একজন ডাক্তারের উপলব্ধি
জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে আছি। এবারে অবসরের কথা ভাবতে হচ্ছে। দিনরাত এক করে কাজ করে পুরস্কার পেয়েছি হার্টের দুটো সম্পূর্ণ বন্ধ ধমনী আর তিনটে ইস্পাতের স্টেন্ট। আর কী কী পেয়েছি তার হিসেব মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, তাই এই লেখা।
ক্রমশঃ প্রতিদিন জানতে পারছি আমার রোগীরা বেশীরভাগই আমার ওপরে সন্তুষ্ট নয়। নানা কথা মনে পড়ছে। একটা সময় ছিলো যখন প্রতিরাতে রাত কাটতো এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে- সূজ্জিমামাকে দিগন্তে তুলে তবে ঘরে ফিরতাম। ভাবতাম আমি সমাজসেবা করছি, এখন দেখছি আসলে মানুষ তা ভাবে নি। তখন বাড়ি গিয়ে রোগী দেখতে দক্ষিণা ছিলো পঞ্চাশ টাকা।
প্রতি রাতে একটা বাড়ি থেকে রাত দেড়টায় নিজের বাড়ি ফিরে দেখতাম বাড়ির সামনে অন্যান্য বাড়ি থেকে কয়েকজন লোক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এইরকম এক রাতে, রাত পূর্ণিমা ছিলো কিনা মনে নেই- শুধু কিছু মানুষ (এরা প্রত্যেকেই আমার বহুদিনের পরিচিত তবুও এখানে কারোর নাম উল্লেখ করবো না) বাড়ির সামনে অপেক্ষমান ছিলো, এটুকুই মনে আছে। আমার তখন দিন রাত এভাবেই চলছে।
ভেবেছিলাম এরা আমাকে তাদের নিজের নিজের বাড়িতে রোগী দেখতে নিয়ে যাবে। ভুল ভেবেছিলাম-এদের মধ্যে একজন চাইছিলেন রাত দেড়টায় তাঁর রোগীকে আমার বাড়িতে এনে দ্যাখাবেন। জানালেন খুব সম্ভব তাঁর ছেলের পক্স হয়েছে। আমি অনেক করে বললাম যে আমি তক্ষুনি বিনা পয়সায় ওনার বাড়ি গিয়ে রোগী দেখে আসবো- ক্যানোনা দিনের ব্যালা উনি ব্যস্ত থাকেন- ওনার সময় হবে না, কিন্তু আমার বাড়িতে দ্যাখা সম্ভব নয়- দু কামরার ভাড়া বাড়ি- বাড়িওয়ালার বারণ আছে এবং ঘরের বাকিদের অসুবিধে। উনি তাতে কিছুতেই রাজি নন। উনি আমার বাড়িতেই এক্ষুনি দ্যাখাবেন। শেষে ভয়ানক রেগেমেগে তিনি চাদর মুড়ি দেওয়া ছেলেকে নিয়ে অভিসম্পাত করতে করতে ফেরৎ গেলেন। ইনি সন্তুষ্ট নন। আমি গেলাম দ্বিতীয় হাউসকলে।
(হ্যাঁ তখন চিকেনপক্স দেখতেও বাড়িতে যেতে হতো।)
একদিন চেম্বারে দশজন রোগী- আমি দীর্ঘ বহু বছর ধরে দশজন করেই রোগী দেখি- তার মধ্যে রিপোর্টিং এবং ফ্রী রোগীরা থাকে। এতে প্রত্যেক রোগী তার প্রাপ্য সময়টা পেতে পারে। দরজায় লেখা থাকে-রিপোর্টিং করাটা রোগী দ্যাখার মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ, পয়সা লাগবে না, কিন্তু সময় লাগবে। এবং বিশেষ জরুরী শারীরিক অবস্থা ছাড়া কক্ষণো নিয়মভঙ্গ করে কাউকে আগে দেখি না। একজন মহিলা তাঁর প্রাপ্তবয়স্কা কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। তার একশো এক জ্বর হয়েছিলো। মহিলা আগে দেখাতে চান। বাকি রোগীরা কিন্তু ওনার মেয়েকে আগে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। আমার প্রতি ওনার বক্তব্য মেয়েকে আগে দ্যাখা সম্ভব না হলে বাকিদের তাড়াতাড়ি দেখে বিদায় করতে হবে। আমি রাজি হই নি। এই কয়েকদিন আগেই সেই ভদ্রমহিলা ফেসবুকে পোস্ট করলেন যেহেতু আমি সেদিন রূঢ়ভাবে ওনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সেহেতু এবং সেহেতু যে কোনও অচেনা লোকও আমাকে অপমান করতে পারে। এটা আমার প্রাপ্য। দেখুন- কন্যা ভালো হয়েছিলো, সুস্থ হয়েছিল, দশ কিম্বা পাঁচ বছর আগের ঘটনা অথচ আজও উনি চাইছেন এবং তীব্রভাবে চাইছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে চাইছেন (ফেসবুকের দিব্বি) যে আমি অন্যের কাছে অপমানিত হই। উনিও সন্তুষ্ট নন।
আর দু একটা ঘটনা বলবো। মহাভারত রচনা করার দায়িত্ব আমার নয়। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধের পাওনাগন্ডার হিসেবের হিমশৈলটুকু লিখছি।
একজন পুলিশ অফিসার আমার ওপরে ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে বিনা পয়সায় আমাকে অনেক ক্ষণ কলার ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। ওনার সঙ্গীরা আমাকে যৎপরনাস্তি কটু কথা বলে অবশেষে ক্লান্তিতে আমাকে ছেড়ে দ্যান। দোষের মধ্যে দুপুর আড়াইটের সময়ে আমি ওনার বৃদ্ধ বাবাকে দেখতে গেছিলাম। আশি ঊর্দ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মুখে খেতে পারছিলেন না। আমি বলেছিলাম রাইল’স টিউবে খাওয়াতে হবে এবং স্যালাইন চালিয়ে রাখতে হবে। এবং এর সঙ্গে বাড়ি গিয়ে গিয়ে স্যালাইন বদলে দিয়ে আসতে পারবো না বরঞ্চ ওনার একজন আয়া রাখা প্রয়োজন এটাও বলেছিলাম। যেহেতু এই বৃদ্ধকে ওনারা হাসপাতালে নেবেন না। তখন উনি মেনে নিলেন। কিন্তু সন্ধ্যাকালে কলার ধরে আমাকে ঝুলিয়ে রেখে মাতৃপিতৃকুলের লেংড়ি টেংরি (তারাপদবাবুর ভাষায়) অথবা টেংরি লেংড়ি করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এই পাড়ায় প্র্যাকটিস করার প্রাথমিক শর্তাবলীর মধ্যে বাড়ি গিয়ে গিয়ে স্যালাইন বদলানো ইত্যাদি সবই সিলেবাসে আছে এটা বুঝিয়ে ঐ অসন্তুষ্ট জনগণ ক্লান্ত হয়ে বিদায় নিলেন। তখন আমার খুপরি দশজন রোগী এবং তাদের বাড়ির লোকে গমগম করছে। সবাই সিনেম্যাটিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করলেন। ওনারা যাওয়ার পর পরবর্তী রোগী বললেন “এবার আমার পালা। যান ডাক্তারবাবু মুখে চোখে জল দিয়ে এসে এবার আমাদের দেখুন”(এনারও নাম ও মুখ আমার মনে আছে)।
পরবর্তী এপিসোড (এই লেখা বাংলা দূরদর্শনের ধারাবাহিকের থেকেও বড়ো করা যায়)। তখন অতি অল্প দক্ষিণায় আমি সকাল থেকে রাত প্রচুর রোগী দেখি। একজন রোগীকে সকালে দেখেছি। দুপুরে বুকে ব্যথা বলায় আবার দূরবর্তী খুপরিতে গিয়ে দেখে ইসিজি এবং হাসপাতালের উপদেশ দিয়ে এসেছি। অসুবিধা না কমায় সন্ধ্যায় আবার সেই খুপরিতে গিয়ে দেখে তক্ষুনি হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেছি। সালটা সম্ভবতঃ ঊনিশশো ছিয়ানব্বই। ওনার নাম আজও মনে আছে। বয়স ছিলো ছাপ্পান্ন। রাত সাড়ে দশটায় নিজের বাড়িতেই ওনার মৃত্যু হয়। সার্টিফিকেট দিতে গিয়ে দেখি শ তিনেক উত্তেজিত জনতা উপস্থিত। সার্টিফিকেট দেওয়ার পরে যখন ঘাস খেয়ে ডাক্তারি পাশ করা ডাক্তারের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হয়েই গেছে, কেবলমাত্র হাতের সুখ করাটাই বাকি আছে, তখন লাহিড়ি বলে জনৈক যুবক এসে আমার করা প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে আদ্যপ্রান্ত পড়ে। তাতে সবুজ কালিতে হাসপাতালে নেওয়ার কথা লেখা আছে দেখে সগম্ভীরে আমার ব্যাগ তুলে ন্যায়। নিজে আমার স্কুটারটা বাড়িতে পৌঁছে দ্যায় এবং আমাকে রিকশা করে বাড়ি পৌঁছে দ্যায়। আমি কৃতজ্ঞ লাহিড়িবাবু। আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবো। দুষ্ট লোকে বলে রোগীকে হাসপাতালে না নেওয়ার পেছনে বিপত্নীক রোগীর সম্পত্তির ব্যাপার স্যাপার জড়িয়ে আছে। গুজবে কান না দেওয়াই ভালো।তবে মোটের ওপর বাড়ির লোকেরা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলেই এক্ষেত্রে সন্দেহ করা হচ্ছে।
পেশাদার হাসুড়ে।
এটাই শেষ পর্যায়। যদিও ঘটনার ঘনঘটা মাথায় জট পাকিয়ে দিচ্ছে। খুনের ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে ভরা শীতের সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখা তো অতি সাধারণ ঘটনা। বাদ্দিন বাজে কথা। বরং বলি ফোনালাপের গল্প।
নাকতলার এক ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে অনেক দুপুর অনেক রাত কাটিয়েছি। আপাতদৃষ্টিতে ওনার বাড়ির অনেক কঠিন অসুখ ধরা পড়েছে আমার হাতেই। গত বছর আমার মেরুদণ্ডের একটা মিনি অপারেশনের একটু পরেই তিনি আমায় ফোন করলেন। তখনও আমি কাবু।দুই পা অসাড়। কোমরে ব্যথা প্রবল। আমি নার্সিং হোমের শয্যায় ধরাশায়ী থেকেই বললাম “…বাবু আমি অসুস্থ এখন অন্য কারো সঙ্গে কথা বলুন”। ফেসবুকের দিব্বি- পরে উনি আমাকে ব্যাঙ্গ করে সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু বক্তব্য রাখেন। যার মূল কথা হলো দ্রুত ফোন নামিয়ে রাখা। দ্যাখা গ্যালো উনিও অসন্তুষ্ট।
আরেকজন সুন্দরী, তিনি অবশ্য আজও আমার ভক্ত, একদিন আমাকে প্রশ্ন করেন “আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি চেম্বারে এ্যাত্তো হেসে কথা বলেন। আপনি চেম্বারের বাইরে যখন ফোন ধরেন তখন কিন্তু একটুও হাসেন না।তখন এ্যাতো গম্ভীর গলায় কথা বলেন ক্যানো?” আমি ক্ষণেক চোখ পিটপিট করে বল্লুম “এই টাকায় এর্চে বেশী হাসা যায় না”।
ইদম্বিধ চিন্তা এবং তিন কুড়ি বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতা আমাকে বলেছে “হেই বাপ্পো দিনকাল ভালো নয় কো। এবার কেটে পড়ি ভেগে পড়ি চুপি চুপি রে”।
ইতিমধ্যে আমার ছেলে মেয়েরা কবে বড়ো হলো, কবে যেন সব পাশ টাশ করে থিতু হয়েছে। নিজেদের বৃত্ত নিজেরা তৈরি করে নিয়েছে। ওদের ছোটবেলার, বড়ো হয়ে ওঠার স্মৃতি আমার শূন্য থেকে শূন্যে আটকে আছে। ওরা কি সন্তুষ্ট? জানি না। আমার জীবন এখন থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে এসে একটা ছোট্ট বৃত্তের মধ্যে এসে আটকে আছে।
অসামান্য।
আপনার মতোন নয়। তবুও কৃতজ্ঞতা।
সমস্ত ডাক্তারবাবু সহ অন্যান্য অনেক পেশার লোকেদের প্রায় একই সমস্যা! কিন্ত আপনি দারুন ভাবে উপ্থাপন করেছেন।
হ্যাঁ জানি। বাসের ড্রাইভারের হাতে জীবন তুলে দিয়ে বাসে চাপি। তারপর বাসে বসেই তাকে বরাহনন্দন বলতে বাধেনা।
অনবদ্য লেখা। এই কষ্টের প্রকৃত মূল্য কে দেবে?
লজ্জা লাগে
আমার অভিগ্যতায় আপনি একজন সৎ এবং সংবেদনশীল সুযোগ্য চিকিৎসক।
অসাধারণ, ?ধন্যবাদ। পরের প্রজন্মকে এই বিপথে ঠেলে না দেওয়ার সপক্ষে অকাট্য যুক্তি পেলাম।