(এই পর্বে কয়েকটি চিঠির তারিখ নেই, তাই চিঠির লেখা দেখেই সাজানো। হয়তো বা আগে পরে লেখা হয়ে থাকতে পারে।)
শৈবাল—চঞ্চলাকে
বেশ কয়েকদিন রাজহরায় মেঘলা দিন কাটছে। তার উপর এক মিনিট হলো বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
আমি একরকম আছি। আবার বাস্তুহারার মতো। কখনো সীতারাম আবার কখনো নিজেদের কোয়ার্টারে থাকি। আমার মনে হয় এইভাবেই আমার জীবনটা কাটাবে। ভালো লাগে এভাবে থাকতে। কারণ এক জায়গায় থাকলে হাঁপিয়ে উঠি।
যাই হোক বাড়ী থেকে একটা চিঠি পেয়ে মনটা বেশ বিক্ষিপ্ত। দাদার ধারণা হয়েছে—আমি ওদের ছেড়ে দিচ্ছি। কোন রকম রাজনৈতিক তর্কের মধ্যে না গিয়ে আমি ওদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছি।
মহা বিপদ। কাকে বোঝাবো? আমার মনে হয় সমাজচ্যুত লোকেরা বেশ আরামে থাকে। ওরা নিজের মতো ভাবে, কাজ করে সফল হয়, বিফল হয়, আবার বেঁচে ওঠার চেষ্টা করে। আমাদের মতো যারা তাদের অনেক বিপদ। সারা জীবন বাড়ী থেকে সাহায্য নিয়ে এসেছি। ওরাও সাহায্য দিয়ে এসেছে পরে শোধ পাবে এই আশায় আর আমার মনে হয় এই ধারণাও বদ্ধমূল হয়েছে যে আমাকে ধার শোধ করতে হবে। যাকে শুদ্ধ-ভাষায় বলে বাবা মার প্রতি পুত্রের কর্তব্য।
শৈবাল—আমাকে
তোকে একটা খারাপ খবর দিই। মুন্নি মারা গেছে। হঠাৎ পেছনের পা-দুটো প্যারালিসিস হয়ে যায়। দুবার পাতলা পায়খানা করে। তারপর পেট ফুলতে থাকে। খুব কষ্ট পেয়েছে। এদিকে গিনিপিগ-গুলো গরমে মারা গেছে। ভীষণ গরম চলছে। সবচেয়ে বেশী ৪৭.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে নামছেই না। দিনের বেলা বাইরে যাওয়া মুস্কিল।
কুমুড়কট্টাতে সেন্টার খুলছে। তিন জুন শুরু হবে। এদিকে ম্যাজিক ও সাথে সাথে antidiarrheal প্রচার চলছে। এখন দল্লী রাজহরা ছেড়ে গ্রামগুলোতে প্রচার চলছে। আজ চিখলী ও চোরহাপাড়া মনকুঁয়াতে হবে। রাত দশটা পর্যন্ত প্রোগ্রাম চলতে থাকে। তবে একটু চেষ্টা করলে আরো ভালো হত। অনেক স্কুল কলেজের ছেলেরা আসছে। সুরেশদের পুরো ব্যাচ রয়েছে। দেওয়ালে লেখার কাজটা অনেকটা নকশালী কায়দায় হয়েছে। কোন দেওয়াল ছাড়া হয়নি। অনুপ খুবই ভালো কাজ করছে। এ পর্যন্ত ডায়েরিয়া পর্চাটা ৫০০ বিক্রি হয়েছে, তবে বেশীর ভাগই আমাদের কাউন্টার থেকে বিক্রী হয়েছে। মনে হয় তিন জুন হাজার হয়ে যাবে। সেন্টারের ব্যপারে তোর মতামতগুলো জানাবি। তবে ডাক্তারের খুব দরকার। দোতলা শুরু হলে আর সেন্টার ঠিকমতো চললে ডাক্তার না হলে সম্ভব নয়। এদিকে ভঁওরমলাতে সেন্টার খুলতে চায়। গ্রামের লোক ১০০০ চাঁদা দেওয়ার জন্য তৈরী। তবে আমরা (আমি) সাহস পাচ্ছি না। পনি এখন হাসপাতালে যাচ্ছে, কিন্তু officially জয়েন করেনি।
শৈবাল—আমাকে
আশীষ, প্রথমে একটা খারাপ খবর দিই। রামসার মারা গেছে। লিভার ক্যান্সার হয়েছিল। এবারে মজদুররা NGCS এ ১৯৫৮ টাকা পেয়েছে। গতকাল সবাই টাকা পেয়েছে। দেওয়ালীর আগে দানীটোলা মাইন্স চালু হবে। সোসাইটি তৈরী হবে। দল্লীর সমান মজদুরী পাবে।
হাসপাতালে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ভরুয়া দাসের জায়গায় এখন পুনা ও পূরণ—হিসাব দেখাশোনা করছে। ট্রেনিং এ অনেককে নেওয়া হয়েছে। ৪ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়ে। এদের জন্য একটা কোর্স তৈরী হয়েছে। আমি ছাড়া আর সবাই ক্লাস নিচ্ছে। অবশ্য পনি কিছুটা কম নিচ্ছে। কোর্সটা এদের পক্ষে একটু বেশী হয়ে গেছে। তবে এবারের ব্যাচটা ভালো বেরোবে মনে হয়।
হাসপাতাল ও ইউনিয়ন অফিসে M.P.E.B.-র electricity চালু হয়ে গেছে। আমাদের আট হাজার ও ইউনিয়নের ছয় হাজার খরচ হয়েছে। বরাবরের জন্য একটা সমস্যা দূর হয়েছে।
অফিসটা এখন employment exchange এর মতো হয়েছে। রোজ প্রচুর বেকার ছেলেরা নাম লেখাতে আসছে। এখন অব্দি বারোহাজার নাম লিখিয়েছে। পুরনো উদের জায়গায় নতুন উদে-এসেছে। বেশ কাজের ছেলে। মাঝে যোগীনদা এসেছিল। ও আবার health work শিখতে চায়। সম্ভবত পাঁচ মাসের জন্য আগামী ডিসেম্বরে আসবে, তুই Boyle’s apparatus-টা খোঁজ নিয়ে জানাবি। Asiatic Oxygen থেকে আমি খোঁজ নিয়েছি। সবমিলিয়ে তিরিশ হাজার লাগবে।
দোতলার কাজ চলছে। শুধু O.T.-র মেঝের কাজ বাকী রয়েছে। প্রদীপ ১৩ ই September কলকাতা পৌছাবে। ও তোর সাথে কোথায় দেখা করবে জানাবি। বিনায়করা তিলদাতে জয়েন করেছে। আমাদের সাথে দেখা হয় না। পনির এখানে খুব একটা ভালো লাগছে না। হাসপাতাল যে ভাবে চলছে তাতে ও খুশী নয়।
Rural centre ভালোই চলছে। কিন্তু গ্রামে কিছু লোক হাসপাতালটা ভালো চলুক তা চায়না। আমার মনে হয় এর মধ্যে Congress ও SKSMSS রয়েছে। centre পাঁচটায় খোলে ও আটটায় বন্ধ হয়। এখনও অব্দি মূলত চিকিৎসা ছাড়া আর কিছু করা হয়নি। তবে health education, immunisation programme শুরু হয়েছে। তবে গ্রামের লোকেদের একসাথে কিছু প্রোগ্রাম নেওয়া হয়নি।
শৈবাল—আমাকে
হাসপাতাল ভালোই চলছে। “স্বাস্থ্য সংগওয়ারী” প্রতি মাসে বের করানোর প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে। প্রচ্ছদটা উৎস মানুষের মতো থাকবে। তবে প্রচ্ছদটা এখনো তৈরী হয়নি। তোরা ভাবিস কি হতে পারে। প্রথম ইসুটা টিবি-র উপর হচ্ছে।
মাঝে হাসপাতালে বেশ জলের কষ্ট হয়েছে। উপরে কুলার লাগানো হয়েছে। রুগিদের অনেকটা সুবিধা হয়েছে। তোরা “বুঁদবুঁদ” দেখছিস কিনা জানাস।
মুক্তি মোর্চা জঙ্গল নিয়ে আন্দোলন করছে। একমাস হলো জঙ্গলের অত্যাচার কম হয়েছে। তবে বরাবরের মতো খুব একটা প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। এদিকে দুটো ইউনিয়নের আন্দোলন চলছে। দুর্গের প্রাইভেট ট্রাক ড্রাইভারেরা ও ACC সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মজদুররা আন্দোলন চালাচ্ছে। সব মালিকরা একজোট হয়ে ইউনিয়নকে রোখার চেষ্টা করছে।
শৈবাল—আমাকে
একটা পদযাত্রার চেষ্টা চলছে, ভিলাই পর্যন্ত। তবে শেষ অব্দি হবে কিনা বলা মুস্কিল।মাঝে হাসপাতালে বেশ ঝামেলা গেল, তোর সাথে দেখা হলে বলবো। পনির একেবারেই ভাল লাগছেনা। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।
দানিটোলার কাজ এখনো শুরু হয়নি। কবে শুরু হবে বলা মুশকিল। ম্যানেজমেন্ট দল্লীতে mechanisation করতে চায়। দানিটোলাকে pawn হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। বারাদ্বার ও চাঁদীডোঁগরীতে কাজ চালু হচ্ছে। তবে গ্লুকোজে এখনো কিছু হয়নি।
হাসপাতাল ভালোই চলছে। দোতলার কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর বেশীদিন বাকী নেই। O.T.-তে মার্বেল লাগানো আজ শুরু হয়েছে। শুধু মাত্র সিঁড়ির কাজ বাকী রয়েছে।
১/৪/১৯৮৯
শৈবাল—চঞ্চলাকে
আপাততঃ আমরা আন্দোলনের মধ্যে রয়েছি। SKMSS যথারীতি আগের মতোই চামচাগিরি করছে। B.K. Company দল্লী মাইন্সে ক্রাশিং প্ল্যান্ট লাগাচ্ছে। আমরা রোখার চেষ্টায় রয়েছি। কিন্তু কচরাবাই গোষ্ঠী ৩০০ মজদুর নিয়ে কাজে গিয়েছে। আমাদের মজদুররা ধৈর্য্য ধরে রয়েছে। কিন্তু কতদিন ধৈর্য্য ধরে রাখবে বলা মুস্কিল। একসাথে অনেকগুলো আন্দোলন চলছে। রাজহরা মাইন্স এরিয়াতে ক্রাশার চলছে। ওখানে আমাদের মজদুররা কাজ করছিল। অনুপের বেরোজগার সঙ্ঘের ১৫০ জন লোকের কাজ হয়েছিল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট হঠাৎ কাজটা বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া DKMSS এরিয়াতে ম্যানেজমেন্ট মেশিন লাগাবেই। তাই DKMSS কে P.R. area তে ট্রান্সফার করেছে। DKMSS মজদুররা যায়নি। তাই হাজরী হচ্ছে না।
প্রদীপ বিয়ে করেছে, ওর স্ত্রীর নাম রত্না। আমরা সবাই একসাথেই আছি। আমাদের ঘরে ঢোকার রাস্তাটা দক্ষিণ দিক দিয়ে হয়েছে।
পনি এখনো অব্দি মুহল্লাতে কাজ শুরু করেনি। তবে মাঝে মধ্যে যাচ্ছে। একা একা অসুবিধা হচ্ছে। তবে সুধা এলে কাজটা শুরু করতে পারবে। বেড তৈরী না হওয়ায় নিচেরটা চালু করা যাচ্ছে না। ওপরে ২৫-৩০ জন ভর্তি থাকে। বারান্দাও ভরে যায়। হাসপাতাল মোটামুটি চলছে। জলের সমস্যা আগের থেকে কম। ইলেক্ট্রিসিটির সমস্যা নেই।
কুমুড়কট্টাতে এখন রুগী কম হচ্ছে। হয়ত আমাদের বাড়ীটা ছাড়তে হবে। বাড়ী ছাড়তে হলে হয়ত আমরা মহামায়া চলে যাব। পরে কুমুড়কট্টাতে বাড়ী বানাতে চেষ্টা করব।
মাঝে পনি, প্রদীপ, রত্না, নিয়োগীজীর বাবা, অপু—এরা জব্বলপুর ঘুরে এলো। এর আগে আমি, পনি, নিয়োগীজী জব্বলপুর গিয়েছিলাম। জানিসতো বেড়াতে আমার খুবই ইচ্ছা করে। কিন্তু ছাড় পাওয়া মুস্কিল। তাছাড়া পয়সার সমস্যা রয়েছে।
১৯/৪/১৯৮৯
শৈবাল—আমাকে
তোকে টেলিগ্রাম করেছি। অমিতকে চিঠি দিয়েছি। আমি ইম্ফল যেতে পারব। (মিলিটারির অত্যাচারের ফলে নাগাল্যান্ড আর মণিপুরের বেশ কিছু মানুষ মারা যান। অনেকেই ঘরছাড়া হন। কলকাতার এক চিকিৎসক দল সরেজমিন তদন্ত করতে যায়। শৈবাল তাদের সঙ্গে যায়।) নিয়োগীজি ও পুণ্যর সাথে কথা হয়েছে। জনকও যেতে চায়। নিয়োগীজির বাবা জনকের সাথে কলকাতা যাবে। তুই জনকের সাথে দেখা করবি।
এখানে আন্দোলন চলছে। B.S.P. বেশ ঝামেলায় পড়েছে। ওরা সম্বল চক্রবর্তী আর কচরাবাই-এর সাথে হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করেছে। এক তারিখ থেকে B.K. Company দল্লী মাইন্সে নতুন crushing plant তৈরীর কাজ শুরু করেছে। আমাদের মজদুররা slow down শুরু করেছে। Management খুবই ঝামেলায় পড়েছে। রোজ কাউকে না কাউকে পাঠাচ্ছে সমাধান খোঁজার জন্য। রোজ খবরের কাগজে প্রচুর খবর বেরোচ্ছে। গত ৬ই এপ্রিল “রাজহরা বন্ধ” হল। ব্যবসায়ীরা পুরো সমর্থন দিয়েছে। সব মিলিয়ে রাজহরা গরম। এছাড়া আর সব জায়গায় আগের মতোই চলছে। আন্সারের গ্রুপ ভালো কাজ করছে।
২০/৮/১৯৮৯
শৈবাল—চঞ্চলাকে
ছোটী আজ আমাদের মধ্যে নেই। অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। রোজ খাওয়ার দেবার দরকার নেই। আজ দুপুরে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়ে পড়ে। এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকে, শেষে ডাম্পার গ্যারেজের দিকে। যথারীতি জানোয়ারের হাত থেকে মুক্তি পেলেও মানুষের হাত থেকে মুক্তি পায়নি, মরে না যাওয়া পর্যন্ত পিটিয়ে মারে। ছোটীকে নিয়ে অনেকদিনের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে। ওর পা (হাত) ভেঙ্গে যাওয়ার দিনটা। তুই নির্দোষ হয়েও বার বার নিজেকে অপরাধী ভাবলি, কতবার ডায়েরিয়া হলো। আমরা আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ছোটী আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছিল। সাথে দুধ খাওয়া নিয়ে কি বদমাসী না করত। মাসীমার আর তোর কত শাড়ী ছিঁড়েছিল তার ঠিকানা নেই। ছোটীর সাথী সমস্যা নিয়ে কত ভেবেছি কিন্তু সমাধান হয়নি। মাঝে একটা হাঁস ওর সাথী হয়েছিল। দুজনে সবসময় একসাথে থাকত। হাঁসটা কোনদিনই নিজের ঘরে থাকেনি। রাতে ছোটির পাশে শুত। কিন্তু ছোটি ওকে বাঁচাতে পারেনি, একদিন রাতে কুকুর হাঁসটাকে নিয়ে যায়। ছোটি তিনদিন ছটপট করতে থাকে। খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তোর নিশ্চয় মনে আছে ছোটি মাসের বিশেষ দুটো দিন বেশ চঞ্চল হয়ে উঠত। ওর সাথীর খোঁজ করত। বার বার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করত। আজ ছিল প্রথম দিন। বেচারা সাথীর খোঁজে বেরিয়েছিল। সাথীর বদলে যা পেল তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
২৪/১০/৮৯
নিয়োগীজি—আমাকে (টেলিগ্রাম)
জনক বিধানসভায় কাঙ্কের থেকে নির্বাচন লড়ছে। হরি ঠাকুর সম্ভবত রাজনাদগাঁও থেকে। আপনার উপস্থিতি আমাদের শক্তিশালী করবে, চলে আসুন।
(চলবে)