অনেকে অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু কথার দাম বা মূল্যবোধ যদি এই বাজারেও কোনও একটা ফিল্ডে, সাধারণভাবে, অটুট থেকে থাকে, তাহলে সেটা যাকে বলে দু-নম্বরির লাইনে।
মানে, কাউকে ঘুষ দিলেন কোনও সুনির্দিষ্ট দাবিতে, নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার কাজটা হয়ে যাবে। কাউকে ‘সুপারি’ দিলেন কোনও কারণে, দক্ষ ও উপযুক্ত মানুষের কাছে যেতে পারলে আপনার ‘পথের কাঁটা’ ঠিকই সরে যাবে। এসব লাইন কোনও লিখিত চুক্তিপত্রের ভিত্তিতে চলে না – স্রেফ মুখের কথা-ই এসব ক্ষেত্রে স্ট্যাম্পপেপারে শিলমোহর করা চুক্তিপত্রের চাইতেও অধিক মান্য।
ঠিক একারণেই, ঘুষ দিয়ে পরিষেবা না পাওয়া মানুষের ক্ষোভ অন্যমাত্রার।
পূর্বতন সরকারের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিবিধ অস্বচ্ছতা কাটিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে ‘কাজে গতি’ আসার তারিফ অনেকেই করতেন। তবে কোন পথে এই ‘গতি’ আসা সম্ভব হতো, সে গূঢ় তথ্য অবশ্য তাঁরা উহ্য রাখাটাই শ্রেয় বলে মনে করতেন।
কিন্তু সব ভালোরই শেষ আছে। ‘গতি’ আসতে আসতে মাঝেমধ্যে ব্যাপারটা এমন লাগামছাড়া হয়ে যায় যে, দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। তদুপরি, নিজের পক্ষে ‘গতি’ টেনে আনতে চাওয়া দাবিদারের সংখ্যা যদি অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন আর ‘কাজের গতি’ তো দূর, ‘কাজ’-টিই হয়ে ওঠে না (যার উদাহরণ আপনারা স্কুল সার্ভিস সংক্রান্ত ঘটনাবলীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছেন)।
আরও একটা সমস্যা। উপরোক্ত যে বন্দোবস্তের কথা আমরা আলোচনা করেছি, তা অন্য ধারার ব্যবস্থা হিসেবে চলার উপযুক্ত। অর্থাৎ, অন্য ধারার সিনেমার মতোই, তা হবে সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম। ওই ধারাটিই মূলধারায় পরিণত হলে, তাতে সিনেমার বাণিজ্য বা অন্যধারার সিনেমা, কারোরই ভালো হয় না। এক্ষেত্রেও তা-ই। ওই ধারাটিই মূলধারা হয়ে গেলে যা হয়, তা হলো, পরিপূর্ণ কেওস।
অর্থাৎ, ধরুন, ক-বাবু খ-বাবুকে ‘শিক্ষা দেওয়া’-র জন্য ঙ-বাবুকে (ইনি যেহেতু সামাজিক মূলধারার বাইরে, তাই ঙ-বাবু হিসেবে এঁকে চিহ্নিত করলাম) ‘সুপারি’ দিলেন। আবার খ-বাবুও ক-বাবুকে ‘টাইট দিতে’ ঙ-বাবুকে ‘সুপারি’ দিলেন। এবারে আপনি বলতেই পারেন, ঙ-বাবুর পক্ষে এই দুইতরফের আর্জি গ্রহণ অনৈতিক। কিন্তু, মুশকিল হলো, ‘সুপারি’ দেওয়া-নেওয়াই যখন মূলধারা, তখন ঙ-বাবুর পক্ষে অত নীতি মেনে চলা সম্ভব হয় না। ততোধিক মুশকিল হলো, ঙ-বাবুর পক্ষে ক-বাবু বা খ-বাবু দুজনের কারও সুপারি রক্ষাই সম্ভবপর হবে না – কারণটা সহজেই অনুমেয়।
তো আপাতত পরিস্থিতি এই।
স্কুলশিক্ষা-দফতরে নিয়োগ দুর্নীতির কথা সবাই জানেন। পুরসভায় নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথাও প্রকাশ্যে এসে গেছে। যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে, ঘটনা প্রকাশ্যে আসা সম্ভব হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ঘুষ দিয়েও চাকরি পাননি, এমন ‘অসন্তুষ্ট গ্রাহক’-এর কাছ থেকে।
স্বাস্থ্য-দফতরের ফাইল এখনও কেউ খোলেননি, অবশ্য। যদিও, আরজিকর মেডিকেল কলেজের মতো জায়গায় বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
তবে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর ফাঁকফোকড় অলরেডি জানা গিয়েছে। কখনও নেতামন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা ঠিক কীভাবে পড়ার সুযোগ পেলেন, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কখনও বা পিজি-এন্ট্রান্সে কোভিডকাল শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ‘কোভিড-পরিষেবা’ দেওয়ার কারণে নেতারা বিশেষ কোটা পেয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে, সত্তর শতাংশ মার্কস পেয়ে অসন্তুষ্ট ছাত্রছাত্রীদের খাতা রিভিউ করার পর তাঁদের প্রাপ্ত মার্কস চল্লিশের ঘরে নেমে আসছে। এদিকে স্বাস্থ্য-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নামে স্বজনপোষণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে, যে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ ঠারেঠোরে স্বীকারও করে নিচ্ছেন। (মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচন বা বর্তমান সদস্যদের কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ আপাতত বাদ-ই রাখছি।)
তো তালিকায় নতুন সংযোজন, এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য টাকা চাওয়া। অল্পস্বল্প নয় – একেবারে সাড়ে চার লাখ।
অভিযোগ, এবারেও, সেই ‘পরিষেবা’ না পাওয়া নিয়ে। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীর এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার জন্য ঘুষ দিতে আপত্তি ছিল না – তাঁর ক্ষোভ, সাড়ে চার লাখ টাকা দেওয়ার পরেও তাঁর মেয়ে ফেল করল কেন!
একেবারে খাস কলকাতার নামকরা মেডিকেল কলেজের ঘটনা। পার্ক সার্কাসের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি, অভিযোগকারী – অর্থাৎ মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর মেয়েকে ডাক্তারি পাস করানোর জন্য টাকা দিয়েছিলেন যিনি – সেই মা নিজেই ডাক্তার। ক্ষোভ, কেননা এর পরও মেয়ে পাস করল না কেন!!
অভিযুক্ত – কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রাক্তন হর্তাকর্তা। গত এক দশকে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না, কিন্তু ছাত্রসংসদ থাকে। কর্তৃপক্ষ কাদের বেছে নেন, তা এই ঘটনাতেই স্পষ্ট। শুধুমাত্র দুয়েকজন অভিভাবক টাকা দিয়েছেন, এমন হওয়াটা অসম্ভব। কাজেই মোট টাকার অঙ্কটা কিছু কম দাঁড়াবে না। এই এত টাকা সেই ছেলে একক কৃতিত্বে গায়েব করেছে – এসব কথা বিশ্বাস করা মুশকিল।
আর হ্যাঁ, অভিযুক্ত কোন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য, সে তথ্য তো জানানোর মানে-ই হয় না।