বাংলার এক চিকিৎসক হিসেবে যেটা বড় মুখ করে বলতে পারি, তা হলো – মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে ধারাবাহিকতার দিকটা।
মানে, বেনিয়মের ধারাবাহিকতা।
ধরুন, প্রার্থী-নির্বাচন ও মনোনয়ন পদ্ধতির সময়। আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন, একটি অ্যাড-হক কমিটি তৈরি করতে, যাঁরা নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন এবং নির্বাচন হওয়া অবধি কাউন্সিল কাজকর্মের দেখভাল করবেন। তো সেই অ্যাড-হক কমিটির অধিকাংশ চিকিৎসক নিজেরাই প্রার্থী হয়ে বসলেন। অর্থাৎ, যাঁদের কাজ ছিল নির্বাচনটার বন্দোবস্ত করা, স্বয়ং তাঁরাই প্রার্থী।
তাঁরা প্রার্থী হলেন নিজেদের ‘তৃণমূলপন্থী’ ‘সরকারপন্থী’, এমনকি ‘সরকার-মনোনীত’ প্রার্থী হিসেবে দাবি করে। তাঁদের প্রচার-পুস্তিকায় ছাপানো হলো রাজ্য সরকারের লোগো, এমনকি ন্যাশনাল এমব্লেমও। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। শাস্তিযোগ্য অপরাধও। চেপে ধরতে এক প্রার্থী জানালেন, কাজটা ভুল হয়ে গিয়েছে (সেই স্টেটমেন্ট খবরের কাগজে প্রকাশিত, প্রার্থীর নাম-সহ)।
প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকার কিন্তু একবারও জানাননি, যে, অমুক প্যানেল তাঁদের মনোনীত। এটা একেবারেই গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল কেস।
প্রচারপর্বে সেই প্রার্থীরা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়াম বা লেকচার থিয়েটারে প্রচার করতে থাকলেন। কলেজ আওয়ারে। কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা রীতিমতো নোটিশ জারি করলেন যাতে ছাত্র-অধ্যাপক নির্বিশেষে সকলেই সেই প্রচারসভায় হাজির থাকেন। অনেকক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া হলো, মেডিকেল কাউন্সিলের মিটিং আছে, এই মর্মে। এ যে দলীয় প্রচার, তা চেপে যাওয়া হলো।
কলেজে কলেজে ব্যালট আসতেই শুরু হলো হুমকি প্রলোভন ইত্যাদি। প্রার্থী ও তাঁদের সহচররা ভোট চাইছিলেন না – চাইছিলেন ফাঁকা ব্যালট। কয়েকটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষরা তো নিজেদের ছাপিয়ে গেলেন – যেমন আরজি কর বা রামপুরহাট মেডিকেল কলেজ – তাঁরা ব্যালট অধ্যাপকদের হাতে তুলে দেওয়ামাত্র সেই ব্যালট যাতে অধ্যক্ষের হাতেই জমা পড়ে, তা নিশ্চিত করে ফেললেন।
ব্যালট জমা দেওয়ার সময়ও দেখা গেল, অচিকিৎসক মানুষজন, যাঁদের মধ্যে অনেকে রীতিমতো চিহ্নিত গুণ্ডা, গোছায় গোছায় খাম জমা দিচ্ছেন। আদালতের স্পষ্ট নির্দেশিকা সত্ত্বেও ব্যালটবাক্সের সামনে সিসিটিভি নেই – রিটার্নিং অফিসার মানস চক্রবর্তী মহাশয় এসব ব্যাপারে নির্বিকল্প সমাধি দশায় থাকেন – কাজেই, ঠিক কত হাজার ব্যালট এই পথে জমা পড়েছে, তা অনুমান করা মুশকিল। একদিন হাতেনাতে চোর ধরে দিলে রিটার্নিং অফিসার আমাদের উপরই ভারি বিরক্ত হ’ন, আমরাই নাকি ঝামেলা করছি।
দিনের বেলায় গোছায় গোছায় ব্যালট জমার পথে বাধা পড়ায় রাতের অন্ধকারে মেডিকেল কাউন্সিল অফিসের সামনে যাতায়াত বাড়তে থাকে। খবর পেয়ে আমরা হাজির হই এবং নিজেরাই রাতপাহারা দিতে শুরু করি। আমরা রাতপাহারা শুরু করার আগে কাউন্সিল অফিসে রাতের বেলায় কোনও পুলিশ প্রহরা ছিল না।
গোছায় গোছায় ব্যালট সরাসরি জমা পড়ার পথে বাধা পড়ায় গোছা গোছা ব্যালট আসতে থাকে ক্যুরিয়রের মাধ্যমে। তাতে আইনত বাধা কিছু নেই। কিন্তু ক্যুরিয়র সার্ভিসের ডেলিভারি বয় পরিচয় দিয়ে বেশ কিছু উটকো লোক ব্যালট জমা দিতে আসে। এমন বেশ কয়েকজনকে আমরাই ধরি। শেষ দিন যেমন, ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের প্যাকেটে করে প্রায় পাঁচ-সাতশো ব্যালট জমা করার চেষ্টা হয়। আমাদের বাধাদানে সেটা সম্ভব হয়নি।
এর মধ্যে কয়েক হাজার – অন্তত কুড়ি হাজার – ব্যালট ফেরত আসে কাউন্সিল অফিসে। বিভিন্ন কারণে আনডেলিভার্ড। এই রিটার্ন ব্যালট জমা হয় যে ট্রাঙ্কে, রিটার্নিং অফিসার সেই ট্রাঙ্ক সিল করতে রাজি হন না। আমাদের বারংবার দাবি সত্ত্বেও। এমনকি, ভোটগণনার শুরুতে রিটার্ন ব্যালটের সংখ্যাটা গুণে নেওয়ার দাবিও তিনি উড়িয়ে দেন।
ক্লজ জি-র গণনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, ব্যালটের মধ্যে রঙের তারতম্য। খামের ক্ষেত্রেও। জাল ও ভুয়ো ব্যালট, সম্ভবত। অভিযোগ জানাতেই রিটার্নিং অফিসার আজব যুক্তি দেন – সরস্বতী প্রেসে নাকি কাগজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই কাগজের তারতম্য।
ক্লজ এইচ-এর ভোটগণনার কাজ শুরু হতেই এই রঙের তারতম্যের ঠেলায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। রিটার্নিং অফিসারের অবশ্য সেই ভদ্রলোকের এক কথা – কাগজ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণেই…! ইতিমধ্যে দেখা যায়, কিছু ব্যালটে ডা অর্জুন দাশগুপ্তর নামটিই অনুপস্থিত – পরিবর্তে অন্য নাম দুবার ছাপা। এমনকি রিটার্নিং অফিসারও সেই ব্যালট বাতিল করতে বাধ্য হ’ন। এমন ব্যালটের সংখ্যা কয়েক হাজার।
এই পরিস্থিতিতে আচমকা ‘নিরবচ্ছিন্ন’ ভোটগণনায় জলপানের বিরতি ঘোষিত হয়। ছয় ঘণ্টার বিরতি। প্রার্থী বা কাউন্টিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হলেও কাউন্টিং অফিশিয়ালরা ভেতরেই থাকেন। এবং গণনার সময় বা বিরতি, কোনও সময়ই কোনও সিসিটিভি জাতীয় দেখভালের বন্দোবস্ত থাকে না। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা সত্ত্বেও।
বিরতির পর দেখা যায়, আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের বহু প্যানেল ভোট বাতিল হচ্ছে অন্য রঙের কালি দিয়ে বাড়তি ক্রস চিহ্ন দেওয়ার কারণে।
তারপর আরও একবার ‘নিরবচ্ছিন্ন’ ভোটগণনায় নৈশ বিরতি ঘোষিত হয়।
পরদিন গণনা শুরু হলে দেখা যায়, আমাদের প্যানেল-ভোট ক্যানসেল হওয়ার সংখ্যাটি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। হাজারে হাজারে ব্যালট বাতিল হচ্ছে – আমাদের প্যানেলে ভোটের সঙ্গে অন্য কালি অন্য হস্তাক্ষরে বাড়তি ক্রস চিহ্ন।
আচমকা এমন ক্যানসেল হওয়া একটি চিহ্নিত ব্যালট পুনরায় গণনার টেবিলে এসে পড়ে। স্পষ্ট হয়ে যায়, গোনা হয়ে যাওয়া ভোট আবারও গোনা হচ্ছে।
রিটার্নিং অফিসার আজব যুক্তি দেন। কোনও ডাক্তারবাবুই হয়তো বাড়তি ভোট দিয়ে ফেলে ব্যালট ক্যানসেল হয়ে যাবে জেনে ক্যানসেলড লিখে কাউন্সিলে জমা করেন!!
তো এরকমই চলছে। এমন ধারাবাহিকতা সত্যিই ঈর্ষণীয়।
একাধিক মামলা হতে চলেছে। বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ সহ আমরা আদালতে গিয়েছি। শুনানির তারিখ এই মাসের আঠাশে।
কয়েক হাজার ব্যালটে নিজের নাম অনুপস্থিত কেন, এই নিয়ে বিস্মিত হওয়ার অপরাধে ডা অর্জুন দাশগুপ্তর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন অ্যাড-হক কমিটির চেয়ারম্যান ডা সুদীপ্ত রায়, যিনি আবার এই নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থীও বটেন এবং গোছায় গোছায় ব্যালট জমা দিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়া সমাজবিরোধী মুন্না যাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ডা কুনাল সাহা, নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী (শাসক-পন্থী বা আমাদের, কোনও দিকেরই নন), তিনি সশরীরে ভোটগণনা দেখতে হাজির হলে শাসক-শিবিরের প্রার্থী ও কাউন্টিং এজেন্টরা মিলে তাঁকে ধাক্কাধাক্কি করে বের করে দেন। সে নিয়ে তিনি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন, এবং পুলিশ এফআইআর গ্রহণ করেছে বলেই খবর।
অতএব…
সত্যিই, মেডিকেল কাউন্সিলের ইতিহাসে এমন নির্বাচন – যাকে বলে, গণতন্ত্রের এমন উৎসব – বাংলার চিকিৎসকরা আগে দেখেননি।
সিরিয়াসলি, এমন নির্বাচনের সাক্ষী থাকতে পেরেও সুখ। এ স্বাদের ভাগ হবে না।