পৃথিবীর ইতিহাসে ‘শান্তির সময়’-এ এই প্রথম এতো লক্ষ (নাকি কোটি) শিশু, নারী, পুরুষ এতো দিন-সপ্তাহ-মাস ধরে মধ্যাহ্ন সূর্যের নীচে এতো মাইল হেঁটে চলেছে, ট্রেন-ট্রাক-ট্রলারের চাকার নিচে পড়ে, তেষ্টায়, খিদেয়, ক্লান্তিতে মরে চলেছে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য!
এটা করোনা-কাল!
বিফোর করোনা-আফটার করোনা ক্যালেন্ডারও নাকি হবে বলে শোনা যাচ্ছে!
আমরা এখন ডেঙ্গু নিয়ে আর চিন্তিত নই, ভাগাড়ের মাংসও দিব্যি হজম হয়ে গেছে!
গোমূত্র(দেশভেদে উষ্ট্রমূত্রও) তো শোনা যাচ্ছে সর্বরোগহর, অমৃত-সম!
গতবছরের সেপ্টেম্বরে আমরা চান্দ্রায়ণের সাফল্য-ব্যর্থতা-নিয়ে উদ্বেলিত-আলোড়িত ছিলাম!
সেটা খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে সরে গেছে, আর চাঁদে যেহেতু কোনো আবহমণ্ডল নেই আমাদের স্বপ্নের ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের কোনো শব্দ হয়নি, আর হলেও প্রায় আড়াইলক্ষ মাইল পেরিয়ে আমাদের কানে এসে পৌঁছয় নি!
মিছিলের মোমবাতি নিভে যাওয়ায় আগেই আমরা ভুলে গেছি নির্ভয়া-জেসিকা-আসিফার নাম!
উপহার সিনেমা হলের বা আমরি হাসপাতালের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলি আমাদের আলোচনার সিলেবাস থেকে কবেই হারিয়ে গেছে!
৩৭০ বা এনআরসি অতটা আলোচনায় নেই আর!
তবে সত্যি বলতে কি ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার পরেও আমরা সেতুভঙ্গ নিয়ে আর তেমন আন্দোলিত,আলোড়িত, বিচলিত, ক্রুদ্ধ নই আর কারণ ওটা সয়ে গেছে!
ব্রিজ-কোর্সের জমানা কিনা!
এমনকি এই শহরের একটা অংশ যে অসহায় মাটিতে বসে যাচ্ছিল, হারিয়ে যেতে বসেছিল আমাদের ইতিহাসের একটা অংশ, চিড় ধরেছিল অনেকগুলি বনেদী বাড়ির বনেদে, রসাতলে যেতে বসেছিল একটা জাতির ঐতিহ্য সে বিষয়ে আমরা এখন আর আদৌ ভাবিত নই।
পানসারে, দাভোলকার, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশের নামই মনে রাখতে পারি না তায় আবার কোয়েম্বাটোর না কোথাকার এইচ ফারুক!
অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, আসিফ মহিউদ্দীনরা তো সীমান্তের ওপারের ব্যাপার, তাতে আমাদের বয়েই গেলো!
সিঙ্গুর, রিজোয়ানুর, পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, সারদা-নারদা-কঙ্কালকান্ড, শিনা বোরহা হত্যা-আরুষি তলোয়ার-উইকিলিকস-ললিত মোদী-বিজয় মালিয়া-নীরব মোদি-ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী-চন্দ্রস্বামী হয়ে আসারাম-রামরহিম আমরা সব ভুলে যেতে থাকি অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়!
আমরা মনে রাখি না কে ছিলেন সত্যেন্দ্র দুবে বা বরুণ বিশ্বাস!
তেহেলকা মনে আছে? বঙ্গারু লক্ষণ?
অথবা সেই কফিন কেলেঙ্কারি?
টুজি স্ক্যাম?
সারদা, নারদা অথবা বোফর্স!
এ প্রজন্ম সম্ভবত জানেও না বোফর্স ব্যাপারটা কি!
ইন্দিরাতনয়ের অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ সরকার সেরেফ হাওয়ায় উড়ে গেলো বোফোর্সে আর বিশ্বনাথপ্রতাপে!
আমরাও ভুলে গেলাম।
মাঝে মাঝে নামটা ফিরে ফিরে এসেছে বটে, ওই কার্গিল বা কোয়াত্রোচ্চির কল্যাণে কিন্তু ওই পর্যন্তই!
ঘন্টাখানেকের আলোচনাগুলো ঘন্টা পেরিয়ে দিন, দিন পেরিয়ে হপ্তাও পেরোবে না, এসে যাবে নতুন কোনো দুঃসংবাদ!
তার পর, আবার আমরা ফেসবুকে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে তিক্ত বাদানুবাদ আর হোয়াটস্যাপে বাল্যবন্ধুদের গ্ৰুপে খিল্লি-খিস্তিতে মেতে যাবো!
বিভূতিভূষণের দ্রবময়ীর কাশীবাস গল্পের সেই নীরজা বলেছিলো, -দিদি, সংসার অনিত্য, সবই অনিত্য!
এ একেবারে উপনিষদের মূল কথা!
তা আজকের মিডিয়া (সোশ্যাল-আনসোশ্যাল মিলিয়ে) বাহিত হয়ে সে ঔপনিষদীয় সত্যই যেন ফিরে ফিরে আসে।
কথাটা আদতে দার্শনিক হেরাক্লিটাসের।
The only thing that is constant in life.
প্লাতোর ক্রেতাইলাস বা ডায়ালগে সেটা এই রকম দাঁড়ায়
Everything flows and nothing stays.
Everything flows and nothing abides.
Everything gives way and nothing stays fixed.
Everything flows; nothing remains.
All is flux, nothing is stationary.
All is flux, nothing stays still.
All flows, nothing stays
আসলে, একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি মানুষকে অভ্যস্ত করে দেয়। তখন সে কোন প্রতিক্রিয়া অনুভব করে না, তা সে অন্যায়ের প্রতিই হোক, বা মৃত্যুর প্রতি রেডিওতে, টিভিতে, খবরের কাগজে, স্বভূমির কোনো কোনো বিশেষ প্রদেশে ভ্রাতৃহত্যা সংবাদের নিত্যনৈমিত্তিকতা বা চোখের চামড়াহীন জোচ্চুরি মানুষকে অভ্যস্ত করে তোলে।
অন্ধত্বে, বধিরত্বে, সংবেদহীনতায়।
অসাড়, এনাস্থেটাইজড একটা গোটা যুগ, গোটা প্রজন্ম।
তাই এই ছবিগুলিও আমরা ভুলে যাবো, আবার মেতে উঠবো অলিম্পিকে, আইপিএলে, আমাজনে, নেটফ্লিক্সে…