খনি শহর দল্লী-রাজহরা দুর্গ শহর থেকে ৮৪ কিলোমিটার দূরে, ভিলাই থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে। ১৯৯২-এ সেখানে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হত না। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করাতে পাঠাতে হত দুর্গ বা ভিলাইয়ে। ইতিহাস নিয়ে আর শারীরিক পরীক্ষা করেই রোগ-নির্ণয় করতাম আমরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নির্ভুল হত।
১৯৯২—দুর্গ জেলার সি পি আই-এম-এর জেলা সম্পাদক থাকতেন দল্লী-রাজহরায়, তাঁর স্ত্রী এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দল্লী-রাজহরা শাখায় কাজ করতেন।
মাস দুয়েক মাসিক ঋতুচক্র বন্ধের পর পেটে হঠাৎ তীব্র ব্যথা নিয়ে এক সন্ধ্যায় মহিলা ভর্তি হলেন মিশনারীদের দ্বারা পরিচালিত পুষ্পা হাসপাতালে। ডাক্তার রোগ-নির্ণয় করলেন রাপচারড এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। কিন্তু অপারেশনের ঝুঁকি নিতে চাইলেন না, কেন না রোগিনী তখন শকে। অজ্ঞান করার যন্ত্র বয়েল’স এপারেটস-এর উপযোগী অক্সিজেন সিলিন্ডারে গ্যাস নেই এই অজুহাত দেখিয়ে তাঁকে ভিলাই-এ রেফার করে দেওয়া হল।
এবার স্বামী ভদ্রলোক বাধ্য হয়ে মাঝরাতে নিয়ে এলেন শহীদ হাসপাতালে। আমাদের বয়েল’স এপারেটস নেই। আমরা অপারেশন করতাম আদিম যুগের কিন্তু, অতীব নিরাপদ ‘ওপেন ঈথার এনাস্থেসিয়া’ দিয়ে।
অপারেশনতো করব কিন্তু, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ২.৪ গ্রাম%। দল্লী-রাজহরায় ব্লাড ব্যাংক নেই। কিন্তু আমাদের ছিল এক অভিনব পরিষেবা। ৪০০-রও বেশী স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের এক তালিকা ছিল, যে তালিকার দাতাদের আধ-এক ঘন্টার মধ্যে রক্তদানের জন্য পাওয়া যেত, যদি না পরিবারের কারুর সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মেলে। এছাড়া আরেকটা ছোট তালিকা ছিল দাতাদের যাদের সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়। সেই তালিকায় থাকতেন হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মীরা, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।
মনে আছে মহিলার জন্য প্রথম বোতল রক্ত দিয়েছিল শীতল। শীতল ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার এক কর্মী, রাজনন্দগাঁও জেলার নাদিয়া মঠের জমি দখল বিরোধী আন্দোলনের নেতা। হাসপাতালের সামনে তার চায়ের দোকান। আরও রক্তদাতাদের ডেকে পাঠানো হল। আর শুরু করা হল অটোট্রান্সফিউশন।
অটোট্রান্সফিউশন মানে রোগীর নিজের ক্ষরিত রক্ত তাকেই চালানো। পেটের ভিতর পিলে (spleen) ফেটে গেলে বা ডিম্ববাহী নালিস্থ গর্ভ ফেটে গেলে পেটে যে রক্ত জমে সে রক্ত সে রোগীর শিরায় চালানো যায় কোন ক্ষতি ছাড়াই।
মেডিকাল কলেজে দেখেছি—পেট খুলে মপে রক্ত শুষে ছাঁকনির উপর তা নিংড়ে বোতলে ভরে রোগীর শিরায় চালাতে। আমার রোগী এতটাই শকে, যে তা সম্ভব ছিল না। দাতার শরীর থেকে রক্ত নেওয়া হয় যে সেট দিয়ে, তার শিরায় ঢোকানোর সূঁচ পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, বোতলে রক্ত জমা হতে লাগল। রোগিনীর নিজের রক্ত ও দাতার রক্তে মহিলার শক সামলে নিয়ে অপারেশন শুরু হল, ছোট্ট অপারেশন, ভোরের আলো ভালোভাবে ফোটার আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন রোগিনী।
২৮ বছর আগে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাহীন খনিশহরে মহিলার প্রাণ বেঁচেছিল। তার ২০ বছর পর, ২০১২-এ মেট্রোপলিস কলকাতায় একই রোগে প্রাণ হারালেন বহুলপরিচিতা এক সংবাদপাঠিকা সন্দীপ্তা চ্যাটার্জী। কি ভাবে?—তা অন্য এক কাহিনী।