সাইবার ক্রাইম সেকশানের অসীম চ্যাটার্জী বলল, ‘ব্যাঙ্কের ট্রানজাকশান গুলো সাবধানে করতে পারেন না, ম্যাডাম?’
‘সাতদিন হয়ে গেল আপনারা তো কিছুই করতে পারলেন না!’
‘কিছু করতে পারলাম না, কে বলল?’
‘এখনো পর্যন্ত কোনো পজিটিভ খবর শোনাতে পারলেন কই?’
অমৃতা ব্যানার্জী বাংলা সিনেমা ও সিরিয়ালের অভিনেত্রী। তার প্রায় বারো লাখ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে।
আজকাল এই অতিমারীর সময়ে ডিজিটাল জালিয়াতি খুব বেড়ে গেছে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ওয়ালেট গুলো ওদের টার্গেট। এখন আগের থেকে অনেক বেশী মানুষ এইসব কন্ট্যাক্টলেস ডিজিটাল পেমেন্ট মাধ্যমে টাকা-পয়সার লেনদেন করছে। এদের অনেকের কাছেই এটা নতুন বিষয়। অনেকে বয়স্ক। কার্ড নম্বর, পাসওয়ার্ড, ওটিপি – এইসব সিকিউরিটি সিস্টেমের গুরুত্ব বোঝেন না। জালিয়াতের খপ্পরে সবচেয়ে বেশী এরাই পড়েন।
অমৃতা ব্যানার্জী কিন্তু মোটেই বয়স্ক নয়। বরং যুবতী এবং খুবই স্মার্ট। ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ওয়ালেটে খুব স্বচ্ছন্দ। কাজের চাপ ও ব্যস্ততার মাঝে হয়ত ভুল হয়েছে। হানা দিয়েছে জালিয়াতের দল।
পরদিন ভোরে অসীম চ্যাটার্জীর মোবাইল আবার বেজে উঠল। যাঃ, শুরু হয়ে গেল! পুলিশের কাজ করলে আর আরাম করে মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থাকার উপায় আছে?
ঘুমচোখে সে দেখল একটা অচেনা নম্বর। কেটে দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর ফের আবার ফোন। এবার চেনা নম্বর। অমৃতা ব্যানার্জী। এত সকালে আবার কি হল!
বিরক্তির একশেষ। কিন্তু কিছু করার নেই। এই সব ফিল্মের লাইনের লোকেরা এখন কোনো না কোনো পার্টির দিকে হেলে থাকে। এদের সাথে তাই খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। বলা যায় না, কোন নেতাকে ধরে কখন কোন ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে ট্রান্সফার করিয়ে দেবে!
‘হ্যালো। বলুন।’
‘আবার বিপদ।’
‘সে কি! বললাম তো এনকোয়্যারি চলছে। একটু সময় লাগছে।’
‘এটা আমার কেস নয়। আমার হাজব্যান্ডের কেস।’
‘কেন, তারও টাকা চোট হয়েছে না কি?’
‘না ওর ল্যাপটপ হ্যাকড্ হয়েছে।’
‘এটাতে আমরা কি করব? কম্পিউটার এক্সপার্টকে যোগাযোগ করুন।
‘না , ব্যপারটা ঠিক সেরকম নয়। আমি ওকে দিচ্ছি। একটু কথা বলুন।’
‘হ্যালো, নমস্কার’
‘নমস্কার’
‘আমি পল্লব ব্যানার্জী, অমৃতার হাজব্যান্ড বলছি।’
‘বলুন।’
‘আমার কম্পিউটারে একটা র্যানসমওয়্যার অ্যাটাক হয়েছে। সিস্টেম লক হয়ে গেছে। লগ ইন করতে গেলে বলছে এক লাখ ডলার দিতে হবে। সেটাও নাকি দিতে হবে বিটকয়েনের মাধ্যমে। না হলে কম্পিউটারের সব ছবি আর ডেটা ডিপ ওয়েবে বিক্রি করতে দেবে।’
‘আপনি সাড়ে আটটার সময় আমার অফিসে আসুন। ল্যাপটপ-টা সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
এত সকালে সাইবার ক্রাইমের অফিসে বিশেষ কেউ নেই।
পল্লব ব্যানার্জী বসে আছে অসীমের ডেস্কে। পল্লবের ল্যাপটপ সামনে রাখা।
‘দেখুন এটা আমার একার দ্বারা হবে না। ইন্সেপেক্টর দত্ত-কে লাগবে। উনি এখনো আসেন নি। একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ততক্ষণ শ্যামল সিষ্টেমটা দেখুক।’
শ্যামল নামে আই টি টেকনিশিয়ান ল্যাপটপটা খোলার চেষ্টা করছিল। ইতিমধ্যে প্রবীর দত্ত অফিসে এসে গেছে। অসীম তাকে কেস ফাইলটা এনে দিল।
আধঘন্টা পর ফ্রেশ হয়ে প্রবীর পল্লবকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করল,
‘আপনার ব্যবসাটা কিসের?’
‘বিজ্ঞাপন এজেন্সীর। নাম ওরিয়ন গ্লোবাল’
‘কি ধরনের কাজ করেন?
‘অডিও-ভিস্যুয়াল বা প্রিন্ট মিডিয়া- সব ধরনেরই’।
‘তার কাজকর্মেও কি এই কম্পিউটার ব্যবহার হয়?’
‘কখনো কখনো হয়। বিশেষ করে আমাকে নিজেকে যে কাজগুলো করতে হয়। তার রাফ ওয়ার্ক এতে থাকে।’
‘তাহলে তো এটা হাই এন্ড কম্পিউটার। ভালো মেমারি আর গ্রাফিক্স কার্ড আছে নিশ্চয়ই।’
‘তা তো আছেই।’
প্রবীর শ্যামলকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিল।
‘আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে খুলছে না?’
‘না। হ্যাকার ওটা ডিসেবল করে দিয়েছে।’
‘আই সি!’
‘আপনার স্ত্রীর ও একটা কেস আমাদের কাছে রয়েছে শুনলাম।’
‘হ্যাঁ, ডেবিট কার্ড জালিয়াতি।ওর ব্যাঙ্ক থেকে বারো লাখ টাকা গায়েব হয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা। আপনারা দুজনে কি পাসওয়ার্ড শেয়ার করেন?’
‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে করতে হয় অনেক সময়। তবে এই ঘটনার পরে সমস্ত পিন নম্বর আর পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে নিয়েছি।’
‘ফোনটা হ্যাক হয় নি তো?’
‘না। ওটা ঠিক আছে।’
‘আপনার কোম্পানির আর কোনো কম্পিউটার হ্যাক হয়েছে?’
‘না। এখনো পর্যন্ত তো সেরকম কোনো খবর পাই নি।’
‘আপনার কম্পিউটারে কি টীম ভিউয়ার অ্যাপ ডাউনলোড করা আছে?’
‘না তো!’
‘আপনি কম্পিউটারে পাঠানো কোনো অচেনা ইমেল লিঙ্ক ক্লিক করেছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল পল্লবের। ঠোঁট কামড়ে সে বলল। ‘হুম্। ঠিক অচেনা নয়….অমৃতা একটা ইমেল ফরোয়ার্ড করেছিল আমাকে। আমরা ইদানিং একটা গাড়ি কেনার চেষ্টা করছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সেই গাড়ি সংক্রান্ত কিছু পাঠিয়েছে। লিঙ্ক-টা ক্লিক করতে বুঝলাম তা নয়। ইংরেজি ও চাইনিজ মিলিয়ে অদ্ভুত ধরনের কিছু লেখা। ভালো বুঝতে পারলাম না। মেলটা ডিলিট করে দিলাম। তারপর তিনদিন ধরে ল্যাপটপটা ঠিকঠাক শাটডাউন হচ্ছিল না। শেষে এই অবস্থা।’
‘আপনার ওরিয়ন গ্লোবালের অফিসটা কোথায়?’
‘সেক্টর ফাইভে। কলেজ মোড়ের কাছে।’
‘আপনার স্ত্রী তো টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন?’
‘হ্যাঁ। কয়েকটা ফিচার ফিল্ম আর ওয়েব সিরিজও করেছে। আজকাল বুঝতেই তো পারছেন, সিনেমার হাল খুব খারাপ। যা কাজ হাতে আসে, তা-ই করতে হয়।’
‘উনি আপনার কোম্পানির সাথে কাজ করেন নি?’
এবারে যেন একটু বিরক্ত হল পল্লব।
‘না, ও ঠিক মডেলিং-এ অভ্যস্ত নয়।’
‘উনি এই মুহূর্তে কোন ব্যানারে কাজ করছেন?’
‘বিপ্রদাস নামে একটা টিভি সিরিয়ালে, ব্লু স্কাই এন্টারটেনমেন্টের প্রোডাকশন।’
‘কোন ষ্টুডিওতে শ্যুটিং হচ্ছে?’
‘মেঘমালা।’
‘তার মানে, আপনারা দুজনেই খুব ব্যস্ত মানুষ।’
‘হ্যাঁ, তা একটু। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুজনেরই অনেক রাত হয়। আউটডোর থাকলে তো কথাই নেই।’
‘বালিগঞ্জে থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
চা এল। প্রবীর বলল, ‘নিন, চা খান।’
এরপর প্রবীর বেল দিয়ে ডাকল শ্যামলকে।
‘কি অবস্থা শ্যামল?’
‘হচ্ছে, কিন্তু সময় লাগবে। হার্ড ডিস্ক ফরম্যাট করতে হতে পারে। ডেটা আমরা পরে রিকভার করে নেবো। তবে কনসেন্ট লাগবে।’
‘আচ্ছা’
এফ আই আর লিখিয়ে, কনসেন্ট দিয়ে সাইবার ক্রাইম থেকে বেরোলো পল্লব।
‘ডাল মে কুছ কুছ কালা লাগতা হ্যায়।’ প্রবীর বলল অসীমকে।
‘ঠিক স্যার।’
‘তুমি কালকে মেঘমালা স্টুডিওতে যাবে। কিন্তু প্লেন ড্রেসে। সঙ্গে একজনকে দেব।’
‘ওকে, স্যার।’
‘তনভীরকে একটু পাঠিয়ে দাও তো।
অসীম চলে যেতে তনভীর ঢুকলো প্রবীরের ঘরে। তনভীর মোবাইল ফোন সেকশনটা দেখে।
একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিয়ে প্রবীর বলল, ‘এই দুটো নম্বরের গত দুমাসের টাওয়ার লোকেশন আর কল ডিটেইলস চাই।’
‘ওকে, স্যার।’
কয়েক ঘন্টা বাদে শ্যামল অন্য একটা ল্যাপটপ হাতে নিয়ে আসে। চোখ দুটো উজ্জ্বল।
‘হার্ড ডিস্কের ডেটা রিকভার করা গেছে স্যার। এটা দেখুন।’
দেখতে দেখতে প্রবীরের চোখদুটো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।’এ তো কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ!’
কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে ভাবল প্রবীর। তারপর বিদিশাকে ফোন করল। বিদিশা হল প্রবীরের পিঠোপিঠি বোন। কর্পোরেট হাসপাতালে নার্স। ডাকাবুকো মেয়ে। বিদিশা-কে এই কেসে খুব দরকার। মহিলা পুলিশ দিয়ে এ কাজ হবে বলে মনে হয় না।
‘হ্যালো।’
‘ফাঁকা আছিস, লিলি?’
লিলি হল বিদিশার ডাকনাম।
‘আপাতত।’
‘তোকে একটা কেসে একটু হেল্প করতে হবে।’
‘তোর সাইবার ক্রাইমে আমি কি করে হেল্প করব? কম্পিউটার, ইন্টারনেটের আমি কি বুঝি!’
‘কেসটা আরেকটু জটিল। তোকে লাগবে।’
ফোনেই বিদিশাকে ব্যপারটা বলল প্রবীর।
‘কালকে তোকে একটু মেঘমালা ষ্টুডিওতে যেতে হবে। সঙ্গে আমার একজন লোক থাকবে।’
বিদিশা বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিয়ে উঠতি অভিনেত্রী-র সাজে পরদিন মেঘমালা ষ্টুডিও-র ফ্লোরে গেল। সঙ্গে অসীম চ্যাটার্জী। একটা সোর্স কাজে লাগিয়ে শ্যুটিংয়ের একষ্ট্রা-র কাজও জুটিয়ে ফেলল
(চলবে….)
বি.দ্র. এই গল্পের চরিত্র, পটভূমি- সবই কল্পিত। কোনো বাস্তব ঘটনার সাথে মিল থাকলে তা একেবারেই কাকতালীয়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত