যদিও নাম দিয়েছি ডায়েরী, ডায়েরী আমি কোনদিন লিখিনি। দল্লী রাজহরায় থাকাকালীন আমি যে চিঠিগুলো লিখি (মূলত আমার স্ত্রীকে) আর যে চিঠিগুলো অন্যদের কাছ থেকে পাই সেগুলো সংরক্ষিত ছিল, এই ডায়েরী সেই চিঠিগুলোর নির্বাচিত অংশ অপরিবর্তিত। এখনকার সংযোজনগুলো বন্ধনীর মধ্যে।
যে নামগুলো লেখায় আছে সেগুলো হল চঞ্চলা (ডাঃ চঞ্চলা সমাজদার—আমার স্ত্রী), বিনায়কদা (ডাঃ বিনায়ক সেন), পবিত্র (ডাঃ পবিত্র গুহ—দল্লী রাজহরায় প্রথম দিকে চার/পাঁচ মাস ছিলেন), শৈবাল (ডাঃ শৈবাল জানা), পুণ্য (ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ) এবং আরো কেউ কেউ।
১৯৮১ তে সার্জারি এবং অর্থোপেডিক্সে হাউসষ্টাফশিপ শেষ করে ভাবতে বসি এবার কি করবো। আমি এমন একটা সংগঠন খুঁজছিলাম যারা গরীব মেহনতী মানুষদের নিয়ে কাজ করে এবং স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করতে চায়।
ভলান্টারী হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (VHAI)–এর আমন্ত্রণে দিল্লি যাই। কিন্তু ওদের প্রস্তাবিত কাজ পছন্দ না হওয়ায় আবার ভাবতে শুরু করি আর লোকজনের সাথে আলোচনা করি। শেষ পর্যন্ত ঠিক করি হয় শাহদা (মহারাষ্ট্র) অথবা দল্লীরাজহরা (মধ্যপ্রদেশ) যাবো।
অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও (রাজহরায় ১৪৪ ধারা লাগু ছিল) আমি একাশি সালের মে মাসে দল্লীরাজহরা যাই। নিয়োগীজি এবং অন্যদের সাথে আলাপ পরিচয় হওয়ার পর নিয়োগীজির পরামর্শ অনুযায়ী স্ত্রী রোগের চিকিৎসা আয়ত্ব করতে তিন মাসের জন্য ধানবাদে চলে যাই। ওখানে একটা বড় স্ত্রী রোগের হাসপাতালে আমার দিদির (ডাঃ শীলা কুন্ডু—যিনি এখন শহীদ হাসপাতালেই কাজ করেন) তত্ত্বাবধানে হাউসষ্টাফশিপ শুরু করি। আগস্ট মাসে বিনায়কদার টেলিগ্রাম পেয়ে তড়িঘড়ি রাজহরা ফেরত যাই, পনেরোই আগস্ট ১৯৮১ আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়োগীজি ছত্তিশগড় শ্রমিক মাইন্স শ্রমিক সংঘের স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু করেন।
প্রথম পর্ব (এই পর্বের সব লেখাই আমার চঞ্চলাকে লেখা চিঠির অংশবিশেষ।)
১৫.৫.৮১
ভিলাইয়ের কোয়ার্টার থেকে লিখছি। বারো তারিখে ট্রেনে দিল্লি থেকে ট্রেনে ওঠার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। ছত্তিশগড় এসে কাজ হাতে নেওয়া মানে সোজাসুজি একটা বিশাল কর্মকান্ডের মধ্যে এসে পড়া। আশঙ্কিত এবং কিছুটা ভয়ভীত হয়ে পড়ে ছোটবেলার মতো মনে হচ্ছিল যে কোন critical situation এ পড়লেই সোজা বাড়ী পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কি দরকার এই ঝামেলায় থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। দিল্লীতে VHAI-এর কাজে যোগ দিলে অন্তত কিছুদিন শান্তিতে আর্থিক স্বাচ্ছল্যে থাকা যেত, যাই হোক।
প্রচন্ড গরমেও চম্বলের উপত্যকার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ভাল লাগছিলো। রাতটা কোনরকমে কাটল, দুপুরে দহিবড়া আর রাতে পরোটা খেয়ে সকাল দশটায় দুর্গে নেমে একটু দিশেহারা লাগছিল, একটাই ট্রেন দল্লীরাজহরার, ভোরবেলায় চলে গেছে। রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম, সাথে সাথে বাস পেলাম, প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে কি করে যে জানালার ধারে একটা seat ম্যানেজ করলাম জানি না, প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় দুপুর দুটোয় দল্লী রাজহরা পৌছালাম। রিক্সাওয়ালাকে বললাম-সোজা ইউনিয়ন অফিস।
ইউনিয়ন অফিসের সামনে আসতেই দুশ্চিন্তাগুলো কেটে গেল অনেকখানি, একজন অফিস থেকে বেরিয়ে হাত মেলালো, “আপ কাঁহাসে আয়ে কমরেড?” ভিতরে মিটিং চলছিল। একজন সাথে সাথে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে নিয়ে গেল। নিয়োগী ছিল না। ও ভিলাই -এ ।
দু দিন ছিলাম রাজহরায়। অদ্ভুত অবস্থা। ওখানে প্রায় সাত মাস মজদুররা কোন মাইনে পায়নি। সব মাইন্স এখন বন্ধ। এমনকি শহরের দোকানপাটে বিক্রিবাটা প্রায় বন্ধ। সব চায়ের দোকানে একই আলোচনা কবে কাজ শুরু হবে, বুঝলাম এটা উপযুক্ত সময় নয় আমার এখানে থাকার ব্যাপারে আলোচনা করার। দুদিন নিয়োগীর সাথে দেখা না হওয়ায় আজ ফিরে যাবো ভেবেছিলাম। ইউনিয়নের জীপ কাল ভিলাই থেকে রাজহরায় এসেছে। সবাইকার মতামত অনুসারে আজ একটু আগে নিয়োগীর সাথে দেখা করতে ভিলাই চলে এসেছি।
নিয়োগীর সাথে দেখা হল। এত ব্যস্ততার মধ্যে ওদের সংগঠনের বাঁচামরা নিয়ে টানাটানি চলছে—ওর বন্ধুরা আর ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করল।
নিয়োগী যে দায়িত্ব আমায় দিতে চাইছে তা বিরাট। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই এলাকার শ্রমিক এবং কৃষকদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত কিছু—একটা ছোট হাসপাতাল গড়ার এবং তার finance থেকে planning সমস্ত কিছু। দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে। (তখনও জানিনা বিনায়কদাও ওখানে আসবে)।
অবশ্যই আজকের স্থিতাবস্থা না কাটলে অর্থাৎ মাইন্স না খোলা পর্যন্ত কোন পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। মজদুররা কাজে যোগ দিতে না পারলে সংগঠনও টিকবে না—এত সব পরিকল্পনাও বাস্তবে রূপায়িত হবে না। যদি সম্ভব হয় আমি এখানেই থাকতে চাই, কারণ দল্লী রাজহরার মানুষ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, নিয়োগীর ইউনিয়ন, নিয়োগীর ছেলে মেয়ে এবং নিয়োগী নিজে আমার মনে যে দাগ কেটেছে—দেখা হলে সব বলবো।
২৬.১০.৮১
(রাজহরায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই ঠিক করি, অনেকদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা কাজটা এবার করে ফেলব। রাজহরা থেকে দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাই। ১৬.৯.৮১ চঞ্চলার সাথে আমার বিয়ে হয়।)
চান করে বসে আছি। পবিত্র আসলে একসাথে বেরোব। পরশুদিন সকালে আমি আর বিনায়কদা রায়পুরে গিয়েছিলাম। একটা মিটিং এ বিনায়কদার স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর বলার কথা ছিল, বিভিন্ন কারণে মিটিং হল না। কিছু লোকের সাথে আলাপ পরিচয় হল। সন্ধ্যেবেলা দুর্গে ফিরে এলাম। দুর্গে চন্দনের ওখানে (ধ্রুবর ভাই) রাত কাটাব ঠিক করেছিলাম। রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও—চন্দন ফিরল না। পাশের কোয়ার্টারের এক মারাঠি ছেলে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল, রাত এগারোটা নাগাদ ওর স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে আমাদের কফি করে দিল। তারপর ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করে দিল। অপরিচিত লোকের সাথে এরকম ব্যবহার খুবই অবাক লাগছিল। সকালে ওখান থেকে আমি রাজহরা ফিরে এলাম। বিনায়কদা দিন সাতেকের জন্য বোম্বাই চলে গেল।
গতকাল রাজহরা ফিরেই নিয়োগীর সাথে দানীটোলা মাইন্স গিয়েছিলাম। এদেরই ইউনিয়ন এখান থেকে একটু দূর। আজ আবার যাব।
গতকাল মননের চিঠি পেলাম। সাথে ও হেলথ ট্রেনিং এর জন্য তৈরী কিছু হিন্দি প্যামফ্লেট পাঠিয়েছে। আগামীকাল শান্তিবাই বলে একজনের বাড়িতে নেমন্তন্ন। ও খুব ভাল নেত্রী। Women’s Conference-এ বোম্বাই গেছিল। কিন্তু health committee-র কাজে কিছুতেই আসছে না। আজ অনেক বোঝাতে বলল চঞ্চলা এলে একসাথে কাজ করব, খুব বুদ্ধিমতী মহিলা।
এখানে আসার পর মনে হচ্ছে এইসব জায়গায় কাজ করার জন্য অন্তত কোন এক বিষয়ে আমাদের পারদর্শী হওয়া দরকার, এদের সংগঠিত করার ব্যপারে এরাই আমাদের চেয়ে ভালো পারে। আমাদের একমাত্র জিনিস যেটা নিয়ে আমরা ওদেরকে সাহায্য করতে পারি তা হচ্ছে আমাদের technical knowledge. এই শিক্ষাও যদি ঠিকমত আমাদের না থাকে তাহলে আমদেরই খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে যেতে হবে। আমার যা হবার তা তো আপাতত হয়েছে। তোর housestaffship খুব ভেবে চিন্তে করিস।
(চলবে)
আমি প্রতিটি পর্ব পড়ব।
খুব ভাল লাগছে পড়তে। একটু তাড়াতাড়ি পরের পর্ব পড়তে চাই। সঙ্গের ছবিটা কি সেই সময়ের ছবি?
না, ছবিটা ১৯৯২-‘৯৪ এ তোলা।
কতদিন পরে পরে আসবে?