওঠানামা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ–এসবই মানসিক সমস্যার কারণ।
বছর পনেরো আগে ভেবেছিলাম জরি-শ্রমিকদের জন্য ব্যাক স্কুল করব—যেখানে তাঁদের মেরুদন্ডের গঠন ও কাজ সহজ করে বোঝানো হবে, শেখানো হবে কিভাবে কাজ করলে পিঠ-কোমরে চোট কম লাগে, পিঠ-কোমর ব্যথায় কি কি ব্যায়াম করতে হয়। ‘ব্যাক স্কুল’ একটা ধারণা—যেসব শিল্পে পিঠ-কোমরে আঘাত লাগার ঝুঁকি বেশী, সেসব শিল্পের শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্য ব্যাক স্কুল। ভেবেছিলাম জরি-শিল্পীদের কাজের ফ্রেম কিভাবে ডিজাইন করলে repeatitive strain injuries কম হয়, তা নিয়ে কাজ করব। লোকাভাবে এসব করা হয়ে ওঠেনি এখনও!