২৬/৪/১৯৮৩
নিমন্ত্রণপত্র
এই তারিখে এই নিমন্ত্রণ পত্র হিন্দি এবং ইংরেজীতে ছাপিয়ে বিভিন্ন জনকে পাঠানো হয়।
প্রিয় সাথী,
আমরা আপনাকে ৩ জুন শহীদ হাসপাতালের উদ্ঘাটনে আমন্ত্রিত করতে পেরে আনন্দিত। ৩ জুন আমাদের একটা স্মরণীয় দিন—১৯৭৭ সালে এই দিনে আমাদের ১১জন সাথী পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। এই দিনটি আমরা প্রতি বছর শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি।
শহীদ হাসপাতাল শ্রমিকদের নিজস্ব সাধন দিয়ে তৈরী । এবং এটা একটা বড় কর্মযজ্ঞের অংশ বিশেষ—”Health care for the people by the people”- ভারতের সংগঠিত মজদুর বর্গের এই ধরনের প্রথম কর্মউদ্যোগ।
এই ঐতিহাসিক দিনে আপনার উপস্থিতি আমাদের কাম্য।
শৈবাল জানা সহদেব সাহু শংকর গুহ নিয়োগী।
৮/৫/১৯৮৩
প্রিয় চঞ্চলা,
রাত দুটা পর্যন্ত দুর্দান্ত গরমে হাঁসফাস করছি। অভ্যস্ত হয়ে উঠতে আবার দুএকদিন লাগবে। এখানে সবাই ভালো আছে—সবাই খুব ব্যস্ত হাসপাতাল inauguration নিয়ে । (শহীদ হাসপাতাল নির্মাণ এক মহা যজ্ঞ। প্রায় দশ হাজার শ্রমিক তাদের বোনাস ইউনিয়নকে দান করলো হাসপাতাল তৈরীর জন্য। আবার শ্রম দান করলো নির্মাণ কাজের সময়। দুএকজন দক্ষ মিস্ত্রী ছাড়া আর সবাই ইউনিয়নের সদস্য শ্রমিকেরা—নারী পুরুষ দুইই। ছাদ ঢালাইয়ের দিন মনে হল একটা উৎসব হচ্ছে। ইউনিয়নের গ্যারেজে সব বেড এবং ফার্নিচার তৈরী হলো।)
কে যে উদ্ঘাটন করবে তার ঠিকানা নেই এখনো। Dr. Sethi /বাবা আমতে কেউই আসতে পারবে না।
আজ বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। হলে বাঁচা যায়। একটু ঠান্ডা হবে। রেডিও আর অন্যান্য gift পেয়ে সবাই খুব খুশী। সুনীতা (অরবিন্দের স্ত্রী) এখন সারাদিন ঘরেই থাকে—রান্নাবান্না করে। অরবিন্দ এখন আর মেসে থাকছে না,খাচ্ছে না। ওই দুপুরের গরমটা কমানো যায় কি করে ভাবছি। সকাল নটার থেকেই গরম হয়ে যায়।
১৪/৫/১৯৮৩
হাসপাতাল inauguration এর পুরো তোড়জোড় চলছে। Instrument এর জন্যে শৈবাল টাকা পয়সা নিয়ে যাবে। তোর সাথে দেখা করবে। তুই শৈবালের সাথে Mukherjee তে গিয়ে instrument গুলো চেক করে নিবি।
আমি শৈবাল বিনায়ক আর নিয়োগীর সাথে আমাদের ছুটির ব্যপারে কথা বলেছি, যে আমি ডিসেম্বর জানুয়ারীতে লম্বা ছুটি নেব আর তুই D.G.O ইত্যাদি করবি। সবাই agree করেছে এবং ধরে নিয়েছে আমরা দুজন এক বছর আসব না—তারপর দুজনে একসাথে এসে join করব। (আসলে আমার আরো একটু পড়াশোনা করার তীব্র ইচ্ছে ছিলো।) তোর দিপুর আর দিদির reservation করে রেখেছি।
৪/৬/১৯৮৩
(৩ জুন হাসপাতাল inauguration হল। দিল্লী বম্বে কলকাতা থেকে অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছিল। এসেছিলেন নাগভূষণ পট্টনায়ক। আগেই ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাসপাতাল উদ্ঘাটন করবে এলাকার সবচেয়ে বর্ষীয়ান শ্রমিক আর একজন বর্ষীয়ান কৃষক। সেইভাবেই উদ্ঘাটন হল। বৃদ্ধ শ্রমিক লহর সিং আর বৃদ্ধ কৃষক হালালখোর উদ্ঘাটন করলেন। অনেকেই বক্তব্য রাখলেন।
একটা উচুঁ টিলার ওপরে লম্বা একটা বাড়ী। দুদিকে ঢালু নেমে গেছে চওড়া রাস্তা গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার জন্য, সামনে বিরাট বাগান। এগারোটা বকুল গাছ –এগারোজন শহীদকে স্মরণ করে।
Entrance দিয়ে ঢুকে ডানদিকে ডিস্পেন্সারী তারপর ward, একেবারে শেষে বাথরুম পায়খানা, বাঁদিকে দুটো ডাক্তারের চেম্বার। লাগোয়া examination room. তারপর OT labour room.
প্রথমেই আমি আর শৈবাল এই সরু লম্বা examination room দখল করে নিলাম। একটা খাটে দুজনে শুতাম। একটা ষ্টোভ কিনলাম। কখনও যদি কিছু রান্না করি।
একদিন নিয়োগীজি একজন ছোটখাটো কন্ট্রাকটরকে ধরে আনলো। বললো দেখুন ডাক্তারবাবুরা কিভাবে থাকেন। কিছু করুন এদের জন্য। কন্ট্রাক্টর একটা ষোল কেজির বাদাম তেলের টিন দিয়ে গেল। আমাদের কি আনন্দ। মেস থেকে যে সব্জি আসত আমরা ষ্টোভে টমাটো লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে খেতাম।)
১১/৭/১৯৮৩
আমি—চঞ্চলাকে
গতকাল ভালোভাবেই এসেছি (কলকাতা থেকে ফিরলাম) দুর্গ পর্যন্ত। কম্পার্ট্মেন্টে সবাইকার সাথে খুব আলাপ হয়ে গিয়েছিল। সবাই চা সিগারেট খাবার দাবার খাওয়াচ্ছিল। দুর্গে লছমন এসেছিল। তারপর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করলাম চার ঘন্টা। লাইন খারাপ হয়ে গেছে বলে ট্রেন এল না। অগ্ত্যা জিনিষপত্র নিয়ে রিক্সায় কুরিয়নের কোয়ার্টারে চলে গেলাম, একটু পরেই নিয়োগী এল জীপ নিয়ে। সারাদিন ভিলাই এ কাটিয়ে রাত্রে ফিরলাম।
এসেই মনে হল একটা নতুন জায়গায় এসেছি। শৈবাল গত একমাস ঘরে যায়নি। এখানেই কোনভাবে থাকে—খাওয়া দাওয়ারও কোন ঠিক নেই। বিনায়কও সারাদিন হাসপাতালে, তবে দেরী করে আসে, তাড়াতাড়ি ফিরে যায়—কোন organization নেই। কোন discipline নেই। কোন system নেই। হাসপাতালের অর্ধেকটায় মিস্ত্রির কাজ চলছে। এই গোটা চেহারাটার মধ্যে কিভাবে discipline আনব কাল থেকে তাই ভাবছি। একটা tremendous amount of organizational work শুরু করব। বাইরের health programme ইত্যাদির কথা তো ছেড়েই দিলাম। আবার প্রচুর নাকি সার্জিকাল পেসেন্ট আসছে। দেখা যাক কি করতে পারি।
সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।এখন আমার চিন্তা hospital টা ঠিকমত চালানো আর health programme টা আবার দাঁড় করানো। আমাদের কোয়ার্টার বানানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে—অবশ্য দেরী হবে।
এখানে political situation—বেশ turmoil চলছে। পরে একটু একটু করে জানাবো। আমাদের রাঁধুনি জয়নাল চুরি করে ধরা পড়েছে। বোধহয় ছাঁটাই হয়ে যাবে।
১২/৭/১৯৮৩
গতকাল দুপুর দেড়টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত আমি আর বিনায়ক বালোদে কাটিয়েছি। Police custody তে একজন মারা যায়—তাই খুব tense situation হয়। প্রথম post mortem-এ আমাদের থাকতে দেয়নি বলে DM পরে repeat post mortem-এর order দেয়। Repeat post mortem এ আমরা থাকতেই চাইনি।
হাসপাতালের জটটা কিভাবে ছাড়াবো জানি না।
১৫/৭/১৯৮৩
আমি—চঞ্চলাকে।
রাতে খেয়ে দেয়ে লিখতে বসলাম। আমাকে আসার সময় জিনিsগুলো (হাসপাতালের) বুক করতে হয়নি। গাছও পেয়ে গিয়েছিলাম (বকুল), এগারোটা গাছ হাসপাতালের সামনে লাগানো হয়ে গেছে। একটা ইউনিয়ন অফিসের সামনে।
এখন হাসপাতালেই থাকছি—শৈবালও হাসপাতালেই থাকে। ডিউটি রস্টার চালু হয়ে গেলেই দুদিন পর পর একদিন করে থাকব।
১৬/৭/১৯৮৩
সকাল পৌনে আট
শৈবাল প্যাথলজি ঘরে রক্ত পরীক্ষা করছে। শৈবালের চান হয়ে গেলে breakfast করতে যাবো। ভাজিয়া আর চা। তার কিছু পরে রুগী দেখা শুরু।
Telegraph-এ মনে হয় কিছু দিনের মধ্যে আমাদের হাসপাতালের report বেরোবে, ফটো ইত্যাদি চেয়ে পাঠিয়েছে। একটু খেয়াল রাখিস।
আমার দুপুরের ঘুমটা যদি বাদ দিতে পারতাম তাহলে অনেক কাজ করতে পারতাম—কিন্তু এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
এত গন্ডগোলের মধ্যেও একটু একটু পড়াশোনা করছি—অবশ্য রুগী অনুযায়ী।
১৯/৭/১৯৮৩
হাসপাতালে বসেই লিখছি, আজ বৃষ্টির জন্য একদমই রুগী আসেনি। গতকাল রুগী ছিল একশ পনেরো—বেশীর ভাগ বাচ্চা। আরো ডাক্তার লাগবেই। আপাতত সাতজন ভর্তি আছে—দুজন আমার।
আমার operation list তৈরী হচ্ছে, দেড় মাস পরে শুরু করব। (শহীদ হাসপাতালে অপারেশন এর দায়িত্ব ছিল আমার।)
কয়েকটা sebaceous cyst, একটা fistula in ano, একটা piles, একটা appendix-এর line লেগেছে।
এখানে অনেক সমস্যা, তাহলেও ধীরে ধীরে organize করার চেষ্টা করছি। মাসখানেকের মধ্যে অনেকটা discipline হয়ে যাবে মনে হয়।
২৬/৭/১৯৮৩
রোজ সকালবেলা চান করে চা খেতেই কাজ শুরু হয়ে যায়। ভীষণ ভীড় হচ্ছে। এখানে এখন কলেরা হচ্ছে। গতকাল রাত সাড়ে তিনটের সময় শুয়েছি। এর ওপরে আবার ঝামেলা ঝঞ্ঝাট—আউটডোরে রুগী যখন তখন আসে। আমরা সময় ঠিক করে দিয়েছি—সকাল সাড়ে নটা থেকে সাড়ে বারোটা, বিকেল সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে সাতটা। লোকজন এসব মানতে চায় না—তাই নিয়ে রোজ ঝামেলা। তার ওপর staff নেই। কাপড় চোপড় ধোওয়া, latrine পরিষ্কার করা, instrument sterilization, dressing, ওষুধ দেওয়া—সবই আমাদের ভাগাভাগি করে করতে হয়।
মাঝে মাঝে বিশেষ করে লোকজনের সাথে ঝামেলা হলেই আমরা এত ক্লান্ত হয়ে যাই, চেষ্টা করছি—একটু discipline আনার, হচ্ছেই না।
এখন আর অফিসে বা অন্য কোথাও যাওয়া হয় না। কাগজও পড়া হয়না। দুজনের পকেটই শূন্য। চেয়েছি, দেখি কবে পাওয়া যায়। খাওয়া দাওয়া মোটামুটি টিফিন কেরিয়ার করে হাসপাতালে চলে আসছে।
বাঃ, শহীদ হাসপাতাল তিল তিল করে গড়ে ওঠার ছবিটা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। -তার সাথে ডাক্তার বন্ধুদের প্রতি দিনের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছবিটাও। একটা প্রতিষ্ঠান শূণ্য থেকে গড়ে তোলা যে কত দুরূহ কাজ সেটার সাক্ষী না থাকলে অনুমান করা শক্ত – বোঝা গেল।