শীতের রাত্রে গোপীবল্লভপুরের জঙ্গলঘেরা হাসপাতাল। নব্য সুপারস্পেশালিটি। নতুন বিল্ডিংগুলোর দেয়ালে নতুন রঙের পোঁচ পড়েছে হপ্তা খানেক আগেই। এ প্রদেশে রাতের জটিল রোগী মানেই আগে ঝাড়গ্রাম ছুটতে হতো। এখন নতুন হাসপাতালের নবীন চিকিৎসকদল সে যন্ত্রনায় প্রলেপ দিচ্ছেন বইকি।
এই তো মাস কয়েকের আগের কথা। গেলো শীতের এক রাতে গোপীবল্লভপুরের হাসপাতাল তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। ফুলমনি যখন কোলে করে ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে হাসপাতালের চকচকে মেঝেতে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এলো, তখন বাচ্চাটিকে দেখে চমকে উঠলেন এমারজেন্সির ডাক্তারবাবু। প্রবল শ্বাসকষ্ট। কাশিটা যেনো কুকুরের ডাকের মত। ছোট্ট প্রাণখানি যেন বুকের খাঁচা খুলে বেরিয়ে আসতে চায়। শ্বাসরেট ও হার্টরেট ঊর্ধ্বমুখী। বুকে স্টেথো ছুঁইয়ে ঘড়ড় ঘড়ড় আওয়াজে কান পাতা দায়। আগে হলে নির্ঘাত রেফার টু ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল। রাতদুপুরে গাড়ি ঠিক করে প্রায় ৩০ কিমি পথ উজিয়ে যেতে যেতে কত যে প্রাণ হারিয়ে গেছে গভীর শালের জঙ্গলে তার ইয়ত্তা নেই। ফুলমনির কথা বলার শক্তিটুকুও নেই। ফ্যালফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আর অঝোরাশ্রু বর্ষণ ছাড়া কিইই বা করার আছে। হাঁড়িয়া খাওয়া মরদটা দেওয়ালের এক কোনে সিঁটিয়ে আছে ভয়ে আর লজ্জায়। এমারজেন্সির ডাক্তারবাবু মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে নেবুলাইজেসানের ব্যবস্থা করতে বলে নিজে চ্যানেল করতে বসলেন। বছর চারেকের শ্যামরঙ্গা শিশু। এক্ষেত্রে চ্যানেল করা যে কি বিষমবস্তু তা ভুক্তভোগীরাই জানেন । বারদুয়েকের চেষ্টায় বিফল হয়ে শিশু চিকিৎসক শুভদীপবাবুকে ডাকার পরামর্শ দিলেন। ডাঃ শুভদীপ। সদ্য পাশ করা শিশু রোগের চিকিৎসক। হালে এসেছেন এখানে।
আধপাকা ঘুম ছাড়িয়ে শুভদীপবাবু যখন ছুটে এসেছেন ততক্ষণে লেভোস্যালবিউটামল আর বুডেসোনাইডের নেবুলাইজেশান কমপ্লিট। কিন্তু উন্নতি নেই। ফুলমনি হাল ছেড়ে গা এলিয়ে মাথার চুল মুঠি করে একদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে। ডাঃ শুভদীপ বাচ্চাটির বুকে স্টেথোস্কোপ ছুঁইয়ে ফুলমনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – জ্বর ছিলো? ফুলমনি ঝাড় ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানানোর পর বাচ্চাটির মুখ খুলে টর্চ দিয়ে কি একটা দেখে মাথা দুলিয়ে সিষ্টার দিদিকে বললেন “অ্যাড্রিনালিন আর বুডেসোনাইডের নেবুলাইজেসন করতে হবে।তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন”। সিষ্টার দিদি ছুটলেন বটে। কিন্তু অ্যাড্রিনালিনের নেবুলাইজেশান? সে তো ইঞ্জেকশন হিসেবেই ব্যবহার হতে দেখা যায়।আর তা ছাড়া অ্যাড্রিনালিনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া? সে তো আর এক বিপদ। কি যে বলেন ডাক্তারবাবু! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সাপেকাটা রোগীর ওষুধের ট্রে থেকে ছোট্ট অ্যাড্রিনালিনের অ্যাম্পুল তুলে দিলেন চিকিৎসকের হাতে। মুহূর্তের মধ্যে 1:1000 ডাইলুসানে বুডেসোনাইডের সাথে নেবুলাইজেশান শুরু করলেন শুভদীপ ডাক্তার। অবাক ব্যাপার। ওষুধ যেন কথা কইতে শুরু করলো। ঘড়ড় ঘড়ড় আওয়াজটা যেনো ধীরে ধীরে কমে আসছে। তারপর যতক্ষণে অ্যান্টিবায়োটিক রেডি হলো ততক্ষণে সে আওয়াজ অস্তাচলে। শান্ত হয়েছে বাচ্চার মুখ। ডাক্তারবাবুর কর্মকান্ডে ফুলমনির চোখে আশার আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে তখন। এতক্ষণের লুকিয়ে চোখের জল ফেলা মরদটাও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারবাবুর হাত দুটো জড়িয়ে ধরতে চায় সে।
সকলের যুদ্ধজয়ের ক্ষণিকের স্বস্তিতে জল ঢেলে শুভদীপ ডাক্তার বললেন – এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। অক্সিজেন স্যাচুরেশান ঠিক থাকলেও বাচ্চাটি এখনও ভরতি থাকবে। অ্যান্টিবায়োটিক আর স্টেরয়েড লিখে দিলাম। মুখে পর্যাপ্ত জল খাওয়ান। কাল সকালে এক্সরে করে ব্যবস্থা। এ রোগের নাম ল্যারিঙ্গোট্র্যাকিয়োব্রঙ্কাইটিস। সহজ ভাষায় “ক্রুপ”। শিকার মূলত এক থেকে পাঁচ বছরের শিশু। কারণ মূলত ভাইরাল ইনফেকশন। প্রধানত প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা।তার কারণে উপরের শ্বাসনালীর ইনফ্ল্যামেশান। সেই হেতু শ্বাসনালী ফুলে গিয়ে শ্বাসপথের সংকোচন। ফলস্বরূপ প্রবল শ্বাসকষ্ট। প্রধানত বুকের ওপরের অংশে প্রশ্বাসকালীন স্ট্রাইডর, বা ঘড়ড় ঘড়ড় আওয়াজ। বাচ্চা ধীরে ধীরে অস্থির হতে শুরু করে। শ্বাসপথের সংকোচনে রক্তে অক্সিজেনের অভাব সমস্যা আরও ঘোরতর করে তোলে। হালকা জ্বর দিয়ে শুরু। রোগের শুরুতেই যথাযথ চিকিৎসা জরুরি। নিউমোনিয়া আর এ রোগের তফাত করতে অভিজ্ঞ দৃষ্টি অনিবার্য ।
অনেকসময় শ্বাসপথের সংকোচন আরও অনেক বেড়ে গিয়ে ঘড়ড় ঘড়ড় আওয়াজও বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক ভাবে একে রোগের উন্নতির লক্ষণ ভেবে ভুল করেন অনেকেই। তাতে প্রাণহানির শংকা বাড়ে। তাই প্রাথমিক ভাবে সঠিক রোগনির্ণয় ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী।
ফুলমনি আর সিষ্টার দিদির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন শুভদীপ বাবু। বাচ্চাটির শান্ত কোমল মাথায় হাত বুলিয়ে কোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দিলেন তিনি।
হাঁড়িয়া খাওয়া ফুলমনির মরদটা চোখ মুছে গামছার কোঁচা থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করেও থমকে গেল। সস্তা দামের বিস্কুট ডাক্তার বোধহয় খায় না।