#বিবর্তন #মানব_বিবর্তন #করোনা
• প্রাচীনকালে ভাইরাস-ঘটিত এক বা একাধিক মহামারী হয়েছিল। তাকে মানুষের জিনোমের অতীত অভিযোজনের মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়।
• পূর্ব এশিয়ার মানুষের জিনোমে ২৫ হাজার বছর পুরানো এক ভাইরাস-ঘটিত মহামারীর সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
• জিনোমের কার্য-বিশ্লেষণ থেকে মনে হয়, সেই মাহামারী ছিল একটি প্রাচীন করোনা, বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত এক মহামারী।
করোনা ভাইরাস সাম্প্রতিক তিনটি বড় মহামারীর জন্য দায়ী।
১) সার্স-কোভ (SARS-CoV) হল প্রথম মহামারী যা চীনে ২০০২ সালে প্রথম উদ্ভূত হয়। এতে ৪ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল এবং ৪০০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
২) তার চার বছর পরে, মার্স-কোভ (MARS-CoV) মধ্য প্রাচ্যে উদ্ভূত হয়, এবং সম্ভবত এটি এসেছিল উট থেকে (তথ্যসূত্র ১)। তাতে প্রায় ২৫০০ মানুষ সংক্রমিত হয় ও ৮৫০ জন মারা যায়।
৩) ২০১৯ সালের শেষে বর্তমান অতিমারী সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) চীনে শুরু হয়েছিল।
বর্তমানের সার্স কোভ-২ (SARS-CoV-2) মহামারীটি নতুন বা মিউট্যান্ট ভাইরাস থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে মানুষের দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে। আধুনিক মহামারীবিদ্যা ও চিকিৎসাব্যবস্থা একে আটকাতে এখনও সফল হল না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আধুনিক মানুষের জিনোমে কয়েক হাজার বছর আগেকার বিবর্তনের তথ্য রয়েছে, আর সেই তথ্য থেকে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে বড় ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনাগুলি সনাক্ত করতে পারি। সেই জ্ঞান ভবিষ্যতের ভাইরাস-ঘটিত মহামারী সম্ভাবনা বুঝতে কাজে লাগে।
আজকের নতুন করোনা ভাইরাস খুব সম্ভবত একটি জুনোটিক রোগের (পশু-পাখিদের রোগ) ভাইরাস থেকে পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের ফলে উদ্ভূত, এবং এই ভাইরাস থেকে মারাত্মক শ্বসনতন্ত্রের রোগ হচ্ছে। তবে রোগসৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাস এই প্রথম মানুষকে আক্রমণ করল, এমন নয়। মানুষের জিনোমের মধ্যে অনেকগুলো জিন আছে যারা সার্স-কোভ-২ সহ অন্যান্য নানা করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে। মানুষের ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে মোটামুটি ২৫ হাজার বছর আগে এই জিনগুলো উদ্ভূত হয়েছে। এগুলি মানুষের শরীরে ভাইরাস-বিরোধী অভিযোজন।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মধ্যে এই অভিযোজন ঘটেনি। বর্তমানে পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী যারা, তাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে এই অভিযোজন সীমাবদ্ধ ছিল। যে কোনও কারণেই হোক, পূর্ব এশিয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক করোনা ভাইরাস মহামারীর ভৌগলিক উত্স। নানা দিকের সাক্ষ্য থেকে মনে করা হচ্ছে, এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণ ছিল প্রাচীনকালে মানুষের শরীরে ভাইরাস আক্রমণ। খুব সম্ভব একটি প্রাচীন করোনা ভাইরাসের সঙ্গে সেই সময়ের মানুষদের ‘বিবর্তনীয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ হয়েছিল। এটি যদি করোনা ভাইরাস নাও হয়, তাহলেও তার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের বেশ কিছু মিল ছিল, যার ফলে তাদের সঙ্গে মানবশরীর মোটের ওপর একইভাবে মিথস্ক্রিয়া করেছিল। আজকের পূর্ব এশীয় জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীদের মধ্যে এই ভাইরাস আক্রমণ ঘটেছিল। চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, দুই কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, ম্যাকাউ নিয়ে হল পূর্ব এশিয়া।
সুদূর অতীতে আজকের অতিমারীর ভাইরাসের কাছাকাছি কোনও ভাইরাস একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীদের আক্রমণ করেছিল ও তাদের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সেই অভিযোজনগত জিনের পরিবর্তন আজও বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আছে, কিন্তু তা বর্তমান ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর হচ্ছে না। বর্তমান করোনা ভাইরাস রোগ (COVID-19) এর ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ও মেডিক্যাল কারণগুলির প্রভাব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেশি বয়স, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সহ-অসুখের উপস্থিতি—এগুলো করোনা-আক্রমণের সম্ভাবনা ও মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ায়। পক্ষান্তরে, যথাযথ পুষ্টি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, এবং টীকা—এরা জিনের চাইতে করোনা রোগ হবার সম্ভাবনা ও তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনাকে বেশি কমিয়ে দেয়।
মহামারীবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, সমসাময়িক ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীতে সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের সংবেদনশীলতা এবং তীব্রতাকে প্রভাবিত করার মতো বেশ কয়েকটি জিন বা জিনের ‘লোকাস’ (আমরা বাংলায় বলতে পারি ‘জিন-স্থান’) পাওয়া গেছে। একটি লোকাসে একটি বিশেষ জিন সম্ভবত নিয়ান্ডারথালদের সাথে প্রজনন করার পরে আধুনিক ইউরোপীয়দের পূর্বসূরীর মধ্যে এসেছিল। সেটি সার্স-কোভ-২ এর প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে, অর্থাৎ সহজে ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। এই জিনটি কিন্তু পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়নি, সেখানকার মানুষদের ঐ লোকাসে বিকল্প জিন আছে।
মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাসে প্রাকৃতিক নির্বাচন নানা ভাইরাস-আক্রমণ সংক্রান্ত প্রোটিনকে বারবার বেছে নিয়েছে। সেগুলির কয়েকটি হল ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংক্রমণ-প্রতিরোধে জড়িত প্রোটিন। অন্যগুলির মধ্যে আছে এমন প্রোটিন যা আমাদের কোষে ঢোকার জন্য ভাইরাস ব্যবহার করে। ভাইরাস কোষে ঢুকে আমাদের কোষের নানা যন্ত্রপাতি হাইজ্যাক করে নিজের বংশবৃদ্ধি ঘটায়। মানুষের বিবর্তন এই ধরণের প্রোটিনের গঠন কেবলই পরিবর্তন করে গেছে, যাতে ভাইরাস তাকে ধরে কোষে প্রবেশ না করতে পারে। অন্যদিকে, ভাইরাসের বিবর্তন নতুন গঠনের প্রোটিনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর মতো মিউটেশন বেছে নিয়েছে।
লক্ষ লক্ষ বছরের মানব বিবর্তনে অন্যান্য ধরণের জিনের যে হারে মিউটেশন-জনিত পরিবর্তন হয়েছে, ভাইরাসের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত ‘ভাইরাস-ইন্টারেক্টিভ প্রোটিনের’ (ভিআইপি) সঙ্কেত বহনকারী জিনগুলির পরিবর্তন হয়েছে তার তিনগুণ দ্রুত হারে। নানা মানব জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন ভিআইপি-প্রোটিনের দ্রুত পরিবর্তন এখনও অব্যাহত রয়েছে; আরএনএ ভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত ভিআইপি-গুলির জন্য এটা আরও বেশি সত্য। করোনা ভাইরাসগুলি হল আরএনএ ভাইরাস। এসব থেকে এটা প্রমাণিত হয়, মানুষের বিবর্তনের সময় প্রাচীন আরএনএ ভাইরাস-জনিত মহামারী ঘন ঘন ঘটেছিল। এবং করোনা ভাইরাসগুলির মোকাবিলার জন্য এইরকম প্রাকৃতিক নির্বাচন মানব জিনোমে স্থায়ী ছাপ রেখেছে।
অতীতে করোনা ভাইরাস মহামারী হয়েছিল, ও তার জন্য মানুষের জিনে অভিযোজন-জনিত মিউটেশন হয়েছিল। সেই মিউটেশনগুলির চিহ্ন আজকের মানুষের মধ্যে আছে কিনা, গত মাসের শেষে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে (তথ্যসূত্র ২)। তাতে ৪২০টি ভিআইপি-প্রোটিন বেছে নেওয়া হয়েছে। এগুলি বর্তমানে মানুষের সঙ্গে করোনা ভাইরাসের মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। তারপর তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের অতীত আক্রমণের ছাপ খুঁজে দেখা হয়েছে। ২৬টি মানগোষ্ঠীর জিনোম নিয়ে এই অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। ৪২০টি ভিআইপি-র মধ্যে ৩৩২টি এখনকার মহামারী সার্স-কোভ-২ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। বাকি ৮৮টি আগেকার দুটি করোনা ভাইরাস মহামারীরে সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই গবেষণা দেখিয়েছে, করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি নিয়ে জিনগত অভিযোজন একাধিক পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীতে উপস্থিত রয়েছে, এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীতে এটি অনুপস্থিত। এ থেকে মনে হয় যে, একটি প্রাচীন করোনা ভাইরাস মহামারী (বা অনুরূপ ভিআইপি ব্যবহার করে এমন একটি পৃথক ভাইরাস) পূর্ব এশীয়দের পূর্বসূরীদেরর মধ্যে জিনগত অভিযোজন এনেছিল। বিশেষ করে ৪২টি করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি-জিন প্রায় ৯০০ প্রজন্ম, অর্থাৎ ২৫ হাজার বছর আগে নির্বাচিত হয়েছিল। এই গবেষণা থেকে আরও দেখা যায়, এই করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি-জিনগুলি আধুনিক ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর বর্তমান অতিমারী কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ও রোগলক্ষণকে প্রভাবিত করছে।
বর্তমান অতিমারী কি মানব-প্রজাতির সঙ্গে ভাইরাসের বিবর্তনীয় দৌড়ের মাধ্যমে শেষ হবে? তাই যদি হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পথে মানুষের জিনগত পরিবর্তন আসতে হবে। ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন আসে অতি দ্রুত, করোনা ভাইরাসের মতো আরএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে অন্যদের চাইতেও বেশি দ্রুতহারে। অন্যদিকে, মানুষের জিনগত পরিবর্তন আসে খুব আস্তে আস্তে।
জিনগত মিউটেশন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সেই মিউটেশন মানুষের মধ্যে ছড়াবে ধীরে ধীরে। করোনা-আক্রান্তদের মধ্যে সুবিধাজনক মিউটেশন ছাড়া মানুষ (মৃত্যু বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে) কম সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করবে। মিউটেশন-যুক্ত মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকবে ও বেশি সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করবে। এইভাবে অনেক প্রজন্ম পরে একদিন সুবিধাজনক মিউটেশন সমস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ততদিনে করোনা ভাইরাসও মানুষের নতুন মিউটেশনের বিরুদ্ধে নিজেদের মিউটেশন করে নেবে। এইভাবে এক বিবর্তনীয় দৌড় চলতে থাকবে। মানুষের পক্ষে এই দৌড়ের ক্ষয়ক্ষতি হবে চরম।
নাকি অন্য কোনও প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট পথে আসবে মানবের নিরাময়? টীকাকরণ কি বদলে দেবে ২৫ হাজার বছর আগেকার বিবর্তনীয় অস্ত্র দৌড়ের গতিপথ? নতুন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ওষুধের সন্ধানে বিজ্ঞানীরা কি প্রাচীন মহামারীতে বিবর্তিত ৪২টি জিন ও তাদের সঙ্কেতে তৈরি প্রোটিনগুলোকে ঝাড়াই-বাছাই করে দেখবেন?
ভবিষ্যতই কেবল তা বলতে পারবে।
তথ্যসূত্র
১) https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/middle-east-respiratory-syndrome-coronavirus-(mers-cov)
২) An ancient viral epidemic involving host coronavirus interacting genes more than 20,000 years ago in East Asia. Yassine Souilmi, M. Elise Lauterbur, Ray Tobler, et al. Current Biology. Published: June 24, 2021. DOI:https://doi.org/10.1016/j.cub.2021.05.067