আন্তর্জালে ভুয়ো খবর আর ভুলভাল হাস্যকর অবান্তর কথাবার্তার প্রবাহ নিরন্তরই চলে, চলতেই থাকে। তার বেশিরভাগই চোখে পড়েনা, এবং যা চোখে পড়ে তারও প্রায় সবটাই নীরবে উপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। কারণ, প্রথমত, যেসব বিচিত্র ব্যাপার নিয়ে কথা হয় তার সব কিছু বিস্তারিত ভাবে জানা থাকেনা, আর জানা থাকলেও তার পেছনে পড়ে থাকতে গেলে নাওয়া খাওয়া ভুলতে হয়। কিন্তু, মাঝে মাঝে সত্যিই কিছু না বলে আর পারা যায়না, এবং এখন বোধহয় সেই মুহূর্ত আবার এসেছে। গত বছরখানেক যাবৎ কোভিড আর তার ভ্যাকসিন নিয়ে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের নির্বোধ ও কুৎসিত শোরগোলে কান পাতাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সত্যি, এ আর বাস্তবিকই নেওয়া যাচ্ছে না!
ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব অবশ্য, বলা বাহুল্য, একটা নয়, অনেক। এবং, শুধু অনেক নয়, অনেক ধরনের। যেমন ধরুন, (১) চিন পরিকল্পনা করে সারা পৃথিবীতে মহামারি ছড়াচ্ছে (আর আমেরিকা ইউরোপ বসে বসে চুপচাপ বুড়ো আঙুল চুষছে — চমৎকার, তাই না?)। (২) চিন আর আমেরিকা দু পক্ষ মিলে ইচ্ছে করে মহামারি ছড়াচ্ছে (এবং ইউরোপ আর রাশিয়াকে খেলায় না নিয়ে দুধুভাতু করে রেখেছে, আর তেনারাও সাইডলাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ খেলা দেকচেন, অভিমানে কতাবাত্রা বোলচেন্নাকো)। (৩) করোনা ভাইরাস হচ্ছে উহানের ল্যাবরেটরিতে তৈরি জৈব অস্ত্র, গণহত্যার উদ্দেশ্যে বানানো (এ বাবা, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় তবে এ ভাইরাসের ‘আরএনএ’–তে কাটাছেঁড়ার দাগ পাওয়া গেল না কেন?)। (৪) এ সবই হচ্ছে বিল গেটস সায়েবের কুকীর্তি, তিনি তিন বছর আগেই এক সেমিনারে মহামারির ঘোষণা করে রেখেছিলেন (পৃথিবীব্যাপী ষড়যন্ত্রের প্ল্যান আগেভাগেই সেমিনারে ঘোষণা করে দিচ্ছেন — বেচারা — ঘটে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের মতন তীক্ষ্ণবুদ্ধির সাপ্লাই না থাকলে কেমন দুর্দশা হতে পারে, দেকেচেন্তো?)।
তবে, ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের যে সংস্করণগুলো সোশাল মিডিয়ায় বাঙালি পোগোতিসিলদের মার্কেটে সবচেয়ে বেশি চলছে সেগুলো এইরকম। (১) এ হল এক ‘পুঁজিবাদী চক্রান্ত’, অর্থাৎ, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো নাকি বড়বড় পুঁজিপতি, উচ্চপদাসীন বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে অতিমারির ভয় দেখিয়ে লকডাউন করে গরিবের রুটিরুজি কেড়ে নিচ্ছে, যাতে করে ধনীদেরকে আরও ধনী করে তোলা যায় (কিন্তু, গরিবরা কাজকর্ম না করলে ধনীর মুনাফা হবেটা কীভাবে?)। (২) এ হল ‘বিগফার্মা’-র তরফে মহামারির ভুয়ো আতঙ্ক ছড়িয়ে ভ্যাকসিন বেচার ষড়যন্ত্র (কিন্তু, যাদের সে স্বার্থ নেই, তারা লকডাউনের বেয়াদবি সহ্য করবে কেন?)। (৩) প্রাণঘাতী ভ্যাকসিন দিয়ে দিয়ে বদমাইস কোম্পানিগুলো মানুষকে মেরে ফেলতে চাইছে (তা, পিত্থিমি শ্মশান হয়ে গেলে খাবে কী বাওয়া?)। (৪) এ রোগটি যে খালি সম্পন্ন শহুরেদের হচ্ছে, এবং শহুরে শ্রমজীবী বস্তিবাসী আর গ্রামের কৃষকদের হচ্ছেনা, তাতেই প্রমাণ, এ আসলে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো এক ভুয়ো আতঙ্ক মাত্র (তা, শহুরে রোগাক্রান্তরা তবে সাধ করে হাসপাতাল-ভ্রমণে যাচ্ছেন বুঝি?)। (৫) কোভিডের যেসব ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে সেগুলো কোনও কাজের নয়, কারণ, ইজরায়েলে টীকাকরণ অতিদ্রুত সম্পূর্ণ করার পরেও কোনও কাজ হয়নি (তথ্যটি সঠিক, নিশ্চিত তো?)। (৬) লকডাউন অর্থহীন, কারণ, সুইডেন তা না করেই বিন্দাস আছে (আবারও প্রশ্ন, তথ্যটি সঠিক, নিশ্চিত তো?)।
এমন আরও আছে, যেমন আইটি আর ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি-র ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। তবে, ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের সম্ভাব্য সমস্ত দিক নিয়ে সবিস্তার গবেষণামূলক লেখা ও সবকটি ভুয়ো-তত্ত্বের নিষ্পত্তিমূলক খণ্ডন পেশ করাটা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং, ওপরের দ্বিতীয়োক্ত ষড়যন্ত্র-তত্ত্বগুচ্ছ (১-৬) নিয়ে দু-এক কথা বললেই গুজবের বহরটা খানিক অন্তত বোঝা যাবে, তাই আপাতত সেটুকুই একে একে হোক।
(১) লকডাউন করে কর্মস্থল আর গণপরিবহন বন্ধ করে দিলে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের যে অসীম দুর্দশা হয়, সে তো আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু, জোরজার করে এইটা চাপিয়ে দিলেই যে ধনীরা আরও ধনী হবে, এ দাবির অর্থ কী? দরিদ্র লোককে স্রেফ না খেয়ে বসিয়ে রেখে রেখে তো আর ধনীরা ধনী হয়না, ধনীরা ধনী হয় তাদেরকে খাটিয়ে, তাদের শ্রমজাত মুনাফা সংগ্রহ করে। কাজেই, গায়ের জোরে আইন জারি করে তাদেরকে ঘরে বসিয়ে রেখে পুঁজিবাদের কোনও লাভ নেই, ওভাবে লাভ হলে তো ধনী ও ক্ষমতাবানেরা সব সময়েই সে চেষ্টা করত, তার জন্য অতিমারির দরকার হত না। এত দিন যে কলকারখানা স্কুল কলেজ গণপরিবহন খোলা ছিল, সে তো আর সমাজতন্ত্রের জন্য নয়, পুঁজিবাদের স্বার্থেই। সরকারি ভরতুকি দেওয়া সস্তার লোকাল ট্রেনে চড়ে মফস্বলের শ্রমিকটি যে সাতসকালে কলকাতা এসে পৌঁছতেন হন্তদন্ত হয়ে, সেটা নিশ্চয়ই ‘ক্ষমতা অনুযায়ী সমাজকে দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী নেবার’ জন্য নয়, বরং এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই সারাদিন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে পরিবার পালনের জন্য দিনান্তে (বা মাসান্তে) যৎসামান্য রসদ সংগ্রহের জন্য। সেটা বন্ধ হলে শ্রমিকের বিপদ তো বটেই, কিন্তু মালিকের লাভটা কী? অবশ্য, যদি বলেন, সঙ্কটের মুহূর্তে দরিদ্র শ্রমজীবীর প্রতি এই নিষ্ঠুর অবহেলাটাও পুঁজিবাদেরই অঙ্গ, তাতে আমার খুব বেশি আপত্তি নেই। কিন্তু, ওইভাবে এবং ওই অর্থে যদি পুঁজিবাদকে দায়ী করতে চান, তো অভিযোগের বর্শামুখটা ষড়যন্ত্রের দিক থেকে সরকারি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অসংবেদনশীলতার দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে, আর তার জন্য প্রথমেই বিসর্জন দিতে হবে জলজ্যান্ত অতিমারিকে অস্বীকার করবার নির্বোধ সুখটিকে।
এবং, লকডাউনের উল্টোপিঠটাও এখানে দেখতে হয়। এতে যে শুধু প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাইই নয়, বেশ কিছু মানুষ আবার বাড়ি বসে বসে দিনের পর দিন বেতনও পেয়েছেন, সংখ্যায় অনেক অল্প হলেও। এই ঘটনাটিকে আবার বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে মধ্যবিত্তের একাত্মতার প্রমাণ হিসেবে কেউ কেউ পেশ করতে চান, কিন্তু আসলে তারও কোনও মানে হয়না। পুঁজিবাদ খামোখা কারুকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চাইবে কেন? লকডাউনের ফলে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলে, প্রচুর লোককে বসিয়ে মাইনে দিতে হলে, প্রচুর লোক মারা গেলে বা হাসপাতালে গেলে বা অসুস্থ অক্ষম হয়ে বাড়ি বসে রইলে পুঁজিবাদের মোটেই কোনও লাভ নেই, বরং চূড়ান্ত ক্ষতি। এসব করে পুঁজিবাদ নিজেই নিজের সর্বনাশ করবে কেন? যাঁরা এসব বলছেন তাঁরা কোভিড অতিমারি কতটা বোঝেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, পুঁজিবাদ কী বস্তু সেটা যে মোটেই বোঝেন না, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
(২) এবার আসুন বিগফার্মার ষড়যন্ত্রের গল্পে। ভ্যাকসিন বানাবার কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র ভ্যাকসিন বেচার স্বার্থে অতিমারির ভুয়ো আতঙ্ক ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীকুল এবং প্রত্যেকটি দেশের সরকারকে হাত করে, গোটা পৃথিবী জুড়ে লকডাউন ঘটিয়ে দিচ্ছে — এ অভিযোগ যে কতটা উদ্ভট অবাস্তব হাস্যকর হতে পারে, সে ব্যাপারে আপনার কোনও ধারণা আছে কি? না, পৃথিবী জুড়ে এতগুলো লোককে এইভাবে একসাথে সম্পূর্ণ বশংবদ বানিয়ে এতবড় চক্রান্ত আদৌ কার্যকর করা যায় কিনা সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছিই না (সেটা অতি সঙ্গত প্রশ্ন ছিল যদিও), আমি শুধু এর অর্থনৈতিক অবাস্তবতার কথাটা বলতে চাইছি। ভাল করে ভেবে দেখুন।
প্যান্ডেমিক-এ গোটা পৃথিবীর জিডিপি কমেছে মহাজাগতিক অঙ্কে — ৫ ট্রিলিয়ন ডলার! সেখানে, ভ্যাকসিন-নির্মাতা ফার্মা কোম্পানিগুলোর মুনাফা সব মিলিয়ে বেড়েছে পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, দাবিটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে যে, কেউ বা কাহারা ষড়যন্ত্র করে গোটা অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার হারাতে বাধ্য করেছিল, শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ব্যবসায়িক উদ্যোগের মুনাফা মাত্র পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার বাড়তে দেবে বলে! পুঁজিবাদের হত্তাকত্তাদের মাথা খারাপ হয়েছে বলে মনে হয় বুঝি আপনার?
এখন গোটা পৃথিবীর জিডিপি ধরুন ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার মত, আর তার মধ্যে ফার্মা-দের ভাগ হল ৫০০ বিলিয়ন, মানে আধ শতাংশের একটু বেশি। আর, এদের মধ্যে যারা কোভিড ভ্যাকসিন বানিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে তাদের মোট মুনাফা ৫০ বিলিয়ন, মানে তারও দশ শতাংশ। অর্থাৎ, ভ্যাকসিন ব্যবসার মুনাফা হচ্ছে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতির .০৫ শতাংশ। তো এই ক্ষমতা নিয়ে ভ্যাকসিন নির্মাতা কোম্পানিগুলো নাকি গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দেবে, আর অর্থনীতির বাকি ৯৯.৯৫ শতাংশের দাবিদাররা তাতে বাধা না দিয়ে তা বসে বসে দেখবে আর বুড়ো আঙুল চুষবে — ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের আবদারটা এইরকম! এই সঙ্কটের মুহূর্তে এইসব অবান্তর উদ্ভট কথাবার্তা নিয়ে চ্যাঁচামেচি করাটা যে একটা ভয়ঙ্কর দায়িত্বজ্ঞানহীন বোকামো হচ্ছে, তাতে কোনও সংশয় থাকতে পারে কি?
(৩) এও শোনা যাচ্ছে, প্রাণঘাতী ভ্যাকসিন দিয়ে দিয়ে বদমাইস কোম্পানিগুলো নাকি মানুষকে মেরে ফেলতে চাইছে। মানে, শিব্রামের সন্দেশের ব্যবসার প্ল্যান আর কি! তাঁর এক অসামান্য গল্পে শিব্রাম চেয়েছিলেন, তিনি রোজ প্রচুর সন্দেশ বানিয়ে নিজেই কিনে খেয়ে নেবেন, এবং বিক্রির মুনাফা দিয়ে রোজই আরও আরও সন্দেশ বানিয়েই চলবেন। তাতে করে নিয়মিত সন্দেশও খাওয়া হবে, আর ব্যবসারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের বক্তব্য মোতাবেক, এখানে ফার্মা-দের পরিকল্পনাও সম্ভবত সেটাই — করোনা আর ভ্যাকসিন দিয়ে সব লোকজনকে মেরে দিয়ে পৃথিবীটাকে এট্টু ঠাণ্ডা করে নিয়ে তারপর শান্তিতে মনে সুখে ওষুধপত্তর বানাবেন, আর নিজেদের বানানো ওষুধ নিজেরাই কিনে খেয়ে খেয়ে মুনাফার পাহাড় গড়বেন! ওষুধ খেয়ে শরীলটাও ঠাণ্ডা থাকবে, আর ব্যবসাটাও জমবে!
(৪) কেউ কেউ এ যুক্তিও দিচ্ছেন যে, এই যে এ দেশে শুধু শহুরে সম্পন্নরা কোভিডের কবলে পড়ছেন, এবং দরিদ্র শহুরে শ্রমজীবী ও গ্রামীণ কৃষকেরা অনাক্রান্ত থাকছেন, এইটাই নাকি অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, কোভিড অতিমারি এক বানানো গল্প (আর, বানানো অতিমারির ভ্যাকসিনও যে বানানো গল্প হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!)। কিন্তু, যাঁরা এসব বলছেন তাঁরা আরেকটু ভাল করে খোঁজ নিলে জানতে পারতেন, সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে অতিমারি শহরাঞ্চলে আবদ্ধ থাকলেও, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ঢেউয়ে তা আর শহরে আবদ্ধ থাকেনি আদৌ। গ্রামে তা ঠিক কতটা ছড়িয়েছে, সেটা পুরোপুরি বোঝা যায়নি যদিও, নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্যের অভাবে। বস্তুত, অতিমারির দুই বছরে (২০২০ ও ২০২১) দেশে মোট মৃত্যু কত হয়েছে, আর কোভিডে মৃত্যুই বা ঠিক কত, সে ব্যাপারে সরকারি তথ্য নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে তথ্য রোজই গণমাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো সবই প্রতিষ্ঠিত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া। কিন্তু গ্রামে প্রচুর রোগি এসব ব্যবস্থার আওতার বাইরে, এবং তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন অপরীক্ষিত ও অচিকিৎসিত অবস্থায়, যা সরকারি ব্যবস্থায় আদৌ নথিভুক্ত হচ্ছে না, এবং তা সরকারি তথ্যেও প্রতিফলিত হচ্ছেনা। এখন পাঠক অবশ্যই জানতে চাইবেন, জানা যদি না-ই যায়, তো আমরাই বা তবে জানলাম কীভাবে? হ্যাঁ, এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। অতি সম্প্রতি এক প্রামাণ্য গবেষণাপত্রে তিনটি স্বতন্ত্র উৎস থেকে পাওয়া পরোক্ষ তথ্যগুচ্ছ ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে, আসলে এই দুই অতিমারিময় বছরে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি তথ্যে প্রকাশিত সংখ্যার ছয় থেকে সাত গুণ পর্যন্ত হতে পারে! অবিশ্বাস্য লাগছে, তাই না? কিন্তু, মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘ডেঙ্গু’ লেখার জন্য সরকারি চিকিৎসক অরুণাচল দত্ত চৌধুরিকে কীভাবে বরখাস্ত হতে হয়েছিল সে সংবাদ যদি আপনার স্মরণে থাকে, এবং অতিমারিতে মৃত ও গণ-চিতায় অর্ধদগ্ধ রোগিদের লাশ কীভাবে দলে দলে গঙ্গায় ভেসে এসেছিল সে স্মৃতি যদি আপনাকে কিছুমাত্রও বিচলিত করে থাকে, তবে এ গবেষণাপত্রের সিদ্ধান্ত আপনার তত অসম্ভব বলে মনে না-ও হতে পারে।
আচ্ছা, বাদ দিন। গ্রামের গরিবেরা কোভিডে মরেছে কি মরেনি, সে তর্ক ছেড়েই দিন না হয়। মনে করুন না কেন, এ অতিমারিতে সত্যিই তারা সম্পূর্ণ অনাক্রান্ত আছে। যদি তা হয়, সে তো পরম সুখের কথা। কিন্তু, যদি তাইই হত, তাতেও কি এ কথা প্রমাণ হত যে, কোভিড অতিমারি একটি ভুয়ো গুজব মাত্র? ভাল করে ভেবে দেখুন একটু। শহরের সম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ আক্রান্ত হননি, অতএব কোভিড আসলে তৈরি করা আতঙ্ক — এ অভিযোগের প্রকৃত অর্থ কী? শহুরে রোগিরা বিল গেটসের ষড়যন্ত্রে এমনই সাথ দিচ্ছেন যে, তার চাপে শরীরে জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট এসে যাচ্ছে, এবং তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে লাখ টাকা খুইয়ে আসছেন? মানে কী, এ সব কথার? আপনারা নিজেরা পাগল হয়েছেন, না কি আমাদেরকে পাগল ভাবছেন, সেটা ভেঙে বলবেন একটু?
(৫) অভিযোগ উঠেছে, করোনা-ভ্যাকসিন একটি অপরীক্ষিত ভুয়ো ওষুধ, মানুষকে ভয় দেখিয়ে এ ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যাতে বড় বড় ওষুধ কোম্পানিরা মুনাফা লুটতে পারে। বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিন নিয়ে আদৌ যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে, এর নাকি কোনও প্রমাণ নেই। এর প্রমাণ হিসেবে আসছে ইজরায়েলের নাম, যেখানে নাকি সবার আগে ভ্যাকসিনেশন করেও ফল হয়নি। কথাটা কি সত্যি? দেখা যাক। গোটা পৃথিবীতে ইজরায়েলই সর্বপ্রথম গণটিকাকরণ শুরু করে, এবং সবচেয়ে দ্রুত তা রূপায়িত করে। ২০২০-র মে মাসেই ইজরায়েল সরকার ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করে ফেলে, এবং ওই বছর ডিসেম্বরে ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে যায়। টিকার প্রথম প্রাপক ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু, যাঁর টিকা নেওয়ার ঘটনাটি লাইভ সম্প্রচারিত হয়। পরের বছর মার্চের মধ্যেই গোটা জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ ভ্যাকসিনের দুটি ডোজই পেয়ে যায়, এবং পঞ্চাশোর্ধ্বদের মধ্যে মাত্র লাখ খানেক মানুষ বাকি থাকেন। এর পর থেকে হুহু করে কমতে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়েরই হার, তবে এত আগে থেকে নিয়ে নেওয়ার ফলে অনেকের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে আসে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে যথারীতি সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও কিছু বেড়েছিল, যদিও প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক কম, এবং সেটাও নেমে যায় অতি দ্রুত। অনেককে তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়, এবং বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে চতুর্থ ডোজও। তৃতীয় ঢেউতেও সংক্রমণ বেড়েছে, কিন্তু অন্য দেশের চেয়ে অনেক কম, এবং মৃত্যু প্রায় নেই। কাজেই, ইজরায়েলে টিকা ব্যর্থ হবার গল্পটি এক অত্যন্ত বাজে মিথ্যে গল্প।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রশ্নে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে ইজরায়েলের অভিজ্ঞতা মেলে কি? ভ্যাকসিন-নির্মাতারা টিকার যে কার্যকারিতা দাবি করেছেন, আদৌ গণ-টিকাকরণের পরে বাস্তব ফলাফল কি তাই পাওয়া যাচ্ছে? এর উত্তর পেতে গেলে সমস্ত পৃথিবীর অভিজ্ঞতা এক জায়গায় করে ঠিকঠাক তুলনা করতে হবে। বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতির প্রকট বিভিন্নতার কারণে সেটা বেশ কঠিন কাজ, যার জন্য এতদিন উপযুক্ত প্রামাণ্য গবেষণা পাওয়া কঠিন হচ্ছিল, প্রতিটি দেশের তথ্য আলাদা করে হাতড়াতে হচ্ছিল। সুখের বিষয়, সে পরিস্থিতি কেটে যাচ্ছে, এবং সুবিধাজনক ও প্রামাণ্য গবেষণার ফলাফল একটু একটু করে সামনে আসছে। এ রকম একটি সাম্প্রতিকতম গবেষণার কথা বলি। ‘ইন্টান্যাশনাল জার্নাল অফ ইনফেকশাস ডিজিসেস’ পত্রিকার জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় কতিপয় চৈনিক গবেষক টিকাকরণ সংক্রান্ত বহু সংখ্যক তথ্যগুচ্ছকে এক জায়গায় করে একটি মোদ্দা বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন, যাকে পরিভাষায় বলে ‘মেটা-অ্যানালিসিস’। কী বোঝা গেছে তাতে? বোঝা গেছে এই যে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মোট সংক্রমণের ক্ষেত্রে ৮৯.১%, হাসপাতালে ভর্তি হবার ব্যাপারে ৯৭.২%, আইসিইউ-তে ঢোকার প্রশ্নে ৯৭.৪%, এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৯৯%। কী অর্থ এ সব সংখ্যার? হ্যাঁ, গোল পাকানো হচ্ছে তা নিয়েও। ‘অমুক ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা অমুক শতাংশ’ বললেই ভ্যাকসিন-বিরোধী ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক হাঁহাঁ করে তেড়ে এসে বলছেন, আরে, তার মানে তো সংক্রমণ এগারো শতাংশ, হাসপাতালে ভর্তি তিন শতাংশ আর মৃত্যুহার এক শতাংশ। তা, সে তো ভ্যাকসিন-ট্যাকসিন না নিয়েই সংক্রমণ, হাসপাতাল-গমন, মৃত্যু ইত্যাদির হার এমনিতেই ওর চেয়ে কম, তাহলে ভ্যাকসিন নিয়ে কি ছাই লাভটা হচ্ছে? এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, মাননীয় ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক মহাশয় বিল গেটস সায়েবের গোপন মনোবাসনাটি জেনে ফেললেও, ‘ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা’ বস্তুটি কী সেটাই এখনও জেনে উঠতে পারেন নি, মোট সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে বসে আছেন। অনেকেই ভাবছেন, একটা ভ্যাকসিনের ‘এফিকেসি’ বা ‘কার্যকারিতা’ ৮০ শতাংশ মানে হচ্ছে, একশো জনকে ওই ভ্যাকসিন দিলে আশি জনের সংক্রমণ হবে না, বাকি কুড়ি জনের হবে। সেটা হলে খুব খারাপ ব্যাপার, সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে আদৌ তা নয় তো! ‘কার্যকারিতা’ ৮০ শতাংশ হবার মানে হচ্ছে, ভ্যাকসিন আদৌ না নিলে কোনও একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যায় যতটা সংক্রমণ হত, ওই ভ্যাকসিন-টা নিলে তার চেয়ে আশি শতাংশ কম হবে। সংক্রমণ বা মৃত্যুর মোট হারের সঙ্গে তার ধারণা ও পরিমাণ — এ দুয়েরই আকাশ-পাতাল ফারাক।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে যাঁরা সোশাল মিডিয়াতে এইসব ভুলভাল বলছেন, তাঁদের মধ্যে সবাই কিন্তু অজ্ঞ আনপড় নন। অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার বিষয়, এবং আতঙ্কেরও, যে কিছু অভিজ্ঞ চিকিৎসকও এ ব্যাপারে মানুষকে ভুল বোঝানোর কাজে লিপ্ত হয়েছেন।
একটা তথ্য দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করি। যখন ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, তখন বিজ্ঞানীরা স্বয়ং এর কার্যকারিতা কতদূর হবে সে নিয়ে সংশয়ী ছিলেন, এবং খুবই বিনয়ী অবস্থানে ছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যদি অন্তত ৫০% হয় সেটাও চলতে পারে, এবং ৭০% হলে সেটা খুবই ভাল। অথচ, সব প্রত্যাশা ও সংশয় ছাপিয়ে প্রায় সমস্ত ভ্যাকসিনেরই কার্যকারিতা এখন ঘোরাফেরা করছে ৮০% থেকে ৯০% সীমার মধ্যে। একে নিছক সাফল্য বললে হবে না, অভাবনীয় সাফল্যই বলতে হবে। কাজেই, আপনি যদি একে ‘ষড়যন্ত্র’ বলেন, এবং আপনি যদি অজ্ঞ না হন, তো আপনি অকৃতজ্ঞ আচরণ করছেন কিনা, একটু ভেবে দেখবেন।
(৬) সুইডেনের লকডাউন না করার সিদ্ধান্তও এক উত্তপ্ত চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে, যদিও, আসলে তত উত্তাপের বিশেষ কিছুই নেই। বলা হচ্ছে, সুইডেন অতিমারির প্রেক্ষিতে আদৌ লকডাউন করেনি, এবং সুইডিশরা তাতে নাকি চমৎকার আছে, কোনও অসুবিধে হয়নি, বা অন্তত লকডাউন করা দেশগুলোর থেকে বেশি অসুবিধে হয়নি। এখানে যা বলা হচ্ছে না, সেটা তবে এবার বলি একটু।
সুইডেনে প্রথম কোভিড কেস ধরা পড়ে ২০২০-র জানুয়ারিতে, এবং অন্য দেশ থেকে সংক্রমণের খবরও আসতে থাকে ক্রমশ বেশি বেশি করে। সুইডেনের সরকার কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, লকডাউন করা হবেনা, এবং সমস্ত কাজকর্ম চালু রাখা হবে, এবং এমন কি মাস্ক-ও পরার দরকার নেই। তাদের ধারণা ছিল, ব্যাপারটা অল্প কিছু জ্বরজারির ওপর দিয়ে যাবে, এর জন্য সব কিছু বন্ধ করে দেবার দরকার নেই। কিন্তু, স্পষ্টতই এ ভাবনা ছিল ভুল। সংক্রমণ ও মৃত্যু হুহু করে বাড়তে থাকে, এবং বছরখানেক পরে সংক্রমণ হার গিয়ে দাঁড়ায় সমতুল্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের দশ গুণ। হাসপাতালে ভর্তি হবার হিড়িকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-গুলোর সমস্ত বিছানা ভর্তি হয়ে যায়। এমন কি, এতে করে অর্থনীতি বাঁচবে বলে যে ধারণা করা হয়েছিল তা-ও ভুল বলে প্রমাণিত হয়, এবং জাতীয় আয় প্রায় নয় শতাংশ নেমে যায় ও বেকারি প্রায় দশ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটি যদি সুইডেনের মত একটি অত্যন্ত কম জনসংখ্যা ও উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশ না হত, তো এ হেন সিদ্ধান্ত গণহত্যার সামিল হয়ে দাঁড়াতে পারত। ফলত, শেষে ২০২০-র ডিসেম্বরে সরকার লকডাউন নামাতে বাধ্য হয়। অবশ্য, ২০২১-এর মে মাস থেকে গণটিকাকরণ সুষ্ঠুভাবে চালু হলে আবার লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। কী বোঝা গেল এ সব তথ্য থেকে? না, সুইডেন লকডাউনের অকার্যকারিতার দৃষ্টান্ত নয়, বরং ঠিক উল্টো। সুইডেনের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, পোক্ত ও সুশৃঙ্খল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং মানবোন্নয়নের সুদীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাস-ওয়ালা একটি অত্যন্ত উন্নত দেশেও কোভিড বিধি অমান্য করলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে।
এর অর্থ কি এই যে, আমাদের দেশে যেভাবে লকডাউন করা হয়েছে তার মধ্যে কোনও গণ্ডগোল নেই, বা তার সমালোচনা হতে পারেনা? না, তা অবশ্যই হতে পারে এবং হওয়া উচিত। কিন্তু, লকডাউন ব্যাপারটাই একটা লোক ঠকানো ষড়যন্ত্র — এভাবে ভাবাটা বোধহয় নিছকই পাগলামি। লকডাউন করাটা যদি ‘পুঁজিবাদী চক্রান্ত’ হয়, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জাইর বোলসোনারো যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে লকডাউনের বিরোধিতা করেছেন তাকে কী বলব — পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম? অনুগ্রহ করে একটু ভেবে দেখবেন।
যাই হোক, খেপে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেললাম, এবার তাহলে গুটিয়ে আনা যাক।
একটা অভূতপূর্ব অতিমারির সম্মুখীন হয়েছি আমরা। তাতে মৃত্যু তো হচ্ছেই, এবং তার চেয়েও অনেক বেশি হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সঙ্কটকালীন চিকিৎসার সম্মুখীন হয়ে প্রচুর অর্থ খরচ হয়ে যাওয়া, দীর্ঘদিন ধরে তার জের হিসেবে শরীর দুর্বল অশক্ত হয়ে থাকা, নানা বিচিত্র উপসর্গ, কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়া। এর সমাধান ছিল অজানা। বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন সমাধান, কিন্তু কোনও সমাধানই হাতের মোয়া নয় — প্রয়োজন স্থৈর্য, প্রয়োজন ধৈর্য, প্রয়োজন কঠোর যুক্তিসম্মত অনুসন্ধান, প্রয়োজন সৃজনশীলতা, প্রয়োজন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অবাধ সহযোগিতা ও আদানপ্রদান। সরকারগুলোর তরফে প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে যথেষ্ট অর্থ সংস্থান করে যুক্তিসম্মত ও সংবেদনশীল পদক্ষেপ, এবং অতিমারি সংক্রান্ত তথ্যাবলী বিষয়ে যথোপযুক্ত সংরক্ষণ, সহজপ্রাপ্যতা ও স্বচ্ছতার সুব্যবস্থা। এবং, আমাদের মত আমজনতার তরফে প্রয়োজন এ বিষয়ে সচেতনতা, এবং অন্যকে সচেতন থাকতে সাহায্য করা। কিন্তু, অবান্তর আজগুবি সব অভিযোগ তুলে ভুয়ো খবর ও গুজব ছড়াতে থাকলে তাতে কার লাভ?
হ্যাঁ, অজানা বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তি ও ভুলভ্রান্তি স্বাভাবিক বইকি, যেমনটি স্বাভাবিক নিরন্তর সমালোচনাও — সেটা কাঙ্ক্ষিতও বটে। কিন্তু সে সমালোচনা যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক হওয়া চাই। বিজ্ঞানীরা যা এখনও জানতে পারেননি তা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকবেই, কিন্তু যা ইতিমধ্যে জানা গেছে সেটা একটু কষ্ট করে জেনে নিলেই হয়, মনে মনে কালনেমির লঙ্কাভাগ করা অর্থহীন। এবং, আজকাল নেটে যা পাওয়া যায়, তাতে বিভ্রান্তি খুব বেশি থাকার কথা না, যদি কী খুঁজতে হবে এবং কোথায় খুঁজতে হবে সেটা জানা থাকে। সেটা জেনে নেওয়াটাও কঠিন না, যদি জানার ইচ্ছেটা থাকে, এবং, ‘জানা’ কাকে বলে সে বিষয়ে একটা ধারণা থাকে। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, সে ধারণাটুকু অনেকেই রাখেন না। ফলত, সকলেই নেটে ঠিক সেটাই খুঁজে পাচ্ছেন, যা পেলে তাঁরা খুশি হন। আর, সেটাই সোশাল মিডিয়াতে ক্রমাগত শেয়ার করে যাচ্ছেন, গণপরিসর বানভাসি হয়ে যাচ্ছে বর্জ্যপদার্থে। সবিস্ময়ে দেখছি, বাম র্যাডিক্যালদের একাংশ সোৎসাহে ও নির্বিচারে গিলছেন আমেরিকার কট্টর দক্ষিণপন্থী অ্যান্টি-ভ্যাকসারদের বানানো সব ভুয়ো খবর, আর প্রবল কর্তব্যবোধ সহকারে তা বমি করে দিচ্ছেন সোশাল মিডিয়ায়, অবশ্যই তার সঙ্গে ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন’, ‘পুঁজিবাদী চক্রান্ত’, ‘মুনাফালোভী বহুজাতিক’ জাতীয় কিছু পরিচিত বাম-বুলি এবড়োখেবড়োভাবে মিশিয়ে। কেন যে এমন করছেন সে ব্যাখ্যা তাঁরা নিজেরাই সবচেয়ে ভাল দিতে পারবেন, তবে তাঁদের কীর্তিকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, সঙ্কটের মুহূর্তে স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি সবই বুঝি জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছেন।
তাঁদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, লকডাউনে মানুষের বিপন্নতা নিয়ে অবশ্যই সোচ্চার হোন, কিন্তু অনুগ্রহ করে অযৌক্তিক সন্দেহ আর ভুয়ো খবর ছড়াবেন না, আর কোভিড বিধি অমান্য করতে অন্যকে প্ররোচনাও দেবেন না। একটু মনে রাখবেন, দুর্ঘটনায় আপনার হাত-পা ভাঙলে তা সারাবেন কি সারাবেন না সেটা আপনার ব্যক্তিগত অধিকার হতে পারে, কারণ সেটা ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়া আর মাস্ক পরার ব্যাপারটা মোটেই ও রকম না। ভ্যাকসিন দেবার লক্ষ্য ব্যক্তিকে বাঁচানো নয়, একটি গোটা জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো। ভ্যাকসিন দেবার পরেও নানা কারণে ব্যক্তিবিশেষের সংক্রমণ ও মৃত্যু হতে পারে — বিরল হলেও — যে কোনও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই, শুধু কোভিডের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু, ভ্যাকসিন দেবার পরে একটি বিশেষ জনসংখ্যায় সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেকখানি কমে যায়, সেটুকুই লাভ। তাতে ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে আপনি বাঁচবেন কিনা সে প্রশ্ন বাতুলতা, বরং আপনার দেশ ও সমাজের আরও কিছু বেশি মানুষ যে বাঁচবে, এটুকু আশ্বাসই যথেষ্ট। কাজেই, ভ্যাকসিন নেওয়া ও মাস্ক পরাটা যতটা না ব্যক্তির লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন, তার চেয়েও বেশি যৌথ দায়িত্বের প্রশ্ন। আপনি যদি ভ্যাকসিন না নেন এবং মাস্ক না পরেন, তাহলে আপনার কোনও ক্ষতি নাও হতে পারে, কিন্তু সংক্রমণটা যাকে দিলেন তার অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। আর, খুব বেশি লোক যদি এইটা করেন, তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে গোটা জাতি, যেমনটি ঘটেছে আমেরিকা ব্রাজিল সুইডেনে।
মুখ ঢাকতে আর ছুঁচ ফোটাতে ভাল লাগেনা বলে অবাধে চলাফেরা করতে দিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে দেওয়া হোক, এইটা যদি ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক ভ্যাকসিন-বিরোধীদের দাবি হতে পারে, তাহলে ওই একই কারণে ভ্যাকসিন-পন্থীরাও পাল্টা দাবি করতে পারেন, যিনি মাস্ক পরবেন না এবং ভ্যাকসিন নেবেন না, তাঁকে অবরুদ্ধ করা হোক। দুটোর কোনওটিই কাম্য নয়, কিন্তু একটির অস্তিত্ব অন্যটিকে ন্যায়সঙ্গত করে তুলতে পারে। ‘মাই বডি মাই রাইট’ শ্লোগান যদি ভ্যাকসিন-বিরোধীদের আশ্রয় হতে পারে, তো ওই একই কারণে তো তা ভ্যাকসিন-পন্থীরও আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে।
পারে না? বলুন!
সাহায্যকারী তথ্যসূত্র
1) https://www.gavi.org/vaccineswork/how-effective-are-covid-19-vaccines-real-world
2) https://www.science.org/doi/10.1126/science.abm5154
3) https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1201971221008572
4) https://www.who.int/news-room/feature-stories/detail/vaccine-efficacy-effectiveness-and-protection
5) https://www.healthdata.org/covid/covid-19-vaccine-efficacy-summary
6) https://en.wikipedia.org/wiki/COVID-19_pandemic_in_Sweden
7) https://www.businessinsider.in/science/news/a-year-and-a-half-after-sweden-decided-not-to-lock-down-its-covid-19-death-rate-is-up-to-10-times-higher-than-its-neighbors/articleshow/85514410.cms
8) https://www.worldometers.info/coronavirus/country/sweden/
9) https://en.wikipedia.org/wiki/COVID-19_vaccination_in_Israel
10) https://www.worldometers.info/coronavirus/country/israel
[ ১৭/০১/২০২২ ‘গুরুচণ্ডালি’ আন্তর্জাল পত্রিকায় প্রকাশিত, লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]
অসাধারণ যুক্তিপূর্ণ লেখা। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের টানে যাঁদের কুযুক্তির দুষ্ট ঘোড়া বলগাহীনভাবে ছুটে চলেছে, তাঁদের থামানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।