ধরুন, লকডাউনে আপনি ঘরবন্দী। খাচ্ছেন-দাচ্ছেন-ঘুমোচ্ছেন। হয়ত অ্যামাজন প্রাইমে প্যারাসাইট দেখছেন কিম্বা নেটফ্লিক্সে মানি হেইস্ট রিভাইজ দিচ্ছেন। এমন সময় কেউ আপনার দরজায় কড়া নাড়ল। ‘অসময়ে আবার কে?’ -বলে ব্যাজার মুখে দরজা খুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার সরকারী মেডিক্যাল টিম। একজন ডাক্তার, একজন নার্স আর দু-জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। তাঁরা আপনার গত কয়েকদিনের মেডিক্যাল হিস্ট্রি নোট করলেন। COVID-19-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ আছে কিনা টেস্ট করলেন। যদি টেস্ট নেগেটিভ হয় তাহলে ‘থ্যাঙ্কু, গুড বাই’ বলে, আপনাকে আবার নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইমের দুনিয়ায় ছেড়ে আপনার প্রতিবেশীর ঘরে চলে গেলেন।
কিন্তু ধরুন, আপনার জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্টের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গেলো। তখন ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আপনার দুয়ারে অপেক্ষা করবে অ্যাম্বুলেন্স। আপনার পরিবারের সকলকে আবশ্যিক কোয়ারেন্টাইনে পৌঁছে দিতে আর আপনাকে নিকটবর্তী পলিক্লিনিকে নিয়ে যেতে। পলিক্লিনিক মানে অত্যাধুনিক প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, অপ্টোমেট্রি, এন্ডোস্কোপি, ম্যাটনারনাল চাইল্ড কেয়ার, ডায়াবেটিক, পেডিয়াট্রিক্স, গাইনকোলজি, কার্ডিওলজি সহ ২২টি জরুরী পরিষেবা যুক্ত সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার দ্বিতীয় স্তর। পলিক্লিনিকে জরুরী পরীক্ষায় যদি দেখা যায় আপনার সংক্রমণ গুরুতর এবং অচিরেই ভেন্টিলেশেনের প্রয়োজন পড়তে পারে তাহলে আপনাকে স্থানান্তরিত করা হবে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার তৃতীয় কিম্বা চতুর্থ স্তরে। অর্থাৎ হসপিটালে কিম্বা মেডিক্যাল স্কুলে। না হলে আপনি বিন্দাস রইলেন পলিক্লিনিকে। আইসোলেশেনে আর অবজারভেশেনে¹।
কি ভাবছেন স্বপ্ন দেখছি? ঘরে বসে খেয়ালি পোলাও রান্না করছি? বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেডিক্যাল টিমের এভাবে রোগ নির্ণয় সম্ভব নাকি? সম্ভব! হচ্ছেও! তবে সেটা কিউবাতে। আসলে কমিউনিটি ক্লিনিক-পলিক্লিনিক-হসপিটাল-মেডিক্যাল স্কুল, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার এই পিরামিড প্যান্ডেমিকের মোকাবিলায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কোন স্ট্রাকচার নয় বরং গত ৫০ বছরের ধারাবাহিক সরকারী স্বাস্থ্য নীতির ফসল। ‘Alma-Ata’; WHO যখন প্রাথমিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা কে গোটা বিশ্বে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে সার্বজনীন করার ডাক দিয়েছিল ১৯৭৮-এ, কিউবার এই প্রজেক্ট তারও আগের, ১৯৭০-র।
সেই প্রজেক্টের হাত ধরেই কিউবা জুড়ে গড়ে ওঠে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার নিউক্লিয়াস ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৃত্তে প্রতি ১৫০টি পরিবার পিছু গড়ে একটি। ডাক্তার, নার্স ছাড়াও মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের তিন বছর দেশের কোন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করা কিউবায় বাধ্যতামূলক। বছরের প্রতিদিন সকালে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে আউটডোর। বিকেলে ঐ ভৌগোলিক বৃত্তে মেডিক্যাল টিমের ফিল্ড ভিজিট, ক্রনিক রুগীদের চেক-আপ। আর সপ্তাহান্তে কমিউনিটি ক্লিনিকের জরুরী রুগীদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম যায় পলিক্লিনিকে। দেশের মোট ৪৯৮টি পলিক্লিনিকের ঘাড়ে গড়ে ২০-৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগীদের সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত। মোটামুটি কিউবার ৯৫% চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিক কিম্বা পলিক্লিনিকেই সীমায়িত। বাকি ৫%-র জন্য আছে ১৫০টি ন্যাশনাল হসপিটাল। ১৪টি মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। এবং অবশ্যই দুনিয়ার বৃহত্তম মেডিক্যাল স্কুল ELAM। যেখানে পড়াশোনা করে ১১০টি দেশের ২০,০০০ স্টুডেন্ট। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, স্টাইপেন্ড সহ।
অবশ্য শুধু পড়াশুনা না, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার আলপিন টু এলিফ্যান্ট সবটাই সরকারী এবং বিনামূল্যে। ওষুধও বিনামূল্যে কিম্বা ভর্তুকিতে। উন্নয়নশীল দেশ তো ছেড়েই দিন, এমনকি উন্নত দেশের তুলনাতেও স্বাস্থ্য-পরিষেবার সূচকে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে কিউবা। প্রতি ১০০০ জনে কিউবা তে ডাক্তার ৮.২। আমেরিকায় ২.৬, ভারতে ০.৮⁶। নাগরিকদের গড় আয়ু ৭৯। আমেরিকায় ৭৮, ভারতে ৬৮। স্কিল্ড তত্ত্বাবধানে প্রসব কিউবায় ১০০%। আমেরিকায় ৯৯%, ভারতে মেরে কেটে ৮১%⁸। কিউবা তে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১২.১৯%, ভারতে ১.২%। এমনকি শুনলে অবাক হবেন যে উত্তাল আটলান্টিকের কোলে বসেও শেষ ১৭টি ঘূর্ণি ঝড়ে কিউবাতে মারা গেছেন মাত্র ৩৫জন। আর শুধু ২০০৮-র ঘূর্ণিঝড়ে আমেরিকা তে মারা গিয়েছিল ১৮০০জন।
‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে’ বলে পাড়া মাথায় তোলা দাদা-বৌদিরা রাগ করবেন না প্লিজ। ক্যাপিটালিজমের পা চাটা দালালরা বিরক্ত হবেন না প্লিজ। কারণ উপরের তথ্যগুলো চে গেভেরার ‘মোটরসাইকেল ডাইরিজ’-এ নেই বরং আছে WHO-র ওয়েবসাইটে। তাই আজকে যে শুনছেন কিউবার অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ Interferon Alfa-2B করোনার চিকিৎসাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে, আজকে যে শুনছেন বিশ্বের ৪৫টি দেশে কিউবার ডাক্তাররা করোনা ভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসা করছেন, আজকে যে শুনছেন করোনা আক্রান্ত যাত্রীসহ জাহাজকে বিশ্বের তাবড় দেশ নোঙর ফেলতে না দিলেও কিউবা বুকে টেনে নিচ্ছে -এর কোনটাই ফ্লুক কিম্বা পিসি সরকারের ম্যাজিক নয়।
আসলে, হোক না কিউবা বহু দেশের তুলনায় অর্থনীতিতে চুনোপুঁটি, থাক না যতই বিপ্লব পরবর্তী ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার অর্থনৈতিক বয়কট, হলেই বা ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পারিশ্রমিক কম; তবুও লড়াইয়ে হার মানতে, বশ্যতা স্বীকার করতে জানে না একরত্তির ঐ কিউবা। স্বাস্থ্য-পরিষেবা নিয়ে ব্যবসা করে না কিউবা। মানুষের জীবনকে প্রফিট মেকিং-র পণ্য করে ফি-বাজারে বিক্রি করে না কিউবা। ফিদেল কাস্ত্রো বলতেন কিউবার ডাক্তাররা কেবল ডাক্তার না, তাঁরা ‘সাদা পোশাকের সৈনিক’।
আমাদের দেশেও তাই! করোনা প্যান্ডেমিকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে প্রতিদিন যে অসংখ্য ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্য কর্মীরা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠায় প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন তাঁরাও আমাদের দেশের ‘সাদা পোশাকের সৈনিক’। আমরা জানি যে দেশে গড়ে হসপিটাল বেড ১টি/১,৮২৬জন, ডাক্তার ১টি/১১,৬৬০জন, আইশোলেশেন বেড ১টি/৮৪,০০০জন আর ভেন্টিলেটর ১টি/৩,৩৩,৩৩৩জন -সে দেশের ‘সাদা পোশাকের সৈনিক’দের জন্য যুদ্ধটা আরও কঠিন। আমরা জানি রাতারাতি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-পরিষেবা কিউবার মত হয়ে যাবে না। কিন্তু সরকারী পলিসি মেকিং-র অগ্রাধিকার তো বদলাতে পারে। তাই ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য-পরিষেবার কঙ্কালসার চিত্রের বদল চাইলে, আমাদের ‘সাদা পোশাকের সৈনিক’দের ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার বানানো বন্ধ করার স্বার্থে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে কি “এই সময় রাজনীতি করবেন না” বলে হুমকি দেবেন?
দিলে দেবেন! কিন্তু প্রশ্ন আমরা করবই! প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন জর্জরিত তখন সরকার কেন ৮৮০কোটি দিয়ে ইজরাইল থেকে ১৬,৪৭৯টি মেশিনগান কিনছে? যেখানে ঐ একই পরিমাণ টাকায় এই মুহূর্তে দেশে ১৬,০০০ নতুন ভেন্টিলেটর বানানো যেত। প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে সরকার কেন আপনার-আমার ট্যাক্সের ২০হাজার কোটি খরচা করে সেন্ট্রাল দিল্লি ও পার্লামেন্টকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করছে? যখন করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য-খাতে মাত্র ১৫ হাজার কোটি বরাদ্দ হয়েছে। প্রশ্ন করব যে সরকার স্রেফ কলমের খোঁচায় ৭.২৭ লক্ষ কোটির কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করতে পারছে, সেই সরকার কেন নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরে, মাত্র ১.৭লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজে আই-ওয়াশ করছে? সরকারকে ছাড়ুন, আপনিই না হয় বলুন। এখন কোনটা বেশি জরুরী মেশিনগান না ভেন্টিলেটর? পার্লামেন্টে সাজানো না পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে ঘরে ফেরানো? কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব না স্বাস্থ্য-কর্মীদের মাস্ক, কিট?
কিউবা না হয় নাইবা হলেন, ট্রাম্পের নমক খেয়ে ফিদেলের প্রশংসা না হয় নাই বা করলেন, সমাজতন্ত্র না হয় নাই বা চাইলেন, কমিউনিস্টদের না হয় ঘেন্নাই করলেন; কিন্তু মানবিক তো হতেই পারেন। সুলভ স্বাস্থ্য-পরিষেবার দাবীতে আওয়াজ তো তুলতেই পারেন। মানুষের জীবনকে পণ্য করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো করতেই পারেন। না ক্যাপিটালিজমের আফিমে বুঁদ হয়ে ‘প্রফিট’-এর অঙ্ক কষলে অমানবিক হতেই হয়?
???
আসাধারণ sir
Hi I am a Canadian citizen, I have been to Cuba and I almost had a heart attack reading this when a friend sent it on my way.
I have multiple Cuban friends who immigrated to Canada for a better life and I am sure , they would go through the same feeling had they have known how to read Bengali.
I am not here to elaborate on the miserable life of Cubans, I only want to say while writing something, it’s better to rely on data than that of dream. Since this article talks about Netflix, the same platform plays a series called The Cuba Libre Story..it’s perhaps a better idea to have a look there.