এরকম রোগী আমি হামেশাই পাই। মধ্য বয়স্ক মহিলা। ঈষৎ পৃথুলা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনরকমে চেম্বারে ঢুকে ধপ করে চেয়ারে বসলেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ডাক্তার বাবু, কদিন ধরে আস্তে আস্তে ফুলে যাচ্ছি। দুই পা হাঁটলেই হাঁফ ধরে।’
এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি কোনো আয়ুর্বেদিক বাতের ওষুধ খাচ্ছেন?’
অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘আপনি কি করে জানলেন?’
উত্তর দিই ‘আপনার চাঁদ বদনই সেটা বলে দিচ্ছে।’
দুয়েকটি ক্ষেত্রে মিস ফায়ার হয়ে যায়। রোগিনী হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ থেকে বার করেন আদি ও অকৃত্রিম ক্ষুদে ক্ষুদে প্রেডনিসোলন ট্যাবলেট।
তবে যারা কবিরাজি ওষুধ খাচ্ছেন, তারাও নিঃসন্দেহে ওই ট্যাবলেটের গুঁড়োই খাচ্ছিলেন। একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে- এই যা পার্থক্য।
মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি হঠাৎ কবিরাজি শুরু করলেন কেন?’
তাঁরা উত্তর দেন, ‘এলোপ্যাথরা তো ব্যথা কমানোর জন্য পেন কিলার দেবেন। সেটা খেলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বারোটা বেজে যাবে। শুনেছিলুম কবিরাজির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।’
তাঁদের শোনার রেফারেন্সটা অত্যন্ত দূর্বল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও সবজান্তা আত্মীয় বা প্রতিবেশী। সেই সব কবিরাজি ওষুধ বন্ধ করাও একটা সমস্যা। বন্ধ করলেই খাওয়া দাওয়া, হাঁটা চলা – সব বন্ধ।
তবে অধিকাংশ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা সাধারণত এরকম ওষুধ লেখেন না। কিছু ধান্ধাবাজ হাতুড়ে চিকিৎসক ও ম্যাজিক দেখানোর আশায় কতিপয় অন্যধারার চিকিৎসক কবিরাজির প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাসটা কাজে লাগাতে চান।
এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন খামোখা কেন আমি আয়ুর্বেদ ওষুধের নিন্দা করছি। ক্ষতি যা করার সে তো অ্যালোপ্যাথি ওষুধই করেছে। অতএব দোষটা মর্ডান মেডিসিনের।
একদম সত্যি কথা। তবে একটা গণ্ডগোল আছে। কোন পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তার বাবু হাঁটু ব্যথার জন্য দুম দাড়াক্কা দীর্ঘ মেয়াদি স্টেরয়েড লিখবেন না। কারণ তিনি জানেন এভাবে ম্যাজিকের মতো ব্যথা কমানোর চেষ্টা করলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে।
আর ঠিক এখানেই ক্রস প্যাথির বিপদ। কবিরাজি ওষুধ সম্পর্কে আমার যা জ্ঞান,, আমার ধারণা বিভিন্ন মর্ডান মেডিসিন সম্পর্কে একজন অন্যধারার চিকিৎসকের জ্ঞান তার চাইতে খুব বেশি নয়।
আমি সীমিত জ্ঞান নিয়েই খুশি। ইসবগুল ছাড়া অন্য কোনো আয়ুর্বেদিক ওষুধ লিখি না। কবিরাজরাও তাঁদের জ্ঞান বুদ্ধি অনুযায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়ে গেলে আমারও বলার কিছু নেই।
সবচেয়ে অবাক লাগে, সরকার যখন এই ক্রসপ্যাথিকে বন্ধ করার চেষ্টা না করে উল্টে উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন।
আমরা দুষ্টু ডাক্তার। সরকারের সব কাজ কর্মের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াই।
ভোর কমিটি স্বাধীনতার আগের বছরই বলেছিল- এদেশে স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখনই এখনই প্রতি চল্লিশ হাজার লোক পিছু একটি পঁচাত্তর শয্যার সরকারি হাসপাতাল প্রয়োজন। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই দশ থেকে কুড়ি হাজার লোক পিছু একটি পঁচাত্তর শয্যার হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। ভোর কমিটির রিপোর্টে ছিল হাসপাতালে কতো জন চিকিৎসক থাকবে, কতো জন নার্স থাকবে। অন্যান্য কর্মচারীর সংখ্যা কতো হবে।
ভোর ক্রমশ সন্ধ্যা হয়েছে। একের পর এক কমিটি এসেছে। মুদালিয়ার কমিটি, চাঁদ কমিটি, মুখার্জি কমিটি, জঙ্গল ওয়ালা কমিটি, কর্তার সিং কমিটি, শ্রীবাস্তব কমিটি। সেই সব কমিটির বেশিরভাগ প্রস্তাবই কাগজে কলমে রয়ে গেছে।
১৯৭৭ সালের জেনিভা কনভেনশনে গৃহীত হয় ‘২০০০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যের’ লক্ষ। আপাতত মহামারীর মধ্যে সেসব নিয়ে চিন্তা করলেই অদ্ভুত লাগছে। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে বহু নিম্ন বিত্ত পরিবারকে সর্বস্বান্ত হতে দেখছি।
‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান পালটে এখন সবার জন্য স্বাস্থ্য বীমা হয়ে গেছে। বীমার নামে বেসরকারি কোম্পানি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। আর প্রিভেনটিভ মেডিসিন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ ওটা নিয়ে ঠিক ব্যবসা করা যায় না।
স্বাস্থ্য বাজেট কমতে কমতে জিডিপির মাত্র এক শতাংশের কাছাকাছি। ভিক্ষার টাকায় চলা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তবু কিন্তু এই মহামারীর সময়ে লড়ছে। কর্পোরেট হাসপাতাল গুলির অধিকাংশের ভূমিকাই বলার মতো নয়।
মহামারী যখন আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কংকাল বের করে ফেলেছে, তখন সরকার মরীয়া হয়েই ক্রসপ্যাথি আর ব্রিজ কোর্সকে উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। যার ফলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির দাবীর বদলে বিভিন্ন ধারার চিকিৎসকদের মধ্যে খেয়োখেয়ি শুরু হয়েছে। হয়তো তাতে সরকারি কর্তৃপক্ষ খুশিই হচ্ছেন।
সম্প্রতি একটি বাংলা সিরিয়ালে নাকি দেখিয়েছে একজন বিমান সেবিকা পাইলট অসুস্থ হওয়ার পর প্লেন চালিয়ে সবার তাক লাগিয়ে দেন। খুব হেসেছিলাম। কিন্তু হাসাটা উচিৎ হয়নি। কারণ এই রকম বাস্তবে সত্যিই হয়। অন্তত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
বেশ কথা বলেছেন। আমি নিশ্চিতরূপে আপনাদের পক্ষেই। আমার বেশ কিছু বন্ধুরা আছেন,তাঁদের থেকেই যা সামান্য ধারণা।
একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না, কিছুদিন আগেই গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের একটা ব্রীজ করিয়ে চিকিৎসক হওয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো এই বঙ্গেই। কলকাতার প্রথিতযশা ডাক্তারবাবু সরকারি হাসপাতালে দাঁড়িয়ে মুক্ত কণ্ঠে সমর্থন দিয়েছিলেন, কেন করা ‘ঠিক’ হবে সে নিয়ে বেশ গলা তুলেছিলেন।তখন গেল গেল রব কিছু মুষ্টিমেয় ডাক্তারবাবুই তুলেছিলেন, বাকিরা একটি রা করেননি, পরবর্তী সময়ে কোনও লেখায় এই রেফারেন্স পাইনি। হয়তোবা যিনি এই বিলের প্রবক্তা ছিলেন তিনি গত হয়েছেন বলেই, আমার অনুমান মাত্র।
হয়তো বিলটি কথা আপনার মনে আছে অথবা নেই।
এটা ঠিকই ‘চিকিৎসা’ হবে নেই ভোটের মূল্যহীন মানুষকেই, গো মূত্র হোক বা হাতুড়ি যাই দিয়ে হোকনা কেন!