আমার মত যারা ফিজিশিয়ান তারা অনেকেই আমার সাথে হয়ত একমত হবেন যে গত দু বছর ধরে আমাদের ক্লিনিকে ভার্টিগো বা মাথা ঘোরার সমস্যা নিয়ে রুগিদের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। অন্যদের ক্ষেত্রে আমার পক্ষে পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। তবে আমার ক্লিনিকে এদের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য রকমের বেশি। আরো নির্দিষ্টভাবে যদি বলা যায় গত সাত কি আটমাসে এই বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি।
মাথাঘোরা বা ডিজিনেস-এর সাথে ভার্টিগোর একটা পার্থক্য আছে। ভার্টিগোও এক ধরণের মাথাঘোরার অসুখ তবে এতে আক্রান্ত ব্যক্তির এমন ভুল বোধ হয় যে তার চারপাশে সব কিছুই ঘুরছে। আমাদের ব্যালেন্স নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটি কানের ভেতরে থাকে। খুব সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল এই যন্ত্রটিকে আমরা বলি ভেস্টিবিউলার অ্যাপারেটাস। এটি অত্যন্ত ছোট কিন্তু প্রচন্ড শক্তিশালী। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ এই তো সেদিন জি পি এস নির্ণয় করার যন্ত্র আবিষ্কার করেছে কিন্তু তাদের চেয়ে বহু শক্তিশালী জি পি এস নির্ণয় করার যন্ত্র তার কানের ভেতরে কোটি কোটি বছর ধরেই আছে।
অন্যান্য সূক্ষ্ম ও ক্ষুদ্র যন্ত্রের মত এটিরও অসুবিধে হল এতে সামান্য সমস্যা দেখা দিলেই তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক রকমের হয়। এর ভেতরের তরলের সামান্য আয়নিক ত্রুটি-বিচ্যুতি বা এতে সামান্য ইনফেকশন হলে মানুষের সাঙ্ঘাতিক মাথা ঘোরার সমস্যা উপস্থিত হয়। সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে আপনি লক্ষ্য করলেন যে আপনি বালিশ থেকে মাথাই ওঠাতে পারছেন না। মাথা তুলতে গেলেই আপনার চারপাশ বন্বন্ করে ঘুরছে। অনেকেরই এর সাথে প্রবল বমি ও ফোটোফোবিয়া হয়। আলো সহ্য করতে পারেন না। যাদের ভেস্টিবিউলার মাইগ্রেন থাকে তাদের এরই সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা ও চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে আসতে পারে। সমস্যা যাদের প্রথমবার হয়েছে তারা ও তাদের বাড়ির লোকেরা এতটাই ভয় পেয়ে যান যে মনে করতে থাকেন তাদের বুঝি বিরাট ‘স্ট্রোক’ হয়ে গেছে। হ্যাঁ, বাড়ির লোকেরা ফোনে এমনভাবেই আমার সাথে কথা বলেন। ‘ডাক্তারবাবু, এটা কি স্ট্রোক?’
তাদেরকে আশ্বস্ত করলেও এই ধরণের রুগিরা ক্লিনিকে এসে বেশিক্ষণ বসতে পারেন না তাই তাদের আগে দেখে দেবার ব্যবস্থা করতে হয়। ক্লিনিকে ভিড়ভাট্টা বেশি থাকলে এটা একটা সমস্যা কিন্তু না করে কোনো উপায় থাকে না। গত দুবছর ধরেই এমন রুগিদের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে তা আগেই বলেছি। যে কোনো বয়সের রুগির সংখ্যাই অনেক বেশি। কিশোর-কিশোরীরাও এ থেকে বাদ যাচ্ছে না। যারা ডায়াবিটিস বা ব্লাড প্রেসারের নিয়মিত ওষুধ খান এবং যাদের সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস আছে তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেশি কিন্তু অন্যান্য রোগমুক্ত মানুষ বা এমন কেউ যাদের এই সমস্যা আগে মোটেমাত্র হয় নি তারাও এতে ঘনঘন আক্রান্ত হচ্ছেন।
আমরা এইসব রুগিদের সাধারণত স্টেমেটিল, ভার্টিন, ডিজিরন এসব ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকি। অনেককেই রাতে কিছুদিন ঘুমের ওষুধও দিতে হয়। এতে সমস্যা তাড়াতাড়ি কমে আসে। আমরা সাধারণত দুই থেকে তিন সপ্তাহ এইসব ওষুধ চালু রাখি। বেশিরভাগ লোকেরা এতেই ভালো হয়ে যান। বিগত সাত-আট মাস ধরে যেসব ভার্টিগোর রুগি পাচ্ছি এদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা হচ্ছে যে ওষুধ সহজে বন্ধ করা যাচ্ছে না। ওষুধ বন্ধ করলেই ভার্টিগো আবার ফিরে আসছে। তাই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের অন্তত দিনে একবার করে ভার্টিগোর ওষুধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
যারা বয়স্ক লোক, যারা নানান রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে অনেকসময় ভার্টিগর ওষুধ বন্ধ করা যায় না। কিন্তু এই অল্প বয়সের এবং অন্যান্য প্রায় সম্পূর্ণ নীরোগ মানুষদের ভার্টিগোর সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া খুব চিন্তার কারণ। আমার সবসময় মনে হয়েছে এই সমস্যা বাড়ার মূল কারণ কোভিড। বিশেষ করে যখন ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরু হল তার পর থেকেই ভার্টিগোর রুগি প্রচুর বেড়ে গেছে। ইন্টারনেট সার্চ করে দেখেছি সবাই বলছেন ভার্টিগো কোভিডের এক লক্ষণ। লং কোভিড বা পোস্ট কোভিডে অনেক লোক ভার্টিগোতে ভুগছেন। অনেক জার্নালে এমন কিছু ‘কেস স্টাডি’ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সরাসরি প্রমাণ করার কিছু উপায় আমাদের হাতে নেই। এবারে কোভিডের যে চতুর্থ সংক্রমণ এল, জ্বরের অত্যন্ত বাড়বাড়ন্ত থাকলেও যেহেতু কারুরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে নি তাই খুব প্রয়োজন ছাড়া কাউকেই আর টি পি সি আর করাতে দিই নি। এতে রুগিদের আটশ টাকা বেঁচে গেছে। যদিও মুখে সবাইকেই বলেছি ধরে নিন আপনার কোভিডই হয়েছে। লোকেদের কোভিড নিয়ে ভয় প্রায় কেটেই গেছে। আর প্রায় সবাই ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়ায় দুই কি চার দিনেই জ্বর কমে যাচ্ছে। তাই রুগিদের তরফ থেকেও ডাক্তারবাবুর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এইবারের কোভিডেও প্রচুর রুগি ভার্টিগোর শিকার হচ্ছেন।
কোভিড থেকে ভার্টিগো কিভাবে হতে পারে বা কেনই বা তাতে উপশম দীর্ঘায়িত হচ্ছে এই ব্যাখ্যা খুব স্পষ্ট নয়। কিছু কিছু ভাইরাস যেমন এপ্সটেইন বার, হারপিস জোস্টার, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভেস্টিবিউলার অ্যাপারেটাসকে আক্রমণ করতে পারে। সার্স কোভিড-১৯ যে তাকে আক্রমণ করতে পারে বা করেছে তা বলাই যায়। আরেকটা ব্যাপার হল আমরা কোভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন বা ডক্সিসাইক্লিন এন্তার ব্যবহার করেছি এই দুটি ওষুধেরই অল্প হলেও ‘ওটোটক্সিসিটি’ আছে। তারা অন্তঃকর্ণের ক্ষতি করতে পারে। তাই রোগের কারণ ও চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দুই থেকেই মানুষদের মধ্যে মাথা ঘোরার সমস্যা বেড়ে থাকতে পারে।
আমার কাছে এখন অনেক ভার্টিগোর রুগি আসছেন যাদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছি তারা অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হন নি। তারা অন্য রোগেও আক্রান্ত নন। তবে তাদের ক্ষেত্রে ভার্টিগো এত বেশি হচ্ছে কিভাবে? জানা যাচ্ছে কোভিডের জন্য যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকেরই ভার্টিগোর সমস্যা হতে পারে। তাহলে আমার যে রুগিদের কোভিড হয় নি তারা ভ্যাকসিন নেবার জন্যও মাথা ঘোরা সমস্যার শিকার হতে পারেন।
যে কোনো সমস্যাই সহজে না সারলে তা ডাক্তারবাবুদের মাথাব্যথার কারণ। আজকালকার রুগিরা ফোন করে, হোয়াতে মেসেজ করে ক্রমাগত বিরক্ত করে যাবেন। তাই আগের মত ভার্টিগো সহজে সারছে না বলে সবাই জানতে চাইছেন এমনটা কিভাবে হল? আমি অনেককেই এই সম্ভাবনার কথা জানিয়েছি। আজকের এই প্রতিবেদন লেখার এক উদ্দেশ্য অবশ্যই সার্বিকভাবে আমার রুগিদের কাছে আমার ‘অনুমান’ জানানো। যিনি বৃদ্ধ তার ক্ষেত্রে মাথা ঘোরার অসুখ সমস্যাজনক হলেও অল্পবয়েসি যারা প্রতিদিন বাইরে কাজ করতে যাচ্ছেন তাদের পক্ষে ভার্টিগো একটা প্রচন্ড বিড়ম্বনা।
অনেকের ভার্টিগো এত বেড়ে গেছে যে তাদের ওষুধ, পসচারাল এক্সারসাইজ এসব করিয়েও সমস্যা কিছুতেই না কমায় বাধ্য হয়েছি তাদের ই এন টি ডাক্তারবাবুদের কাছে পাঠাতে। কিন্তু সেখানে গিয়েও যে তাদের খুব লাভ হয়েছে তেমন কিছু দেখি নি। তিনি হয়ত নতুন করে একটা ‘নার্ভের ভিটামিন’ দিয়েছেন কিন্তু সমস্যা মেটে নি। তা বলে এমন নয় যে মাথা ঘোরার সমস্যা নিয়ে আপনাদের সারা জীবন থাকতে হবে। সবারই প্রায় কমে যাচ্ছে কিন্তু সেটা কার ক্ষেত্রে কতদিনে এটা বলা কঠিন।
এই রোগের আরেক সমস্যা হল ‘রেকারেন্স’। ঘুরে ঘুরে আসে। এর সাথে লো প্রেসারের সমস্যা থাকলে তো কথাই নেই। তাই কোভিড মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই- এই উপমা হয়ত তার জন্য যথার্থ নয়। আমাদের কোভিড ভীতি চলে গেছে। কোভিড প্রায় সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়ে আমাদের পরিবেশে ছড়িয়ে গেছে। এসব সত্ত্বেও ছোট-বড় নানান সমস্যা নিয়ে সে মাথা তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভার্টিগো হয়ত তেমনই এক সমস্যা। যাদের স্পন্ডাইলোসিসের সমস্যা নেই তারা একটু উঁচু বালিশে শুয়ে দেখতে পারেন। আরাম হবে। আর বেশি করে জল খান। এই গরমে জল খেলে মাথা ঘোরার সমস্যা কম হবে।