এই পর্বের শেষে, ‘চলবে’ কথাটা আর লিখিনি।
এই লেখাটা পোস্ট করা পর্যন্ত, মেডিক্যাল কলেজের সাত জন চিকিৎসক, দু’জন ইঞ্জিনিয়র আর চার জন রোগী করোনা পজিটিভ হয়েছেন। আমার নিজের শরীরও তেমন ভালো বোধ করছি না। মানসিক অস্থিরতার কথা ছেড়েই দিলাম। তাই আপাতত অব্যাহতি চাইছি। বন্ধু স্বজনেরা ক্ষমা করবেন।
সকলে খুব খুব সাবধানে থাকুন, সুস্থ থাকুন।
৪ঠা এপ্রিল, ২০২০
বাড়ি থেকে বেরিয়ে, গাড়িতে উঠেই অভীককে বললাম — “আজ সোজা হাসপাতাল নয়, ব্যাংক হয়ে মেডিক্যাল কলেজ যাবো”।
সরকার বাহাদুরের বদান্যতায়, আমার অ্যাকাউন্টে মাইনে ঢুকেছে বেশ কিছুদিন আগে। এটিএম থেকে তুলে নেওয়াই সমীচীন ছিল, কিন্তু তাতে আমার মতো মান্ধাতার সেজঠাকুমার ঘোর আপত্তি। অতএব, চলো ব্যাংকে।
নিজের প্রয়োজনের জন্য অতটা নয়— আমি উতলা হয়েছিলাম আমার গাড়িচালক আর গৃহকর্মীদের জন্য। যে তিনটি পরিবার আমার উপর নির্ভরশীল, তাদের বেতন আমি মাসের পয়লা তারিখেই দিয়ে দিই— সচরাচর ব্যত্যয় ঘটে না এ নিয়মের। কিন্তু এবারে পারিনি— এবার পরিস্থিতিই আলাদা।
পথের দিকে চোখ পড়লে, মনটা আরও দমে যাবে ভেবে, মুঠোফোনের স্ক্রিনে নজর ফেরালাম। হোয়াটস্যাপে মেসেজের ভিড়— বেশিরভাগই আমার চিকিৎসক বন্ধুদের— কোভিড ১৯ এর সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ কিংবা কোনো গবেষণার রিপোর্ট। কোনোটাই খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
ইতালিতে ডাক্তারদের পেশেন্ট বাছাই করার স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে— রোগীর অবস্থার গুরুত্ব নয়, বয়সই সেখানে বিচার্য। ঐ রকম উন্নত দেশে, ভেন্টিলেটর বাড়ন্ত— স্বাস্থ্য পরিষেবা আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় নেমে এসেছে। খুব বয়স্ক করোনা রোগী, যাঁদের আনুষঙ্গিক শ্বাসকষ্টজনিত রোগ/ডায়াবিটিস/কিডনির অসুখ রয়েছে, যাঁরা হয়ত কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যেও আর ফিরবেন না — তাঁদের ভেন্টিলেটরে দেওয়া হচ্ছে না, কারণ সেই ভেন্টিলেটর তখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী কোনো রোগীকে রিভাইভ করার কাজে লাগানো হচ্ছে, যার বাঁচার সম্ভাবনা আগের বয়স্ক মানুষটির চেয়ে উজ্জ্বল।
সম্ভাবনা! চান্স! যে শব্দটার সঙ্গে মেডিক্যাল এথিকসের সুদূরতম যোগাযোগ থাকারও কথা ছিল না, তাই এখন উন্নত বিশ্বেও নির্দ্বিধায় গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে!
যে রোগে অল্পবয়সি মানুষের মৃত্যুর হার নগণ্য বলে এতদিন জানা যাচ্ছিল, সেই রোগে অসংখ্য তরুণ স্বাস্থ্যকর্মী মারা যাচ্ছেন, এবং সন্দেহ করা হচ্ছে যে, কম টেস্টিং এবং অপ্রতুল পিপিই এর জন্য দায়ী। এ খবর পোড়া ভারতবর্ষের নয়, খোদ মার্কিন মুলুকের। সেই বিলেত-আমেরিকা, আমরা নেটিভ গরিব আদমি যে সব-পেয়েছির দেশের স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত, যেখানে সূর্য কখনো অস্ত যায় না!
পোকা মাকড়ের মতো মানুষ মরছে সেখানে! এই মানব অথবা দানবসৃষ্ট ভাইরাসের মারণক্ষমতাকে হালকা ভাবে নেওয়ার জন্য, না কি প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিতে অনেক দেরি করে ফেলার জন্য, তার উত্তর ভাবীকাল দেবে— অবশ্য জীবাণুর এই বিশ্বজোড়া তাণ্ডবনৃত্যের পরে, আদৌ যদি ভাবীকাল বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবেই।
এই দক্ষযজ্ঞ বাধানো জীবাণুর পা নাকি এখনো সেভাবে আমার ভারতভূমিতে পড়েনি, তবে যদি ঐ একই মানুষখেকো খিদে নিয়ে সে জিভ লকলক করে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই দেশে, কি যে হবে, তা কল্পনার বাইরে। এই একশ তিরিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে, যদি একটি ক্ষুদ্র অংশও আক্রান্ত হয়, আর তারও একটি ক্ষুদ্রতর অংশের স্পেশ্যালাইজ্ড মেডিক্যাল কেয়ার দরকার হয়, তাহলে ভেন্টিলেটর কোন ছার, একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্সের জন্য যে পরিমাণ মারামারি কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে, তা লজ্জা দেবে বিগত সমস্ত অবমানবতার ছবিকে।
চিন্তাগুলো ভীষণ অবসন্ন করে দিচ্ছিল আমাকে। শরীর খারাপ লাগছিল একটু একটু। ব্যাগ হাতড়ে বার করলাম প্রেশারের ওষুধ। সকালে খাওয়া হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম বেরোনোর তাড়ায়।
অভীক আমাকে ব্যাংকের দরজায় নামিয়ে হাসপাতালের দিকে চলে গেল।
সকাল এগারোটা। কলুটোলা স্ট্রিটের ন্যাড়া ফুটপাথে গোল গোল চকের বৃত্ত আঁকা। প্রায় দু’ মিটার দূরত্বে অবস্থিত একেকটি বৃত্ত। প্রতিটি বৃত্তের মধ্যে মাস্ক পরিহিত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এঁরা ব্যাংকের গ্রাহক। আমি জনা ছয়েকের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুটপাথি খাবারের স্টল বা পুরোনো বইয়ের স্টলগুলোর মাথার উপর রঙচটা প্লাস্টিক ঝুলত— আড়াল করত দ্বিপ্রাহরিক রোদ্দুর কিংবা হঠাৎ বৃষ্টিকে। আজ চন্দ্রাতপহীন খোলা আকাশের নিচে, চকখড়ির বৃত্তের মধ্যে, পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকে ভাবতে ভাবতে নিজেরই খুব আমোদ হচ্ছিল। নির্ভেজাল আমোদ। দ্যাখ, সর্বশক্তিমান মূর্খ, আপন ভবিষ্যনিয়ন্ত্রক গর্বিতা মানবী, এই মুহূর্তে গণ্ডির মধ্যে বন্দী তুই, পরের মুহূর্তে কি ঘটবে জানিস না— অথচ, কত অহংকার তোর— I alone, am responsible for the consequences of my choice! ছোঃ!
বিনা গোলযোগে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শেষ হলো ব্যাংকের কাজ। তিনজন ব্যাংক কর্মী তিনটি কাউন্টারে যাবতীয় কাজ সামলাচ্ছেন। ব্যস্ততার মাঝেও আমার খোঁজ নিতে ভুললেন না পরিচিত ব্যাংক কর্মচারীটি। “ম্যাডাম, ক’দিন ডিউটি পড়েছে সপ্তাহে? মাস্ক টাস্ক পাচ্ছেন তো যথেষ্ট?”
আমিও জেনে আশ্বস্ত হলাম, যে ওঁরা বাড়ি থেকে যাতায়াতের জন্য পুল কার পাচ্ছেন।
ব্যাংক থেকে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যে হাঁটা দিলাম হাসপাতালের দিকে। হাসপাতাল পাশেই। বেশি হাঁটতে হবে না, এটাই বাঁচোয়া।
আজকাল রোজ একটা দুটো করে জরুরি অর্ডার পাস করে স্বাস্থ্য ভবন। আজও ব্যতিক্রম নয়। সরকার কলকাতা ও আশেপাশের কোভিড রোগীদের জন্য হাসপাতালের নাম নির্দিষ্ট করে অর্ডার বের করেছেন।
যদিও রাজ্যের একমাত্র করোনা হাসপাতালের তকমা খুলে নেওয়া হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের গা থেকে, সাগর দত্ত হাসপাতালের নামও বিবেচনার পর বাতিল হয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায়— তাই এবার কোন হাসপাতালের পালা, তাই নিয়ে চোরা একটা কৌতূহল থেকেই গিয়েছিল সকলের মনে।
অর্ডারে নিরসন হলো সেই কৌতূহলের। দেখা গেল, বেশি গুরুতর নয় এমন কোভিড পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা চলবে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের রাজারহাট ক্যাম্পাসে। মাঝারি গুরুতর রোগীরা থাকবেন এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে। আর কো-মর্বিডিটি সহ অতীব গুরুতর আর মুমূর্ষু রোগীদের দায়িত্বে থাকবে বেলেঘাটা আই ডি এবং সল্টলেকের আমরি হাসপাতাল।
সেই সঙ্গে আরও একটা অর্ডার দেখলাম। রাজ্য সরকার কোভিড পজিটিভ রোগীর মৃত্যুর “কারণ” অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছেন। যদি কোথাও কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়, তবে আগে এই কমিটি সমস্ত রিপোর্ট এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য অডিট করে দেখবে,তারপর ঐ রোগীর “কজ অফ ডেথ” অর্থাৎ মৃত্যুর কারণ সঠিক ভাবে জানা যাবে!
ধরা যাক, কারুর কিডনির রোগ রয়েছে। নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে হয়। তাঁর করোনা হলো। শ্বাসকষ্ট বাড়ার ফলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হলো। যেহেতু কোভিডের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তাই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা শুরু হলো। আর কিডনির অসুখের জন্য পূর্ববৎ চিকিৎসা চালু রইল। অবশেষে, রোগ গুরুতর আকার নিয়ে মাল্টি অরগ্যান ফেলিওরের দিকে গেল। ডাক্তারদের চেষ্টা ব্যর্থ করে রোগী মারা গেলেন। এইবার, মৃত্যুর কারণ হিসেবে কি লেখা হবে? করোনা? হ্যাঁ, তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু, যদি তাঁর কো মর্বিডিটি না থাকত, তিনি হয়ত মারা যেতেন না। আবার অন্যদিকে, তিনি কিডনির অসুখে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন, সেটাও ঠিক, কিন্তু করোনা আক্রান্ত না হলে হয়ত নিয়মিত ডায়ালিসিস আর ওষুধের উপর আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতেন।
সুতরাং, গণনা জটিল! বুঝ লোক, যে জানো সন্ধান!
এই অর্ডার নিয়ে ব্লাড ব্যাংকের উপস্থিত স্বাস্থ্যকর্মী এবং জুনিয়র কিছু ডাক্তারের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল মুহূর্তেই।
খানিকক্ষণের মধ্যে দেখলাম, কোভিড অথবা নন কোভিড মৃত্যু নিয়ে দুটি পক্ষ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোভিড পক্ষ দলে ভারি, অন্য পক্ষ ততটা নয়। যুযুধান দুই পক্ষকে থামাতে চেষ্টা করলাম না, কারণ বিচারক হিসেবে আমিও তো নিরপেক্ষ নই। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে যে বিচার করব সমস্যার, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ ঘেঁটে গিয়েছিলাম নিজেও।
আমি তখন ভাবছিলাম, আর কি কি জিনিস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে এই মহামারী! এই স্বল্প ক’দিনে সে ভেঙে দিয়ে গেছে আমাদের বহুদিন লালিত আরামের জীবনযাপনের অভ্যাস, ভেঙে দিয়ে গেছে প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বিশ্বাস, প্রতিমুহূর্তে ভাঙছে সম্পর্ক, আশা-ভরসা, যত্নে আঁকা ভবিষ্যতের সুখচ্ছবি। দু’চোখে হতাশ অবিশ্বাস নিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখছি কত শত শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া!
আজ সন্ধ্যায় এই ব্লাড ব্যাংকে আমাকে ঘিরে থাকা এই তরুণ মুখগুলো দেখে আমি ঐকান্তিকভাবে শুধু ভেবে চলেছিলাম, আর যাই ভাঙুক, এদের মনোবল যেন কখনো না ভাঙে!
তাহলে, এই অসম যুদ্ধটা আমরা কোনোদিনই জিতে উঠতে পারব না যে!
ম্যাডাম আপনার আবার লেখার অপেক্ষায় থাকলাম….
খুব ভালো লাগলো
আবার লিখবেন।
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
A big thank you for your article.
A big thank you for your article.
Thanks for fantastic info I was looking for this info for my mission.
I used to be able to find good info from your blog posts.