ওটিটি প্লাটফর্মে শিরদাঁড়ায় শিহরণ জাগানো থ্রিলারের থেকেও গল্পটা ভয়ানক। এ যেন সারা বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্রের নক্সা বিছানো রয়েছে। সন্দেহ হয়, আর হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। একবার কল্পনা করুন তো, পৃথিবীর তাবড়-তাবড় রাষ্ট্রনেতারা গোপন বৈঠকে ঠিক করলেন যে করোনা ভাইরাসের জুজু দেখিয়ে জনসাধারণের বিভিন্ন ধরনের অভাব অভিযোগ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখবেন। ফলে বিশ্বকাপের মেসি ম্যাজিক শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলো করোনার ঢেউ আবারও ছোবল মারছে। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো রাজনৈতিক স্বার্থে।
আবার এমনও হতে পারে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কিনে ফেললো পলিসি মেকারদের। দামী দামী ওষুধ ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করার জন্য ডাক্তারদের চোখের সামনে আনলো কিছু মনগড়া স্টাডির রিপোর্ট। মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হতে থাকলো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি।
আরেকটা সম্ভাবনাও রয়েছে। চিন এক অদ্ভুত বায়োলজিক্যাল অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। সারা পৃথিবীকে কব্জা করতে মৃত্যু জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকে দিকে। সেই ভাইরাসই এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে তাদের দেশে। দিশেহারা তারা।
হ্যাঁ, এই সম্ভাবনাগুলো হাওয়ায় ভাসছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, বেপরোয়া আড্ডায় চায়ের কাপে তুফান তুলছে। সম্ভাবনাগুলো সত্যি হলে মানবসভ্যতার সঙ্গে যে বড়োই তঞ্চকতা করা হয়ে যাবে। স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি বলে যে এগুলো সত্যি নয়। কখনোই সত্যি হতে পারেনা।
বরং সাদা চোখে যেটা সত্যি সেটাই মেনে চলি। কারণ আমরা যে ঘর পোড়া গরু। করোনার আগের ঢেউগুলোতে মৃত্যু মিছিল দেখেছি আমরা। প্রিয়জন হারানোর বেদনা এখনো দগদগে ক্ষত। আরেকটা লকডাউন আমরা দেখতে চাইনা।
চিনে আরেকপ্রস্ত করোনার ঢেউ উঠেছে। ওখানকার সংবাদপত্রগুলো একদিন ছেপেই বসলো যে শাংহাইয়ের হাসপাতালগুলো এবার ভয়ানক যুদ্ধের মুখোমুখি। শ্যাংক্সি প্রদেশের টংচুয়ান শহরে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের কোভিড যুদ্ধে নামানো হচ্ছে। তারমধ্যে অবশ্য চৈনিক ম্যাজিক অব্যাহত। চিনের এক স্বাস্থ্যকর্তা বলে বসেছেন যে একেকটি শহরে প্রতিদিন পাঁচলক্ষ করে মানুষ কোভিড আক্রান্ত হচ্ছে। ম্যাজিকে সেই ভদ্রলোকের বক্তব্য সমস্ত মিডিয়া থেকে ভ্যানিস প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সুতরাং সঠিকভাবে চিনকে চেনা চিন্তার বইকি। চিনের মহামারি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ ফেইজেল ডিং তাঁর টুইটে লিখেছেন যে মর্গে জায়গা নেই, হাসপাতালের সামনে ব্যাগে ভরে রাখতে হচ্ছে মৃতদেহ। অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, রক্তেরও আকাল। এই নাকি চিনের বাস্তব পরিস্থিতি। শুধু চিন কেন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, হংকংয়ের অবস্থা বেশ খারাপ বলে খবর। ওই পাঁচ দেশ থেকে আসলে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক করেছে ভারত সরকার।
ভারতের স্ট্যান্ড পয়েন্ট কিন্তু বেশ সদর্থক। চিনকে জ্বরের জন্য ওষুধ পাঠাতে প্রস্তুত ভারত। সারাদেশ জুড়ে ‘মক ড্রিল’ মোটামুটি সাফল্যের সাথে করা গেছে। নদিয়া জেলা হাসপাতালের দুই ক্যাম্পাসেই মক ড্রিল ঠিকঠাক করা গেছে। প্রস্তুত জে এন এম হাসপাতালও। রাজ্য সরকার জানিয়েছে ২৩টি জেলার সঙ্গে আরও পাঁচটি স্বাস্থ্য জেলা যুক্ত করে মোট আটাশটি জেলায় মোট ৩৬টি সরকারি আরটিপিসিআর পরীক্ষাগার হয়েছে। ১৯৪টি হাসপাতালের ৩২,২৬৮টি বেড করোনা আক্রান্তদের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। ৩১১২ টি ক্রিটিকাল কেয়ারের বেডের মধ্যে বাচ্চাদের জন্য রয়েছে বারোশো বেড। একদম পুচকি বাচ্চাদের জন্যও রয়েছে ১৬০টি ‘নিকু’ অর্থাৎ নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটের বেড।
এদিকে আশার বাণী শোনাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরাও। চিনে আবার ব্যাপকভাবে করোনা ফিরে আসার জন্য ওদের ‘জিরো কোভিড’ নীতি তুলে দেওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। ঠিক মতো টিকাকরণও হয়নি ও দেশে। বিজ্ঞানী ড. সমীরণ পান্ডার মতে টিকাকরণ ও সংক্রমণের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আরেক ভাইরোলজিস্ট ড. গগনদীপ কাঙ্গের মতে ওমিক্রনের কিছু ভ্যারিয়েন্ট আগেও ভারতে দেখা দিয়েছে। তারা তেমন কিছু ক্ষতি করতে পারেনি। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদের মত যে আমাদের দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে।
এরমধ্যে আরেকটা সুখবর আছে। সেটা অবশ্য সুঁচ নিয়ে শুচিবাইগ্রস্তদের জন্য। বাজারে এসে গেছে নাকে দেবার জন্য ভ্যাক্সিন। ইনকোভ্যাক পাওয়া যাবে জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহ থেকে। এমনকি বুস্টার ডোজ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে নাকে দেবার টিকে। এই নাজাল ভ্যাক্সিনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাঙালি ভদ্রলোকেরও নাম। হাওড়া জেলার বাগনানের বিজ্ঞানী পার্থকুমার সরকার ছিলেন ইনকোভ্যাক আবিষ্কারকদের টিম মেম্বার। গর্বের বিষয় বইকি।
বিপদে মোরে রক্ষা করার প্রার্থনা আমাদের নেই। বিপদে আমি না যেন করি ভয়। আমরা শত্রুকে চিনে ফেলেছি। আমরা জানি কিভাবে আটকাতে হয় করোনাকে। অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোন ভয়েস আমাদের সেরিব্রাল কর্টেক্সে রেকর্ডেড হয়ে আছে। বারবার হাত পরিষ্কার করা এবং মাস্ক ব্যবহার করা -অন্তত এই দুটি বিষয় কদিন নাহয় সবাই মিলে মেনে চলি। আর গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকুন। না, কোনো ভয়ানক চক্রান্ত চলছেনা কোভিড নিয়ে।
পৃথিবী আবার শান্ত হবে। আবারও মেসিরা মাঠ জুড়ে দৌড়বে। কোহলির ছক্কা গ্যালারিতে আছড়ে পড়বে। করোনা পরাজিত হবে মানুষের বেঁচে থাকার আনন্দের কাছে।