[এখানে আলোচ্য লেখাটির নিজস্ব তথ্যসূত্র এবং আমার দেওয়া তথ্যসূত্র — দুটোই চৌকো ব্র্যাকেটে আছে। কিন্তু তফাতটা হচ্ছে, প্রথমোক্তগুলো সাধারণত আছে বাক্যের মাঝে, সাধারণ সরু অক্ষরে। আর, আমার নিজের তথ্যসূত্রগুলো আছে বাক্যের শেষে, মোটা বা ‘বোল্ড’ অক্ষরে। পড়ার সময়ে অনুগ্রহ করে এইটা খেয়াল রাখবেন, না হলে কিন্তু গুলিয়ে যেতে পারে।]
আমি গত ১৭ জানুয়ারি ‘গুরুচণ্ডাঌ’ ব্লগ সাইটে একটি লেখা লিখেছিলাম কোভিড-অস্বীকারপন্থী এবং ভ্যাকসিন-বিরোধী ভুয়ো গুজব ও হিড়িকের বিরুদ্ধে, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই। [১] নিঃসন্দেহে, লেখাটির ভাষা ও ভঙ্গিতে সে বিরক্তির ছাপ ছিল, এবং আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পেরে মোটের ওপর আনন্দিতই ছিলাম। ‘চারনম্বরপ্ল্যাটফর্ম’-এ যে এর বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় একটি লেখা বেরিয়েছে গত ২০ জানুয়ারি, আমি তা মোটেই টের পাইনি, কয়েকদিন আগে আমার বন্ধুরা সে দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগে পর্যন্ত। [২] লেখাটি লিখেছেন গৌতম দাস নামক জনৈক চিকিৎসক, আমার অপরিচিত। লেখাটির মধ্যে ‘সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে’ গোত্রের বেশ এক রকমের একটা বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গি আছে, মানে এখানকার ভ্যাকসিন-বিরোধীদের যে রকমটা থেকেই থাকে। তাবৎ বিশ্বের বিলিয়নেয়ার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তা, বড় বড় ওষুধ কোম্পানির মালিক আর পৃথিবীর সমস্ত দেশের সরকারি স্বাস্থ্য-কর্তারা সব একযোগে ভ্যাকসিনের সিরিঞ্জ উঁচিয়ে তেড়ে আসছে, আর তিনি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের ছাতার বাঁট বাগিয়ে একা লড়ে যাচ্ছেন, এই রকম আর কি!
তবে, ভঙ্গি ছাড়াও লেখাটিতে আরও দুটি জিনিস লক্ষ্য করার মত।
প্রথমত, লেখাটিকে ‘অথেন্টিক’ করে তোলার প্রচেষ্টায় তিনি যে কোনও ত্রুটি রেখেছেন, লেখকের চরম শত্রুও এ দাবি করতে পারবে না। ছোট্ট লেখাটিতে সাতান্নটা রেফারেন্স আছে। আমি মোটাদাগে একটা আবছা মতন চটজলদি হিসেব করে দেখলুম, প্রায় প্রতি নব্বই শব্দ-পিছু একটি করে রেফারেন্স! খুব কিছু কাজের রেফারেন্স এমন মনে হয়নি, তবুও সেগুলোকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতেই অনেকটা সময় চলে গেল। হ্যাঁ, এক এক করে সেগুলোর কথায় আসব যথাসময়েই।
দ্বিতীয়ত, যেভাবে তিনি আমার বক্তব্য নস্যাৎ করে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে চান, তার মধ্যে এক আশ্চর্য পদ্ধতিগত নকশা আছে। আমিও আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু রেফারেন্স টেনেছিলাম, সংখ্যায় তাঁর মত বিপুল না হলেও। সেগুলোর মধ্যে কিছু হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র, কিছু হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে মান্য নানা সংস্থার নথি/বিবৃতি, কিছু হয়ত স্রেফ তথ্য-সরবরাহকারী ওয়েব-সাইট, কিছু নামি সংবাদ সংস্থার খবর, ইত্যাদি — ঠিক যেমনটি তাঁর নিজের রেফারেন্স-গুলোও। বলা বাহুল্য, এগুলোর নিজস্ব ওজন কম নয়। কাজেই, শুধুমাত্র নীরব থেকে বা উপেক্ষা করে বোধহয় এগুলোকে এড়ানো সম্ভব ছিল না। তাহলে, আমার বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য তাঁর স্বাভাবিক পদ্ধতি যা হতে পারত তা এই রকম — তিনি দেখাতে পারতেন যে, আমি যে সমস্ত তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করেছি সেগুলো যথেষ্ট প্রামাণ্য নয়, বা যেমনটি দাবি করছি সে সব তথ্য বা সিদ্ধান্ত ওখানে নেই, বা তা থাকলেও সেখান থেকে আমি যা সিদ্ধান্ত টেনেছি তা অযৌক্তিক, বা পরবর্তীকালে আরও গবেষণার ফলে আমার বক্তব্য বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু লক্ষণীয়, তিনি এসব কিছুই করেননি। আমার দেওয়া যুক্তি ও তথ্যসূত্রগুলো সম্পর্কে তিনি আদৌ কোনও উচ্চবাচ্য করেন নি, বদলে নির্বিকারভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্য সূত্র সরবরাহ করে আপনমনে তর্জনগর্জন করে গেছেন। ভাবখানা এই রকম, স্রেফ ও নিয়ে একটাও কথা না বললেই ওর অস্তিত্ব উবে যাবে। বাচ্চারা যেমন ভয়ের জিনিস দেখলে হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢাকে, অনেকটা সেই রকম। না, আমি ও রকম করব না। আমি সাধ্যমত তাঁর দেওয়া সূত্রগুলো খুঁটিয়ে ও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব, এবং দরকারে আমার রেফারেন্স-গুলোর কথাও টানব। এমন কি, দরকার পড়লে আরও এমন নতুন রেফারেন্স হাজির করতেও দ্বিধা করব না, যা এখনও পর্যন্ত তিনি বা আমি কেউই হাজির করিনি। অবশ্য, যে তথ্য সর্বজনবিদিত, বা অন্তর্জালে সহজে খুঁজে বার করে যাচিয়ে নেওয়া যায়, বা যে তথ্যে মোদ্দা বক্তব্যে আদৌ তেমন কিছু ইতরবিশেষ হবে না, তার তথ্যসূত্র দিয়ে আমার জবাবকে অকারণে ভারাক্রান্ত করব না।
যাই হোক, লেখার বক্তব্য বিষয়ে আসা যাক। যে ক্রমে তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন, সেই ক্রম অনুসরণ করেই এগোবো।
(১) যেহেতু তিনি কোভিড অতিমারিকে আদৌ অতিমারি বলেই মানেন না, অতএব তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ২০২০-র জানুয়ারির শেষে যখন মাসখানেক সময়কালের মধ্যে মাত্র ১৭১ জনের মৃত্যু ঘটেছে কোভিড-এ, তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ‘আন্তর্জাতিক আপৎকালীন স্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে ঘোষণা করে দিল কেন, যেখানে সাধারণ ফ্লু-তে সারা বছরে মরে চার লাখ মত, মানে, মাসে বত্রিশ হাজার। প্রশ্নটি এমনিতে মন্দ না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হবার বহু আগেই মাত্র ১৭১-টি মৃত্যুBi লক্ষ করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বহু সংখ্যক মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়ে আপৎকালীন মোকাবিলার সুপারিশ করছে, সেখানে বর্তমান লেখক ২০২২-এর জানুয়ারি মাসে বসে সারা পৃথিবীব্যাপী পঞ্চান্ন লাখ মৃত্যুর তথ্য হাতে পেয়েও চার লাখ মৃত্যুর সাধারণ ফ্লু থেকে তার বিশেষ কোনও পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন না! তাঁর কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কাণ্ডজ্ঞানের কিছু তফাত তো থাকবেই, তাই না?
(২) লেখক তাঁর [২]-নম্বর রেফারেন্স-টি, যেটি আসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-র একটি বিবৃতি, তা দেখিয়ে দাবি করেছেন, “তাদের অনুমান ছিল, ২০২০ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা হবে তিন মিলিয়ন। আসলে হয়েছে ১.৮ মিলিয়ন।”। আসলে কিন্তু ওই নথিতে ‘হু’ বলেছে তার ঠিক উল্টো কথা — তাদের কাছে ওই সময় পর্যন্ত আসা সরকারি তথ্য বলছে মৃত্যু ১.৮ মিলিয়ন, কিন্তু তাদের হাতে থাকা বিভিন্ন গবেষণার হিসেব বলছে মৃত্যুর সংখ্যা আসলে ৩.৩ মিলিয়ন। কোভিড-এ মৃত্যুর হার যে সাধারণ ফ্লু-এর তুল্যমূল্য, একথা প্রমাণ করার জন্য তিনি পেশ করেছেন প্রখ্যাত চিকিৎসা-পরিসংখ্যানবিদ জন আইওয়ানাইডিস রচিত একটি গবেষণাপত্র। সে গবেষণাপত্রে দেখানো হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে যে সমস্ত রোগীদের রক্তরসে কোভিড-এর অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে সেই সংখ্যাগুলো যোগ করে যদি মোট কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যা বার করা হয় (যাবতীয় ওই ধরনের সমীক্ষার ফলাফল জড়ো করে), তাহলে মোট কোভিড-মৃতের সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে কোভিড-এর মোদ্দা মৃত্যুহার মিলবে (global IFR), এবং সেটা সাধারণ ফ্লু থেকে বেশি নয়। বক্তব্য পরিষ্কার। কিন্তু এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, এর আগে ও পরে ঠিক কী ঘটেছে, এবং আইওয়ানাইডিস-এর এই ধরনের অবস্থান সম্পর্কে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাই বা কী মতামত প্রকাশ করেছেন, সেটা আর লেখক আমাদেরকে জানানো প্রয়োজন মনে করেন নি।[৩]
প্রথমত, আইওয়ানাইডিস ২০২০-র মার্চ মাসে ‘স্ট্যাট’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অনুমান করেছিলেন, আমেরিকায় কোভিডে মৃত্যু দশ হাজারের বেশি হবে না (যদিও আবার পরে তা অস্বীকার করার চেষ্টাও চালিয়েছেন), অথচ সেটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে নয় লাখের বেশি!
দ্বিতীয়ত, ওই বছরের পরের মাস থেকেই তিনি ক্যালিফর্নিয়ার সান্টা ক্লারা কাউন্টি-র ওপরে করা একটি সমীক্ষাকে সামনে রেখে বলতে থাকেন, কোভিডে মৃত্যুহার তেমন কিছুই নয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা তা নিন্দিত হয়, যদিও ভ্যাকসিন-বিরোধী কট্টর দক্ষিণপন্থী মিডিয়ার কাছে প্রবল সমর্থন লাভ করেন। এভাবে রক্তরসের অ্যান্টিবডি দেখে দেখে সংক্রমণ-সংখ্যা আন্দাজ করার পদ্ধতিটি অন্যরা মোটেই যথার্থ বলে মনে করেননি। প্রখ্যাত বিজ্ঞান-সাংবাদিক ডেভিড ফ্রিম্যান ‘Wired’ পত্রিকায় সখেদে লিখেছেন, আইওয়ানাইডিস-এর মত অসাধারণ বিজ্ঞানী হয়ত বা ডাক্তারির ছাত্রদের কাছে এবার থেকে হাতুড়ে বিজ্ঞানী বলেই গণ্য হতে থাকবেন — “To them Ioannidis may always be the fringe scientist who pumped up a bad study that supported a crazy right-wing conspiracy theory in the middle of a massive health crisis.” [৪] এর পরেও অবশ্য আইওয়ানাইডিস মোটেই তাঁর অবস্থান থেকে নড়েননি, এবং নিজের বক্তব্য প্রচার করেই যেতে থাকেন, যার দৃষ্টান্ত লেখকের দেওয়া [৫] এবং [৫৬] নম্বর সূত্রে পাওয়া যাবে। এই সমস্ত লেখায় তাঁর ব্যবহৃত তথ্য, গবেষণা-পদ্ধতি, হিসেবনিকেশ — সবই অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের তীব্র ভ্রূকুটির সম্মুখীন হয়ে হয়েছে। এমন কি, তিনি তাঁর বক্তব্যের বিরোধীদের প্রতি ব্যক্তি-আক্রমণও চালাতে থাকেন, এবং উদ্ভট সব অভিযোগ আনতে থাকেন। যেমন, কোভিড পরীক্ষায় ঘুষ দিয়ে হ্যাঁ-বাচক ফলাফল তৈরি করা হচ্ছে, বা ডাক্তাররা কোভিড মৃত্যু বেশি বেশি করে দেখাবার জন্যে ইচ্ছে করে রুগি মেরে ফেলছেন, এইসব। এতে যারপরনাই অবাক হয়ে ‘Science Based Medicine’ পত্রিকার ‘ম্যানেজিং এডিটর’ ডেভিড গোর্স্কি “জন আইওয়ানাইডিস মহাশয়ের হলটা কী?” শীর্ষক এক নিবন্ধ লেখেন।[৫] তিনি আইওয়ানাইডিস-এর পরিবর্তন দেখে হতবাক হয়ে এ নিবন্ধে ভাবার চেষ্টা করেছেন, কে জানে, আসলে তিনি হয়ত এতকাল ভুল বুঝেছিলেন, এবং আইওয়ানাইডিস হয়ত আসলে চিরকালটাই ঠিক এমনটাই ছিলেন! শেষে তাঁর সিদ্ধান্ত, “He’s very good at finding the flaws in studies, but his studies during the pandemic demonstrate that, when designing studies of his own, he’s prone to every bias and flaw that he criticizes in others.”
তৃতীয়ত, রক্তরসে অ্যান্টিবডি দেখে দেখে সংক্রামিতের সংখ্যা অনুমানের এই পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল পুরোনো গবেষণাগুলো এখন ত্রুটিপূর্ণ বলে গণ্য হচ্ছে, মূলত দুটি কারণে। এক, এই ধরনের গবেষণাগুলোর ‘স্যামপ্লিং’ বা নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি ঠিকঠাক নেই, এবং দুই, ওই সময়ে ওই ধরনের পরীক্ষায় ভুল হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তাই, পরবর্তীকালে রক্তরসে অ্যান্টিবডি এবং ‘RTPCR’ — উভয় ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রামিতের সংখ্যা ও মৃত্যুহার নতুন করে নির্ণয় করা হয়েছে, এবং এতদিন যে সমস্ত পরীক্ষা করা হয়েছে তার মধ্যে যেগুলো যথেষ্ট উচ্চমানের সেগুলোর ফলাফল জড়ো করে ‘মেটা-অ্যানালিসিস’-ও হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে, এবং পরীক্ষা-পদ্ধতি ভেদেও, কোভিড-এর IFR বা মৃত্যুহার মোটামুটিভাবে .৫ থেকে ১ সীমার ধারেকাছে ঘোরাফেরা করে। [৬] এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ‘CFR’, অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে পরীক্ষিত সংক্রমণের সাপেক্ষে মৃত্যুহার, ১.৫-এর সামান্য বেশি। এখন, IFR-এর মান ‘CFR’–এর মানের চেয়ে কিছু কম হওয়ারই কথা, কারণ নিশ্চিতভাবে পরীক্ষিত সংক্রমণের চেয়ে পরীক্ষিত ও অপরীক্ষিত মিলিয়ে মোট সংক্রমণের সংখ্যা অবশ্যই কিছু বেশি হবে। কোভিড-এ মৃত্যুর সংখ্যাকে মোট সংক্রমণের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মৃত্যুহার মেলে, অতএব মৃত্যুর সংখ্যা একই থাকলে এবং সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লে হার কমবে — এটা সোজা হিসেব।
কাজেই, IFR বা মৃত্যুহার মোটামুটিভাবে .৫ থেকে ১ সীমার ধারেকাছে থাকাটা একান্ত প্রত্যাশিত।
এখন তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কোভিড-এর প্রকৃত মৃত্যুহার আইওয়ানাইডিস যা বলছেন (.০৫) তার কমপক্ষে দশগুণ, এবং সর্বাধিক কুড়িগুণ। মাত্র! এবং, সঙ্গে এই তথ্যটাও থাক যে, অস্ট্রেলিয়ার দুই নতুন ছাত্র, যারা নাকি এখনও পিএইচডি-টাই সম্পূর্ণ করেনি, তারা এক চমৎকার গবেষণাপত্র লিখে আইওয়ানাইডিস-এর লেখালিখির মধ্যে পদ্ধতিগত ত্রুটি বার করায় বিজ্ঞানীপ্রবর ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বেচারাদের নামে বিস্তর গাল পেড়েছেন!
(৩) হ্যাঁ, কোভিড-এর মৃত্যুহারের এই এত সব হিসেব কিন্তু সরকারি হিসেবকে সত্যি বলে ধরে নিয়েই, এবং সে ব্যাপারে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, অতিমারির সময়ে মোট মৃত্যু এবং কোভিড-মৃত্যু — কোনওটির পরিসংখ্যানই ঠিকঠাক রক্ষিত হয়নি। ‘Science’ [৭] এবং ‘Nature’ [৮] পত্রিকায় দুটি আলাদা গবেষণাপত্রে একাধিক সূত্রে পাওয়া পরোক্ষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, ভারতে এবং গোটা পৃথিবীতে কোভিড-মৃত্যু আসলে অনেক বেশি — প্রথম ক্ষেত্রে ছয়-সাত গুণ, এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চার-পাঁচ গুণ। লেখক অবশ্য একে ‘গোলমেলে ও অবান্তর’ বলেছেন, কিন্তু কেন যে তা বলেছেন সেটা বুঝিয়ে বলেন নি। যতক্ষণ তা না বলছেন, ততক্ষণ দুই প্রতিষ্ঠিত গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল অস্বীকার করবার আবদার মেনে নেওয়া একটু কঠিন হবে, বলা বাহুল্য।
(৪) লেখক এরপর বলেছেন, ষড়যন্ত্রের শুরু আসলে ২০০৯ সাল থেকে, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নাকি যা অতিমারি নয় তাকে অতিমারি ঘোষণা করার লক্ষ্যে অতিমারির সংজ্ঞাই বদলে ফেলেছিল, যাতে অতিমারির ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে ওষুধ আর ভ্যাকসিন কিনতে বাধ্য করে ওষুধ কোম্পানিদের মুনাফা বাড়ানো যায়। কিঞ্চিৎ অবাস্তব ও কাণ্ডজ্ঞান-বর্জিত হলেও, গল্পটি জম্পেশ, খালি সমস্যা একটাই — অতিমারির সংজ্ঞা বদলের স্বরূপটি যে গবেষণাপত্রে উন্মোচিত করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিটার দোশির লেখা সেই গবেষণাপত্রে আসলে আছে তার ঠিক উল্টো কথা। লেখক গবেষণাপত্রটি আদৌ পড়েন নি বা বোঝেন নি, এমন কি তার প্রকাশকালটিও ভুল বলেছেন — ওটা ২০১০ নয়, ২০১১। সেখানে গবেষক দোশি বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আসলে অতিমারির সংজ্ঞার আদৌ কোনও পরিবর্তন করেনি, কারণ, অতিমারির কোনও সংজ্ঞা তারা আদৌ কোনওদিনই দেয়নি। বদলে যা ছিল, তা হল অতিমারির বিবরণ। এ বিবরণের ভাষায় যৎসামান্য কিছু পরিবর্তন ২০০৯ সালে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পিটার দোশি রীতিমত সারণি তৈরি করে দেখিয়েছেন, ফ্লু-গোত্রের অতিমারির বিবরণে ওই ধরনের পরিবর্তন ১৯১৮ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অন্তত পাঁচবার ঘটেছে, এবং নানা তাত্ত্বিক কারণেই ঘটেছে, তার মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজা স্রেফ পাগলামো। এ পরিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি বলেছেন, এ বিতর্ক চলাই উচিত, কারণ অতিমারি মোকাবিলার স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞায় আমাদেরকে শেষপর্যন্ত পৌঁছতে হবে। চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা না পড়ে না বুঝে ষড়যন্ত্রের গল্প বানানো যে হাস্যকর কাজ, সেটা অন্তত একজন চিকিৎসকের বোঝা উচিত।
(৫) এর পরে লেখক পেড়েছেন ষড়যন্ত্রের আসল গল্প। মানে, করোনাকে মিথ্যে করে অতিমারি বলে দাবি করে কেন আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, এবং কেনই বা ভুয়ো ভ্যাকসিন বানিয়ে তার পেছনে সরকারি অর্থ ঢেলে তা জনগণকে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, তার পেছনের ‘আসল গল্প’। সেগুলোর নমুনা এই রকম — (ক) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চলে ‘বিগ ফার্মা’-দের টাকায় (“এই ফার্মা কোম্পানিগুলি গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ‘হু’-র প্রধান অনুদানদাতা হিসেবে, তাকে দিকভ্রান্ত করেছে ………”), (খ) ‘হু’ বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতির অভিযোগ আছে, (গ) “২০০৬ সালে ভুয়ো ‘পিসিআর টেস্ট’-এর মাধ্যমে ‘হুপিং কফ’-কে মহামারি ঘোষণা করার চেষ্টা হয়েছিল”, (ঘ) ২০১৯ সালে বিল গেটস আয়োজিত ‘ইভেন্ট ২০১’ নামক সভার আলোচনাক্রমে “ঢাকঢোল পিটিয়ে” ঘোষণা করা হয়েছিল, কম্পিউটার সিম্যুলেশন করে নাকি দেখা গেছে, শিগগিরই বাদুড় ও শুয়োর থেকে এক জীবাণু মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটাতে চলেছে, যা নাকি চরিত্রে পূর্ববর্তী ‘সার্স’-এর মত, কিন্তু অনেক বেশি ছোঁয়াচে, (ঙ) বিল গেটস করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বেচে দুশো বিলিয়ন ডলার মুনাফা তুলবেন …… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ ধরনের অভিযোগের মধ্যে যে কোন স্তরের পাগল পাগল বোকামি আছে, সেটা লেখক নিশ্চয়ই বোঝেননি, বুঝলে আর খামোখা এইসব লিখে হাস্যাস্পদ হবেন কেন! কেউ একটা-দুটো ভুল বললে গুছিয়ে তার জবাব দেওয়া যায়, কিন্তু কেউ যদি প্রতি লাইনেই অযৌক্তিক কথাবার্তা বলেন, আর গুচ্ছ গুচ্ছ অবান্তর বা ভুয়ো রেফারেন্স দেন, তাহলে তার বিরোধিতা করতে গেলে বাস্তবিকই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। নিতান্ত পণ্ডশ্রম, কিন্তু কিছু করার নেই। যেমন ধরুন, ওপরে যে পাঁচখানি ‘ষড়যন্ত্রের’ নমুনা আছে, তার প্রথম (ক) ও শেষটি (ঙ) নির্জলা মিথ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মোটেই ওষুধ কোম্পানিদের টাকায় চলে না, চলে বিভিন্ন দেশের সরকার ও নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুদানে। তাতে বিল ও মেলিন্ডা গেটসের সংস্থার মোটা অনুদান অবশ্যই আছে, কিন্তু ওটা ওষুধ কোম্পানি নয়, একটি পেশাদার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাত্র, যারা মুনাফা করেনা বরং জনসেবামূলক কাজকর্মে টাকা ঢালে। একক অনুদান হিসেবে তাদের দেওয়া টাকাটা যথেষ্টই বড় অঙ্কের, কিন্তু আসলে ‘হু’-এর কাছে মোট যে অনুদান আসে তার দশ শতাংশের বেশি নয়। আর, বিল গেটস কোভিড-এর ভ্যাকসিন বেচে দুশো বিলিয়ন ডলার কামাবেন, এ কথাটা যে ভুয়ো খবর, সেটা লেখক স্বয়ং যে সূত্র দিয়েছেন [২০] সেখানেই পরিষ্কার করে বলা আছে, যে কেউ সে সূত্র অনুসরণ করলেই দেখতে পাবেন। বস্তুত, লেখকের দেওয়া সূত্রের সংবাদটির উদ্দেশ্যই ছিল তাই — দুশো বিলিয়ন ডলার কামানোর খবরটি যে ভুয়ো সেইটা জানানো!
আর বাকিগুলো, মানে খ-গ-ঙ? বলছি, কিন্তু ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব নিয়ে এর চেয়ে বেশি পণ্ডশ্রম আর করব না।
(খ) হ্যাঁ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে একাধিকবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বইকি, এ জগতের কোন সংস্থার বিরুদ্ধে না উঠেছে? কিন্তু তা দিয়ে কীভাবে প্রমাণ হবে, কোভিড আর তার ভ্যাকসিন হল ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার মাত্র? সেটা তো তথ্য দিয়ে আলাদাভাবে প্রমাণ করতে হবে! যদি তা করা যায়, তবেই তার ব্যাখ্যার জন্য ষড়যন্ত্রের গল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, না হলে তো সবই বকোয়াস! আদালতে চোরের চুরির প্রমাণ দিয়ে তারপর যদি পুলিশ বলে, এই লোকটি আগেও চুরি করেছে, তো তাতে সাক্ষ্য-প্রমাণ আরেকটু জোরদার হতে পারে। কিন্তু ধরুন, একটি লোক সাতসকালে টোস্ট সহকারে চা খাচ্ছিল, এবার পুলিশ মহোদয় তাকে আদালতে তুলে নিয়ে গিয়ে বললেন, “এই লোকটি গতকাল একজনের পকেট মেরেছিল, তার আগের দিন গৃহকলহের সময়ে তার জীবনসঙ্গিনীকে ‘ডাকিনী’ বলে ডেকেছিল, এবং আজও তাকে গ্রেপ্তার করার সময়ে আমাকে ‘শ্যালক’ সম্বোধন করে আমার ভুঁড়িতে চিমটি কেটেছে, অতএব হুজুর, বুঝতেই পারছেন সাতসকালে উঠেই চা সহযোগে টোস্ট খাওয়া কতবড় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র!” তাহলে, জজসায়েব সে পুলিশ-প্রবর সম্পর্কে কী ভাববেন? যাই ভাবুন, আমরা এ যুক্তিতে মোহিত হয়ে লেখক সম্পর্কে যা ভাবছি, তার চেয়ে সেটা বোধহয় খুব বেশি আলাদা হবেনা।
(গ) না, ২০০৬ সালে কেউই হুপিং কাফ-কে ‘মহামারি’ বলে ঘোষণা করার চেষ্টা করেনি। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে আমেরিকার নিউ হ্যামশায়ার, ম্যাসাচ্যুসেটস এবং টেনেসি — এই তিন জায়গায় হুপিং কাশির পরিচিত লক্ষণওয়ালা রুগির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। স্থানীয় পরীক্ষাগারগুলোতে PCR পরীক্ষায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে হুপিং কাশির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু পরে দেখা যায়, অন্যান্য ধরনের পরীক্ষায় সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছেনা। তা থেকে চিকিৎসক-মহল বুঝতে পারেন, ওই রোগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘PCR’ পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে আসা নিরাপদ নয়।[৯] প্রথমে ভুল হলেও, তা থেকে পাওয়া শিক্ষাটি ছিল মূল্যবান শিক্ষা। এবং, এখানে বাস্তবিকই নির্দিষ্ট লক্ষণাক্রান্ত রুগির সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল, আর কোথাও কোনও দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের অভিযোগও ওঠেনি। ফলত, লেখক-উল্লেখিত সালটি এবং ঘটনাটি, দুটোই ভুল, এবং এর সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এ ভুল যদি ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তো ও রকম ষড়যন্ত্র চিকিৎসার উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
(ঘ) কম্পিউটর-সিম্যুলেশন ব্যাপারটা কোনও চিকিৎসক না-ই বুঝতে পারেন, কিন্তু যা যা বোঝেন না তাকেই যদি ষড়যন্ত্র বলতে থাকেন, খুব মুশকিল। কম্পিউটর-সিম্যুলেশন ব্যবহার করে পাওয়া কোনও ভবিষ্যদ্বাণী যদি না মেলে, বিজ্ঞানীরা তার যাথার্থ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন, এবং মিললে হরষিত হন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ‘ইভেন্ট ২০১’-এর তৈরি কম্পিউটর-সিম্যুলেশন-জাত ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাবার পরে, এবং বস্তুত মিলে যাবার ফলেই, ব্যাপারটি যে ষড়যন্ত্র সে ব্যাপারে লেখক নিশ্চিত হয়েছেন। লেখকের অভিযোগ, বিল গেটস সাহেব একে তো নিজের পৃথিবীব্যাপী ষড়যন্ত্র ‘ঢাকঢোল পিটিয়ে’ আগে থেকে ঘোষণা করে দিচ্ছেন, এবং তার ওপর আবার নাকি কম্পিউটর-সিম্যুলেশনের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে তার প্রমাণও হাতে হাতে দিয়ে দিচ্ছেন! গোয়েন্দাগিরির বহরটা দেখেছেন?
(৬) অতিমারি-পরিস্থিতির মধ্যেই বিগ ফার্মা এবং ধনী বিলিয়নেয়ার-দের মুনাফা কত বেড়েছে, সে নিয়ে লেখক বেশ কিছু হিসেব-নিকেশ পেশ করেছেন। কিন্তু, তাঁকে বললে বোধহয় বিশ্বাসই করবেন না যে, সবটাই অবান্তর, কারণ তার পরেও আমার দেওয়া হিসেবগুলো পুরো একই আছে — ভ্যাকসিন-নির্মাতা কোম্পানিগুলোর মোট মুনাফা পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়, সেটা গোটা পৃথিবীর বার্ষিক আয়ের মাত্রই .০৫ শতাংশ! এবং, লকডাউনে গোটা পৃথিবীর জিডিপি নেমেছে প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার, ফলত তাদেরকে ওইটুকু মুনাফা করতে দেবার জন্যে অন্যরা তার একশোগুণ ক্ষতি স্বীকার করে নেবে এমন সন্দেহে কাণ্ডজ্ঞানের চিহ্নমাত্র নেই। লেখক একে তো আমার এই যুক্তিটির মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেন নি, আর তার ওপর, নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যে প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডন করতে হয় এই ব্যাপারটাই তিনি জানেন না। তাঁর ধারণা, গুচ্ছ গুচ্ছ আবোলতাবোল রেফারেন্স ছুঁড়ে দিয়ে চোখ বুজে ‘বিগ ফার্মার দালাল’ বলে গাল পাড়লেই বুঝি যুক্তির বহর দেখে সবাই মোহিত হয়ে যাবে!
(৭) এরপর লেখক তুলেছেন কোভিড ভ্যাকসিনের ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার’ কথা। এটি অ্যান্টি-ভ্যাক্সারদের এক অত্যন্ত প্রিয় বিষয় — ভ্যাকসিন নিয়ে লোক যা বাঁচছে তার চেয়ে বেশি মরছে — এমন গুজব ছড়াতে পারলে তাঁরা ভয়ঙ্কর আনন্দ পান। আমেরিকায় যে সংস্থা ভ্যাকসিনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও মৃত্যু বিষয়ে নজরদারি করে, সেই ‘VAERS’ প্রদত্ত মৃত্যুর তথ্য তিনি যা দিয়েছেন সেটা আগের খবর, এই মুহূর্তে স্বভাবতই তার চেয়ে বেশি — ২৩০০০ মত। মুশকিলটা হচ্ছে, লেখক শতাংশ-টতাংশের ধার বিশেষ ধারেন না, যেমনটি জিডিপি-র সঙ্গে ভ্যাকসিনের মুনাফার তুলনার প্রশ্নে, ঠিক তেমনটিই এখানেও। এই ২৩০০০ ভ্যাকসিন-পরবর্তী মৃত্যুর সংখ্যাটির তাৎপর্য অন্য কোন সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে বুঝতে হবে? স্বভাবতই, আমেরিকায় এখন পর্যন্ত কতজনকে টিকা দেওয়া হয়েছে সেই সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে, এবং সে সংখ্যাটি ২৫ কোটি। অর্থাৎ, ভগ্নাংশের হিসেবে .০০০০৯২, এবং শতাংশের হিসেবে .০০৯২। কোভিড রোগটি হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১ শতাংশ মত, এবং এমন কি আইওয়ানাইডিস-এর ভ্রান্ত হিসেবেও .০৫। তবে তো ভ্যাকসিনে মৃত্যুর হার ওই দুটোর থেকেই সামান্য কম, তাই না? আমাদের লেখক মহাশয় বোধহয় চিকিৎসা-পেশার প্রবল ব্যস্ততায় ছোটবেলায় শেখা পাটিগণিত ভুলে গিয়েছেন!
কিন্তু, এখানে এ গল্পের শেষ নয়, শুরু মাত্র।
লেখক ‘VAERS’ প্রদত্ত তথ্য উল্লেখ করলেও, আসলে কিন্তু এ লেখায় উল্লিখিত [৩২] নম্বর সূত্রটি ওই সংস্থার নয়, সূত্রটি হচ্ছে ‘দ্য ডিফেন্ডার’ পত্রিকার, যার কর্ণধার রবার্ট এফ কেনেডি (জুনিয়র) হচ্ছেন একজন প্রখ্যাত অ্যান্টি-ভ্যাক্সার, যিনি ২০০৫ সাল থেকেই বলে আসছেন, ভ্যাকসিন নিলেই অটিজম হয় — কোভিড ভ্যাকসিন না, সব ভ্যাকসিন। বলা বাহুল্য, সবই প্রমাণহীন বাজে গল্প। বস্তুত, কোভিড ভ্যাকসিন বিষয়ক যত বাজে যুক্তি এখানে ছড়ানো হচ্ছে (আলোচ্য লেখাটি তার এক আদর্শ-স্থানীয় দৃষ্টান্ত), তার প্রায় সবই আসছে এই ভদ্রলোকের কাছ থেকেই। ভ্যাকসিন নিয়ে গুজব ছড়িয়ে তিনি প্রচুর অর্থ লাভ করে থাকেন। তাঁর সংস্থার (চিল্ড্রেন্স হেল্থ ডিফেন্স) সম্পত্তি ২০১৮ সালে এক মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০-তে প্রায় সাত মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কোভিড-এর গুজব ছড়ানোর সুবাদে। তিনি সপ্তাহ দুয়েক আগেই এক জনসভায় খুব উত্তেজিতভাবে কোভিড বিধিকে নাৎসি জমানার অত্যাচারের সঙ্গে তুলনা করে পরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। লেখক এইসব ব্যক্তিদের প্রতিনিধি হয়েছেন। কেন, তিনিই জানেন!
(৮) ইজরায়েলে টিকাকরণ ব্যর্থ হয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি যা পেশ করেন তা আর অবাক করেনা, কারণ এতক্ষণ ধরে তো তিনি এইসব আশ্চর্য বস্তুই পেশ করে এসেছেন। তিনি তাঁর [৪০] নম্বর সূত্রে যে ইজরায়েল-ভিত্তিক সমীক্ষা-গবেষণাপত্রটির উল্লেখ করেছেন তাতে দাবি করা হয়েছে, টিকাকরণের চেয়ে স্বাভাবিক সংক্রমণ ১৩ গুণ বেশি সংক্রমণ-প্রতিরোধী। চমকপ্রদ দাবি সন্দেহ নেই! কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, সেটা একটি প্রকাশ-পূর্ব খসড়া মাত্র, এটা আদৌ কোনও ‘পিয়ার রিভিউড জার্নাল’-এ প্রকাশিতই হয়নি, এবং এই প্রকাশ-পূর্ব খসড়াটি পড়ে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এই মর্মে যে, এই প্রবন্ধের গবেষণা-পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ।[১০] একে তো এ সমীক্ষায় কে সংক্রামিত হয়েছে আর কে হয়নি সেটা ‘RTPCR’-এর ভিত্তিতে নির্ধারণ না করে সাধারণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে করা হয়েছে, আর তার ওপর সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা লোকেরা হচ্ছে বিশেষ ধরনের বাছাই করা লোক, অবাছাই ভ্যাকসিন-গ্রহীতাদের সঙ্গে তাদের তুলনাও চলেনা। আবার ওই গবেষণাতেই আছে আরেকটি বিচিত্র পর্যবেক্ষণ — সংক্রামিত ব্যক্তি টিকা নিলে তার প্রতিরোধ-ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়, এবং এই কথাটা লেখক চেপে গেছেন, চেপে যাবারই কথা। সর্বোপরি, যদি রোগ-সংক্রমণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ‘স্বাভাবিক প্রতিরোধ’ ভ্যাকসিন-জাত প্রতিরোধের চেয়ে সত্যিই জোরালো হয়ও, তাহলেও বিনা প্রতিষেধকে তার জন্য অপেক্ষা করা এক বর্বরোচিত পরামর্শ, কারণ কিছু লোককে সংক্রমণ পেরিয়ে ওই ‘স্বাভাবিক প্রতিরোধ’ অর্জন করতে হবে অন্য আরও অসংখ্য লোককে বলিদানের বিনিময়ে।
ইজরায়েল সম্পর্কে আমি যা বলেছিলাম তার সপক্ষে নির্দিষ্ট তথ্যসূত্র দেওয়া ছিল, লেখক সে সব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন নি, কারণ সত্যিকারের ‘প্রমাণ’, ‘খণ্ডন’ এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তিনি ভাবিত নন। এখানে শুধু আর একটা মাত্র কথা বলব। কথাটা এই যে, ইজরায়েলে টিকাকরণের পরে যে সংক্রমণ যথেষ্ট সফলভাবে কমানো গেছে, এ নিয়ে এখন খুব ভাল তথ্য-ভিত্তিক গবেষণা আছে।[১১] মানে, প্রকাশ-পূর্ব অপরীক্ষিত গোলমেলে বস্তু নয়, সত্যিকারের গবেষণা। কাজেই, আজেবাজে জল্পনার পরিসর এখন অত্যন্ত কম।
(৯) ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে লেখকের সব ক’টি অভিযোগই আশ্চর্যের, কিন্তু কার্যকারিতার হিসেব-নিকেশ নিয়ে যেটা বলেছেন, সেটা সম্ভবত আশ্চর্যতম। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মাপকাঠিটাই নাকি পুরো জালিয়াতি, ‘এফিকেসি’ যেভাবে মাপা হয় তাতে সংখ্যাগুলো বেশ বড় বড় বলে (৯৫%, ৭৮%, ৮৪% — এই জাতীয়) তাতে লোক ঠকাতে সুবিধে হয় বলে ওইভাবে বলা হয়! শিশুদেরকে দেবার জন্য যে পৃথিবীব্যাপী নিয়মিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত গণ-টিকাকরণ কর্মসূচি চালু আছে, তার অন্তর্গত ভ্যাকসিন-গুলোর কার্যকারিতাও অবশ্য ওভাবেই মাপা হয়, এবং তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর রুগিদের (বা তাদের সন্তানদের) ওইসব ভ্যাকসিন নিতে বারণ করেন কিনা, সেটা জানা নেই। তবে এখানে তাঁর মতামত যা বোঝা গেল, তিনি ‘রিলেটিভ রিস্ক রিডাকশন’-এর বদলে ‘অ্যাবসলিউট রিস্ক রিডাকশন’ এবং এক-কে সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে প্রাপ্ত ‘এন এন টি ভি (নাম্বার নিডেড টু ভ্যাকসিনেট)’ সংখ্যাদুটিকে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রকৃত মাপকাঠি বলে মনে করেন। এই দুটো মাপ কীভাবে করা হয় তার পাটিগাণিতিক হিসেবগুলো তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু কেন যে সেগুলো ‘রিলেটিভ রিস্ক রিডাকশন’-এর চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, তার কোনও হিসেব, ব্যাখ্যা বা ওই জাতীয় কিছুই দেন নি আদৌ। তার বদলে যা দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে দুটি প্রবন্ধের উল্লেখ (তাঁর লেখার [৪২] ও [৪৩] নম্বর তথ্যসূত্রদ্বয় দ্রষ্টব্য)। পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন, এই দুই রেফারেন্সের মধ্যে প্রথমটি বিশুদ্ধ, ও দ্বিতীয়টি কিঞ্চিৎ অবিশুদ্ধ প্রতারণার দৃষ্টান্ত মাত্র। প্রথমটি ক্যানসার রুগিদেরকে তাদের রোগ ও চিকিৎসার অন্তর্নিহিত ঝুঁকির ব্যাপারে কীভাবে সচেতন ও অবহিত করে তোলা যায় সেই বিষয়ক, তার সঙ্গে কোনও ভ্যাকসিনেরই কোনও সম্পর্ক নেই। আর দ্বিতীয়টি আদৌ কোনও গবেষণা-প্রবন্ধ নয়, দু-পাতার একটি ছোট্ট মন্তব্য মাত্র। তাতে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেছেন, রোগ সংক্রমণ এবং ভ্যাকসিনের প্রভাব মাপামাপির ব্যাপারে এমন কতকগুলো ক্ষেত্রও থাকতে পারে, যেখানে ‘অ্যাবসলিউট রিস্ক রিডাকশন’ এবং ‘এন এন টি ভি’ কিছু বাড়তি তথ্য দিতে পারে, ফলে সব সময়ে ওগুলোকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। কিন্তু, নাঃ। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রচলিত মাপকাঠি (‘রিলেটিভ রিস্ক রিডাকশন’) ভয়ঙ্কর ত্রুটিপূর্ণ, বা এগুলো এখুনি ত্যাগ করা উচিত, বা এগুলোর ভিত্তিতে তৈরি কোভিড ভ্যাকসিন-গুলো অকেজো বা বিপজ্জনক, এইসব কথা তিনি আদৌ বলেননি। এখানে বলা দরকার, ‘অ্যাবসলিউট রিস্ক রিডাকশন’ এবং ‘এন এন টি ভি’ হিসেবদুটোকে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মাপকাঠি হিসেবে সাধারণত গ্রহণ করা হয়না, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোর ওপর নির্ভর করা যায় না, যেহেতু এগুলোর মাপ ‘বেসলাইন রিস্ক’-এর সঙ্গে সমানুপাতিক নয় (তার খুঁটিনাটি হিসেব এখানে জরুরি নয়)। আসলে এখানে লেখক সেইসব মার্কিন অ্যান্টি-ভ্যাক্সারদের তৈরি ভুয়ো খবর ছড়াবার দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র, যারা এই ছোট্ট মন্তব্যটিকে ব্যবহার করে ভ্যাকসিন-বিরোধী গুজব ছড়াবার চেষ্টা করছে, এবং সোশাল মিডিয়া গরম করে তুলছে। তাঁদের মন্তব্যের এ ধরনের অপব্যবহার হচ্ছে, এ কথা জানার পরে ওই মন্তব্যের [৪৩] প্রধান লেখক পিয়েরো ওলিয়ারো যা বলেছেন, সেটা এখানে রাখা থাক।
When asked about the claim, Olliaro, professor of poverty related infectious diseases at the Centre for Tropical Medicine and Global Health of Oxford University told Reuters via email it was “extremely disappointing to see how information can be twisted.” He also said, “Bottom line: these vaccines are good public health interventions,” and added that in the commentary, “We do not say vaccines do not work.” [১২]
(১০) এরপর লেখক টেনেছেন ভ্যাকসিনের ‘রিস্ক-বেনিফিট’ হিসেবের প্রসঙ্গ। তাঁর বক্তব্য, কোভিড-এর ভ্যাকসিন-গুলো ভয়ঙ্কর বাজে, কারণ, তার লাভক্ষতির হিসেবে বিপজ্জনক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে — ভ্যাকসিন দিয়ে যদি তিনজনের প্রাণ বাঁচে, তো দুজন মরছে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায়। যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা ভয়ঙ্কর তো বটেই! কিন্তু, এমন সাংঘাতিক কাণ্ড যে ঘটছে, সেটা লেখক জানলেন কোত্থেকে? কোত্থেকে আবার, ‘গবেষণা’ থেকে! লেখকের দেওয়া [৪৪], [৪৬] ও [৪৭] নম্বর তথ্যসূত্রে আছে সেই ‘গবেষণা’-র উল্লেখ। এবং, হ্যাঁ। পাঠক ঠিকই ধরেছেন, এই রেফারেন্স-টিও জোচ্চুরিতে ভরপুর! এই তিনটি তথ্যসূত্রে আসলে একই গবেষণাপত্রের উল্লেখ আছে, এবং প্রকাশের পরেই তার বিরুদ্ধে তথ্য ও তার ব্যাখ্যায় কারচুপির অভিযোগ আসে, এবং সংশ্লিষ্ট পত্রিকা সেটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২১ সালের ২৪ জুন এটি প্রকাশিত হয়, ২৮ জুন এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে পত্রিকা একটি নোটিশ দেয়, এবং ২ জুলাই এটি প্রত্যাহৃত হয়। ২৮ জুন প্রকাশিত নোটিশে লেখা হয়, “Serious concerns have been raised about misinterpretation of the data and the conclusions. The major concern is the misrepresentation of the COVID-19 vaccination efforts and misrepresentation of the data, e.g., Abstract: “For three deaths prevented by vaccination we have to accept two inflicted by vaccination”. Stating that these deaths linked to vaccination efforts is incorrect and distorted.” তারপর ২ জুলাই ‘রিট্র্যাকশন নোটিস’ বা প্রত্যাহার-বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়, “Unfortunately, in the manuscript by Harald Walach et al. these data were incorrectly interpreted which led to erroneous conclusions. The data was presented as being causally related to adverse events by the authors. This is inaccurate. In The Netherlands, healthcare professionals and patients are invited to report suspicions of adverse events that may be associated with vaccination. For this type of reporting a causal relation between the event and the vaccine is not needed, therefore a reported event that occurred after vaccination is not necessarily attributable to vaccination. Thus, reporting of a death following vaccination does not imply that this is a vaccine-related event. There are several other inaccuracies in the paper by Harald Walach et al. one of which is that fatal cases were certified by medical specialists. It should be known that even this false claim does not imply causation, which the authors imply. Further, the authors have called the events ‘effects’ and ‘reactions’ when this is not established, and until causality is established they are ‘events’ that may or may not be caused by exposure to a vaccine. It does not matter what statistics one may apply, this is incorrect and misleading.”
হ্যাঁ, লেখকের দেওয়া তথ্যসূত্রগুলো ভাল করে ঘাঁটলেই এ সব জানা যাবে। এবং হ্যাঁ, লেখকদেরকে এ সমালোচনার জবাব দিতে আহ্বান করা হয়েছিল, কিন্তু সদুত্তর পাওয়া যায়নি, এটাও ওই নোটিশেই লেখা আছে। এর পর এ ব্যাপারে আর কিছু বলার থাকে কি?
(১১) কোভিড-এর ভ্যাকসিন নিয়ে যে আদৌ সুফল মিলছে না, সেটা প্রমাণ করার জন্য লেখক একটি গবেষণার উল্লেখ করেছেন, তাঁর [৪৮] নম্বর তথ্যসূত্রে। সেখানে দেখানো হচ্ছে, ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরের গোড়ায় সারা পৃথিবীতে বিগত সাত দিনের সংক্রমণের খতিয়ান নিয়ে দেখা গেছে, যে দেশে সম্পূর্ণ টিকাকরণ যত বেশি হয়েছে, সে দেশে সংক্রমণ সেই অনুপাতে কম তো নয়ই, উল্টে সামান্য বেশি! ভ্যাকসিন-বিরোধীদেরকে উত্তেজিত করার মত সংবাদ, সন্দেহ নেই। এখন মুশকিলটা হচ্ছে, কোভিড ভ্যাকসিন যে প্রত্যাশার অতীত কাজ করেছে সে কথাটা আমি মূল লেখায় বলেছিলাম, এবং তার সমর্থনে সারা পৃথিবীব্যাপী অতি সাম্প্রতিক মেটা-অ্যানালিসিস ভিত্তিক গবেষণাকর্মের উল্লেখও করেছিলাম। লেখক সে সব বুঝতে পারেন নি, নাকি তার উল্লেখ খুব নিরাপদ বলে মনে করেন নি, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কোভিডের ভ্যাকসিন-গুলো যে সারা পৃথিবীতেই চমৎকার কাজ করছে, এবং এখনকার সংক্রমণ ও মৃত্যু ও অন্যান্য বিপদগুলো যারা ভ্যাকসিন নেয়নি তাদের ওপরই যে অনেক বেশি করে হচ্ছে, এ নিয়ে বিস্তর কাজকর্ম আছে, অন্তর্জালে খুঁজলেই পাওয়া যায়। কাজেই, এখানে নতুন করে তার উল্লেখের আর বোধহয় দরকার নেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুশকিল হচ্ছে, লেখক-উল্লেখিত গবেষণাটি পুরোদস্তুর গবেষণা নয়, গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি মাত্র, এবং তারও বহু সমালোচনা হয়েছে। সমালোচকেরা বলেছেন, কোভিড সংক্রমণের হার কম বা বেশি থাকাটা শুধু ভ্যাকসিনের ওপরেই নির্ভর করেনা, সামাজিক অর্থনৈতিক ভৌগোলিক নানা বিষয়ের ওপরও নির্ভর করে, অথচ তথ্য-বিশ্লেষণের সময়ে সেগুলোর কথা মোটেই মাথায় রাখা হয়নি (এ ছাড়াও আরও বহু সমালোচনা আছে, যদিও)। আর তার ওপর, গবেষক নিজেই বলেছেন, তাঁর চিঠির ওপর ভিত্তি করে যে সব ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রচার হচ্ছে, তিনি নিজে তা মোটেই সমর্থন করেন না। তাঁর নিজের ভাষায়, “Concluding from this analysis that vaccines are useless is misleading and inaccurate. Rather, the analysis supports vaccination as an important strategy for reducing infection and transmission, along with handwashing, mask-wearing, proper ventilation and physical distancing.” [১৩]
(১২) আমি আমার মূল লেখায় বলেছিলাম, “সুইডেন লকডাউনের অকার্যকারিতার দৃষ্টান্ত নয়, বরং ঠিক উল্টো। সুইডেনের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, পোক্ত ও সুশৃঙ্খল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং মানবোন্নয়নের সুদীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাস-ওয়ালা একটি অত্যন্ত উন্নত দেশেও কোভিড বিধি অমান্য করলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে।”। লকডাউনের যে আদৌ কোনও দরকার নেই, এই কথাটাকে তুলে ধরার জন্য সুইডেনের দৃষ্টান্তকে যেভাবে টানা হয়, তার বিরোধিতা করার জন্যই আমি কথাগুলো বলেছিলাম। স্বভাবতই, তার সপক্ষে যথাযথ সূত্র-নির্দেশে ত্রুটি রাখিনি। যথারীতি, লেখক আবারও আমার যুক্তি বা তথ্যসূত্রগুলো সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্য না করে খুশিমত নানা প্রবন্ধ উল্লেখ করে আপনমনে নিজের কথা বলে গেছেন, এবং আমার দেওয়া তথ্যগুলো সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন, “এইসব আজগুবি তথ্যের উৎস কেউ জানে না বা জানলেও তা বলে না।“ !!! কী কাণ্ড, উৎসগুলো তো ওখানেই দেওয়া ছিল, না পড়লে জানবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে অন্তত লেখকের দেওয়া তথ্যসুত্রগুলো নিয়ে আলাদা আলোচনার কষ্টস্বীকার আর করছিনা, শুধু পাঠককে অনুরোধ করব আমার মূল লেখার সুইডেন সংক্রান্ত অংশটি আরেকবার পড়ে নিতে। শুধু একটা মন্তব্য করে সুইডেন-প্রসঙ্গ শেষ করব। সেটা এই যে, লেখক সম্ভবত আমার একটি সাদা বাংলা বাক্যাংশ আদৌ বুঝতে পারেন নি, তার ফলেই যত অবান্তর বকোয়াস। ইউরোপের সমস্ত দেশের তুলনায় সুইডেনের কোভিড সংক্রমণ বা মৃত্যু বেশি, আমি আদৌ এমন দাবি করিনি, এবং তা হবার কথাও ছিল না। সুইডেনের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক শক্তি, চিকিৎসা-ব্যবস্থা, জন-ঘনত্ব ইত্যাদি নানা বিষয় ইটালি-ব্রিটেন-স্পেন-জার্মানি ইত্যাদি দেশগুলোর থেকে আলাদা, ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু সেখানে এমনিতেই কম হবার কথা। আমি বরং লিখেছিলাম, সুইডেনে, “সংক্রমণ ও মৃত্যু হুহু করে বাড়তে থাকে, এবং বছরখানেক পরে সংক্রমণ হার গিয়ে দাঁড়ায় সমতুল্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের দশ গুণ”। লেখক এটি উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু ‘সমতুল্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের’ অংশটির অর্থ বুঝতে পারেননি। এই ‘সমতুল্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের’ মানে ইটালি-ব্রিটেন-স্পেন-জার্মানি নয়, বরং একই ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক শক্তি, চিকিৎসা-ব্যবস্থা, জন-ঘনত্ব ইত্যাদির শরিক অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, অর্থাৎ ডেনমার্ক নরওয়ে ফিনল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো। এদের সকলেরই কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যু সুইডেনের তুলনায় অনেক কম ছিল, কারণ এরা সকলেই লকডাউন করেছিল। অতএব, সুইডেনে কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যু যে ইটালি-ব্রিটেন-স্পেন-জার্মানি ইত্যাদি দেশের তুল্যমূল্য ছিল, এটা মোটেই তার লকডাউন না করার সিদ্ধান্তের সাফল্যের প্রমাণ নয়, বরং সে সিদ্ধান্তের মস্ত ব্যর্থতারই প্রমাণ।
লেখক অভিযোগ করেছেন, সুইডেনের লকডাউন-বিরোধী অবস্থানের সমালোচনা করে আমি নাকি সে দেশের স্বাস্থ্য-কর্তাদের অপমান করেছি। অভিযোগটি করছেন এমন একজন, যিনি নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ ভুয়ো তথ্য ও খবরের দোহাই দিয়ে গোটা পৃথিবীর চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য-কর্তাদের বিরুদ্ধে উদ্ভট সব ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনছেন। ভাঁড়ামো আর কাকে বলে!
আমার জবাবটি অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে গেল, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। এভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ ভুয়ো খবর ও যুক্তিবোধরহিত আশ্চর্য উদ্ভট সব অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক ভয়ঙ্কর ক্লান্তিকর পণ্ডশ্রম, এবং এতে করে নতুন তথ্য বা উপলব্ধিও কিছুই বেরিয়ে আসেনা। তবুও ঠিক সেটাই করতে হল, কারণ গুজব ছড়াচ্ছে দাবানলের মত, এবং পেশাগতভাবে যাঁদের দায়িত্বশীল হবার কথা এমন লোকজনও তাতে ইন্ধন যোগাতে নেমেছেন। ফলে, এ পণ্ডশ্রম এড়াবার উপায় ছিল না একদমই।
শেষে আর দুয়েকটা সামান্য কথা বলে এবার পাঠকের কাছ থেকে বিদায় নিই। লোকে রোগ আর ভ্যাকসিন নিয়ে এইসব বাজে কথা কেন বলে, কেন ছড়ায়? তারা কী রোগে ভুগতে বা মরতে ভালবাসে? না, মোটেই নয়, বরং তারা রোগের বিপদটা বোঝে না, এবং নানা রক্ষণশীল কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকে, আর বিভ্রান্তির সময়ে ঘুরে বেড়ানো নানা কথার মধ্যে যেটা তার পূর্ব-ধারণার সমর্থক বলে মনে হয় সেটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু, এ সবের পেছনে কাজ করে এক ধরনের মতাদর্শগত প্রভাবও। অন্য অনেককে বাঁচাবার জন্যে আমাকে মুখোশ পরতে হবে, কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকতে হবে, ভ্যাকসিন নিতে হবে — এ ধরনের যুক্তি আমেরিকার কট্টর ব্যক্তি-স্বার্থবাদী দক্ষিণপন্থীরা একদমই পছন্দ করেনা। আর তার ওপর, তারা এটাও মনে করে যে, রোগভোগকে খানিকটা নিজের মত করে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কারণ, তাতে করে দুবলা-পাতলা-বুড়ো-হাবড়ারা মরে গিয়ে সমাজের বোঝা কমে, সুস্থ-সক্ষম-কর্মঠ লোকেদের অনুপাত বাড়ে। এ মনোভাব বর্বরোচিত হলেও, দক্ষিণপন্থীরা জানে, তারা ঠিক কী বলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের তৈরি ভুয়ো খবরগুলো নির্বিচারে গিলে এখানকার বামপন্থীদের যে অংশটি বিগফার্মা-বিরোধী এবং জনদরদী রেটোরিক সহকারে সোশাল মিডিয়াতে তা ঢালছে, তারা নিজেরাই কিন্তু জানে না যে তারা কী বলছে!
একটা কথা আলোচ্য লেখাটির লেখককেও বলে যাই, শুধু একটাই মাত্র কথা। নিজেকে বিগফার্মা-বিরোধী এবং জনস্বাস্থ্য-দরদী ব্যক্তি বলে যদি মেলে ধরতে চান, সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ভালমন্দ নিয়ে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তো প্রতিপক্ষের বক্তব্য মন দিয়ে শুনতে ও বুঝতে হবে, ‘প্রমাণ’ ও ‘খণ্ডন’ কী বস্তু সে সব জানতে হবে, ভুয়ো তথ্য-গবেষণা-খবরের সঙ্গে সত্যিকারের জ্ঞানের তফাতটা জানতে হবে। নিজেকে জনদরদী বলে দাবি করতে ভালই লাগে, কিন্তু সে দাবির যোগ্য করে নিজেকে তো নির্মাণও করতে হয়।
হয় না, বলুন?
তথ্যসূত্র
গুরুচন্ডালী ওয়েবম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত।