এই পর্বে কোন চিঠি নেই। স্মৃতির সংযোজন।
আগেই বলা আছে, হাসপাতাল কিছুটা নির্মাণ হওয়ার পরে আমি আর শৈবাল ডাক্তারের চেম্বারের পাশে একটা সরু একজামিনেশন রুমে চলে যাই। ওখানেই একটা চৌকিতে শুতাম। একটা স্টোভে একটু রান্নাবান্না করতাম।
এই সময় মাঝে মাঝেই আমাদের মাঝরাতে ডাক পড়ত। প্রসব হচ্ছে না। মা কষ্ট পাচ্ছে। সাধারণত আমরা দুজনেই রওনা হতাম। মনে রাখতে হবে, মায়েদের প্রথম সন্তান প্রসবের সময় একটু বেশী লাগে, কিন্তু বাড়ীর লোকেরা অস্থির হয়ে যায়। ততদিনে আমাদের প্রচারের ফলে পিটোসিনের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আরো দেরী।
কিছুদিন পর আমি আর শৈবাল ব্যপারটা বুঝে, যাওয়ার সময় দেরী করতে শুরু করলাম। বাড়ীর লোক এসে ডাকলে ধীরে সুস্থে তৈরী হতাম। ধীরে ধীরে হাঁটা লাগাতাম। একটু দেরী করে পৌছালে দেখতাম বাচ্চার জন্ম হয়ে গেছে।
একদিন এইভাবে এক বাচ্চার বাবা এসে জানালো ‘জেচকি’ হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি চলুন। প্রথম বাচ্চা। আমি আর শৈবাল তৈরী হলাম, ধীরে সুস্থে এগোলাম। তখন রাত দুটো,পাহাড়ী রাস্তা। টর্চ হাতে চলেছি। রাস্তায় একটা ঝোড়া (সরু জলের স্রোত) পড়ল। সেটা পার হওয়ার সময় শৈবাল বললো, দ্যাখ, একটা কত বড় কাঁকড়া। ধরতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এদিকে আসন্ন সন্তানের পিতা অস্থির হয়ে উঠল, বাচ্চা হচ্ছে না আর ডাক্তাররা কাঁকড়া ধরছে।
যাই হোক কাঁকড়া ধরে আমরা একটা দড়ি দিয়ে একটা পাথরের সাথে বেঁধে রাখলাম। তারপর আবার ধীরে সুস্থে চললাম প্রসূতির বাড়ী।
যা স্বাভাবিক তাই হল। গিয়ে দেখলাম প্রসব হয়ে গেছে। একটা খাটিয়ায় বসে গুড় দিয়ে বানানো লাল চা খেলাম। তারপর ফেরার পথে কাঁকড়াটাকে তুলে নিয়ে ফেরত এলাম। পরের দিন সকালে সেই কাঁকড়া দিয়ে আমাদের ভোজ হল।
এই সময় আমি হাসপাতালে ডেলিভেরী করতাম। এছাড়া dilatation and curettege, dilatation and evacuation (medical termination of pregnancy) এবং tubectomy করতাম। নিয়োগীর স্ত্রী আশারও আমি tubectomy করি। তবে সেটা পুষ্পা হাসপাতালে। তখনও শহীদ হাসপাতাল তৈরী হয়নি।
হাসপাতাল নির্মাণ শেষ হওয়ার পর আমি আর শৈবাল অপারেশন থিয়েটারের পাশে একটা বড় ঘরে চলে যাই। চঞ্চলা আসার পর চঞ্চলাও ঐ ঘরে ঢুকে যায়, একটা চৌকিতে আমি চঞ্চলা। মাটিতে বিছানা পেতে শৈবাল। এককোনে ষ্টোভ।
শহীদ হাসপাতালে আমার অজ্ঞান করে প্রথম অপারেশন হাইড্রোসিল। চঞ্চলা আসার আগে caesarean, hysterectomy বা অন্যান্য মহিলাদের অপারেশন হত না। শৈবাল anaesthetist, আমি surgeon, একজন health worker assistant. ততদিনে স্বাস্থ্য কর্মীরা রক্ত টানা, স্যালাইন চালানো, ওষুধ দেওয়া সবই শিখে নিয়েছে, এখন চলছে surgery-তে assist করার শিক্ষা।
শৈবালকে আর আমাকে আমাদের পরিচিত এক বৌদি night dress উপহার দিয়েছিল। এই দুটোই আমরা autoclave-এ sterilize করে উল্টো দিক করে পরতাম। আমাদের O.T. gown.
বিনায়কদা আমি অপারেশন করব শুনেই ইউনিয়ন অফিসে চলে গেল। বলে গেল রুগী বেঁচে ফিরুক, তারপর আসব। আসলে বিনায়কদার আমার ডাক্তারীর উপর খুব একটা ভরসা ছিল না। শৈবালেরও না। তবে আমার ধারণা আমি অপারেশনটা ভালই করতাম।
সামান্য অপারেশন সহজেই হয়ে গেল। কিন্তু অপারেশনের শেষে রুগীকে পেনিসিলিন test dose দেওয়ার সময়ই anaphylactic shock হয়ে গেল। রুগী মারা যাচ্ছে, আমি ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি শৈবালকে ডেকে পাঠালাম।
শৈবাল ধীরে সুস্থে এসে একটা Adrenaline injection রুগীর হাতের চামড়ার তলায় ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে দিতে লাগল। রুগী খানিকক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। আমি শিখলাম কিভাবে anaphylactic shock-এর চিকিৎসা করতে হয়। পরে আমি নিজেই দুজন anaphylactic shock এর রুগীকে বাঁচিয়েছি।
এরপর আমি নিয়মিত অনেক অপারেশন করেছি।
একদিন এক গোন্ড আদিবাসী অনেক দূর থেকে এল দুঘন্টা বাসে করে তারপর আধঘন্টা হেঁটে। পেটে ব্যথা।
আমি রুগীর পেটে হাত দিয়েই চমকে গেলাম। পেট কার্ডবোর্ডের মত শক্ত। তড়িঘড়ি অপারেশন টেবিলে তোলা হল।
Appendix septic হয়ে ফেটে গেছে, সব পরিষ্কার করে Appendix কেটে বাদ দিলাম। স্যালাইন চালিয়ে রুগীকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। পেটের অবস্থা দেখে রুগীকে liquid diet-এ রাখা হল। পরের দিন সকালে ঠিকই ছিল। বিকেলে রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখলাম বেডে রুগী নেই। খোঁজ, খোঁজ। পরে আমিই আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের পেছনের একটা টিলায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখি একটা মেঠো ইঁদুর পুড়িয়ে খাচ্ছে। বললো, বহৎ ভুখ লাগা সাহাব।
এই সময় আমি নিয়োগীর ছেলে জিৎ-এর একটা ছোট অপারেশন করি। তখন জিৎ-এর বয়স ছ-সাত বছর। নিয়োগীজি বলল সেও O.T. তে থাকবে। আমাদের তখন ether anaesthesia চারজন মিলে জিৎ-কে চেপে ধরল। তারপর শৈবাল ether ঢালতে শুরু করল। খানিকক্ষণের মধ্যেই জিৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
আমি অপারেশন শুরু করতেই এক জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। জিৎ-এর অজ্ঞান হওয়া দেখেই নিয়োগী দরদর করে ঘামছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোনো দেখেই দড়াম করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ধরাধরি করে স্বাস্থ্যকর্মিরা নিয়োগীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। আমি যখন অপারেশন শেষ করে বাইরে বেরোলাম তখন নিয়োগী সুস্থ। আমাকে দেখে একটা কথাই বলল, ডাক্তারবাবু আপনারা মানুষ নন।
চঞ্চলা আসার পর সিজারিয়ান আর মেয়েদের অন্যান্য অপারেশন শুরু হল। ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল, তার মধ্যেই সব অপারেশন। চঞ্চলা সার্জন, আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট, শৈবাল অ্যানেস্থেটিষ্ট।
একদিন একটা সিজার করতে গিয়ে আলো চলে গেল। আমাদের emergency light ছিল না। দুটো টর্চ জেলে সিজার হল। তার মধ্যে একটা টর্চের সুইচ খারাপ। মাঝে মাঝে জ্বলছে আর নিভছে। যাই হোক মা আর সন্তান সুস্থ হল।
আরেকদিন সিজার করতে করতে বাচ্চা ডেলিভেরী হওয়ার পর চঞ্চলা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। চঞ্চলার জায়গায় চলে গিয়ে আমি সার্জন হলাম। শৈবাল অ্যাসিস্টেন্ট। একজন স্বাস্থ্যকর্মী অজ্ঞান করার দায়িত্ব নিল। চঞ্চলা মাটিতে শুয়ে শুয়েই আমাকে instruction দিতে থাকল। ভালভাবেই অপারেশন শেষ হল।
আরেকদিন ruptured tubal pregnancy—লাইট নেই, টর্চের আলোতেই চঞ্চলা অপারেশন করল। এই রুগীর রক্তের দরকার ছিল। শৈবাল নিজের ডাক্তারী বিদ্যা খাটিয়ে auto transfusion করল, মানে রুগীর রক্তই রুগীর শরীরে ফেরত পাঠাল।
হাসপাতালের পাশেই আমাদের কোয়ার্টার তৈরী হল। তিনটে ঘর। মধ্যের বড় ঘরটায় আমি আর চঞ্চলা, গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথম ঘরটাতে শৈবাল। শেষের ঘরটাতে অতিথি ডাক্তাররা এসে থাকতো। পরে পুণ্য এই ঘরটা দখল করে। একটু নেমে গিয়ে স্নানঘর চৌবাচ্চা। শীতকালে কনকনে ঠান্ডা জল। তিনটে ঘরের সামনে খোলা বারান্দা। পাশে ছোট একটা রান্নাঘর। গ্যাস শুদ্ধ। বারান্দার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। আমাদের আর সাহুজীর বাড়ী নিয়ে একটা ঘেরা কম্পাউন্ড। মধ্যে অনেক গাছ।
এই খোলা বারান্দাতেই আমাদের খাবার টেবিল। শীতকালে হু হু করে হাওয়া। আমাদের প্রতিবেশী সাহুজী ষ্টিল প্ল্যান্টে সুপারভাইজারী কোনো পোষ্টে ছিলেন। স্বামী, স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ে। সুরেশ, যমুনা আর শেষু। সুরেশ আজ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী। ঐ সময় ও সারাদিন হাসপাতালেই কাটাত।
সাহুজীর বাড়ীতে আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডা বসত। চা পাঁপড় সহযোগে। আরো টুকটাক খাবার দাবার। ঝড় হলেই আমি আর শেষু দৌড়াতাম কে বেশী আম কুড়াতে পারে।
সকাল বেলায় বিনায়কদা বড় মেয়ে প্রানহিতাকে পিঠের উপর একটা ঝোলায় ভরে সাইকেল বা স্কুটারে চলে আসত। তখন প্রানহিতার বয়স বোধহয় দেড় বছর। নিয়োগীর ছোট মেয়ে মুক্তিও বেশ ছোট। এই দুই মেয়ে সারা সকাল আমাদের কোয়ার্টারে খেলত আর আমরা হাসপাতালে রুগী দেখতাম। সন্ধ্যেবেলা আমাদের আউটডোর রাউন্ড শেষ হলে বিনায়কদা তার কোয়ার্টারে ফিরে যেত। আমি, শৈবাল, চঞ্চলা গুটি গুটি ইউনিয়ন অফিসের দিকে রওনা হতাম। সাহুজির বাড়ীতে চা পাঁপড় ভাজা খেয়ে। একসময় আমাদের একটা ছোট্ট বেড়াল ছিল। সন্ধ্যে হলেই আমাদের কোয়ার্টার ছেড়ে হাসপাতালে চলে আসত। চঞ্চলার আউটডোরে গিয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করত। চঞ্চলা কোয়ার্টারে গিয়ে ওকে কিছু খেতে দিয়ে আবার আউটডোরে বসত।
ইউনিয়ন অফিস যাওয়ার সময় বেড়ালটাও আমাদের সাথে যেত। আমরা ইউনিয়ন অফিসে বসে যখন আড্ডা মারছি তখন ও ইঁদুর ধরতো আর মারতো। সবাই খুব খুশী। একদিন বেড়ালটা যে কোথায় হারিয়ে গেল।
আমরা কোয়ার্টারে ফিরে খাওয়া দাওয়া সারতে না সারতেই নিয়োগী প্রায়দিনই এসে হাজির হতো। তারপর শৈবালের ঘরে বসে শুরু হত আড্ডা। আমি, শৈবাল, চঞ্চলা আর নিয়োগী। খানিকক্ষণ পরেই চঞ্চলা ঘুম পেয়েছে বলে আমাদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ত। তার খানিকক্ষণ পরে আমি। শৈবাল আর নিয়োগী গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা মারত। কি এত আলোচনা হত কে জানে।
আমাদের কোয়ার্টারটা পাকা হলেও ছাদ ছিল খাপরার। স্পেশাল খাপড়া। নিয়োগীজি অর্ডার দিয়ে আনিয়েছিল। আমাদের চৌকি,দরজা, জানালা সব ছিল সেগুন কাঠের। সেগুন কাঠগুলো গ্রামবাসীরা দিয়েছিল। ওখানে সেগুন কাঠ কেনা যেত না।
এই খাপরার চালে অনেক ইঁদুর থাকত। একদিন হঠাৎ দেখি একটা বিরাট সাপ, কালো রং, অন্তত চার ফুট, বিছানার উপর পড়লো। সবাই দেখে বললো ওটা বিষাক্ত নয়। ইঁদুর খেতে এসেছে। আমরাও তাকে বিরক্ত করলাম না। চার পাঁচ দিন ছিল সাপটা, অনেক ইঁদুর শেষ করেছিল।
লোহা খাদান পাহাড়ের ওপরে। জঙ্গল কেটে খাদান তৈরী হত। খাদানে blasting-এর সময় অনেক পশু পাখি মারা যেত বা অজ্ঞান হয়ে যেত। আর শ্রমিকেরা যাই পেত আমাদের এসে দিয়ে যেত। একবার একটা বিরাট বাজ পাখি নিয়ে এল। অজ্ঞান, সামলে সুমলে রাখা হল। সন্ধ্যেবেলা জ্ঞান ফিরতেই উড়ে চলে গেল।
আরেকবার দুটো বাঘের বাচ্চা নিয়ে এল, একেবারেই ছোট। বোতলে করে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে, দিন দুয়েকের মধ্যেই একটা বাচ্চা ডায়েরিয়া হয়ে মারা গেল। অন্যটিকে তড়িঘড়ি করে ভিলাই ষ্টীল প্ল্যান্টের চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসা হল। এরপর আসে একটা অজগর, দুটো বাঁদর। অজগরকেও শেষ পর্যন্ত চিড়িয়াখানাতেই দিয়ে আসতে হয়।
তারপর এলো দুটো হরিণের বাচ্চা। তাদের মা মারা গেছে। তাদের নাভি তখনও শুকায়নি।
আমরা বোতলে করে দুধ খাওয়াতাম। এই সময় আমার মা তিনমাস ওখানে গিয়ে ছিল। মা দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব নিল, কিন্তু মাঝে মাঝেই ওদের ডায়েরিয়া হত। Gentamycin injection দিতাম। কিন্তু একদিন একটা মারা গেল। তার নাম ছিল বড়ি। অন্যজন ছোটি কিন্তু বেঁচে গেল। দীর্ঘদিন আমাদের কাছে ছিল। আমাদের, সাহুজির বাগানে খেলে বেড়াত।
নিয়োগী একসময় চেষ্টা করে ওর বিয়ে দেওয়ার। একজনের পোষা একটা মদ্দা হরিণকে আনা হল। মাথায় বিরাট সিং। দুদিন ছিল। কোন লাভ হল না। ছোটি তার ধারে কাছেই ঘেঁষল না।
কোয়ার্টারে আসার পর আমাদের খাওয়াদাওয়ার খুব একটা পরিবর্তন হল না। দু বেলা ইউনিয়ন মেস থেকে ডাল ভাত সব্জি আসত, তবে সকালবেলার নাস্তায় দোকানে গিয়ে ফুলুরি খাওয়ার বদলে আমরা বাসী ভাত পেঁয়াজ, লঙ্কা, টমাটো দিয়ে ভেজে খেতাম। আর চঞ্চলা মাঝে মাছ বা অন্য সব্জি রান্না করত। মাছ ওখানে বেশ সস্তা ছিল, বিশেষ করে রুই, কাতলা, অপেক্ষাকৃত বেশী দাম ছিল আড় মাছের। কাঁটা কম বলে স্থানীয়রা আড় পছন্দ করত।
আর ছিল মাঝে মাঝে শ্রমিকদের বাড়ীতে খাওয়া, আমন্ত্রিতদের জন্য সাধারণত মুর্গী বানানো হত। তবে ওরা মুর্গীর ছাল ছাড়াত না। এই মুর্গী খেতে আমার ভালো লাগত না। মাঝে মাঝে মাছও খাওয়াত। ওখানে মাছ রান্না করার পদ্ধতি আলাদা। মাছ প্রথমে ভেজে নেওয়া হয় না। তেলে ফোড়ন দিয়ে সব্জি মাছ একসাথে কড়াই-এ। গরীব বাড়ীতে তেলের পরিমাণ কম। তাই একটু আঁশটে গন্ধ থাকত।
আমাদের খাওয়ার অবস্থা দেখে নিয়োগী মাঝে মাঝে ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করত। আমাদের কোয়ার্টারেই। আশা আর চঞ্চলা রান্না করত। নিয়োগীর ফেবারিট রান্না ছিল পুঁইশাকের পাতা বেসন দিয়ে ভাজা। আর অবশ্যই নিয়োগী নিখুঁত ভাবে একটা স্যালাড বানাতো।
মাঝে মাঝে নিয়োগী আমাকে আর শৈবালকে জীপ চালিয়ে বিকেলের দিকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেত। বস্তার, অবুঝমার বা আশে পাশের জঙ্গলে।
একদিন নিয়োগী আমাকে এসে বললো, চলুন ডাক্তারবাবু শিকার করে আসি। দুজনে বেরোলাম। নিয়োগী জীপ চালিয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা গ্রামে গিয়ে পরিচিত একজনকে ডাকলো। সে টোটা বন্ধুক নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমরা তিনজন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। লোকটা অব্যর্থ নিশানায় ছটা গুলিতে ছটা পাখি মারল। কি পাখি মনে নেই। আমি একবার বন্দুক চালাতে চেয়েছিলাম, দিল না। বলল একটা গুলির যা দাম পাখি না মরলে পুরো ক্ষতি। যাইহোক তার বাড়ীতেই পাখিগুলো রান্না করে খাওয়া হল। মাঝরাতে ফেরত।
এবার একদিনের ঘটনা বলে স্মৃতি সংযোজন শেষ করি। একবার কানপুর থেকে একজন শ্রমিক নেতা এলেন। Textile mill-এর শ্রমিক। নিজেই byssinosis-এর রুগী, কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে যান। রোজ সকালে ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে বসে থাকেন। নিয়োগীর আর সময়ই হয় না। সকালে বেরিয়ে যায়, গভীর রাতে ফেরে. তিন-চারদিন কেটে গেল। তারপর একদিন নিয়োগী তাকে বলল, চলিয়ে আজ হমলোগ বাত কারেঙ্গে। তারপর তাকে জীপে নিয়ে চললো, সাথে আমি, বিনায়কদা, শৈবা্ল, চঞ্চলা আর দুজন স্থানীয় শ্রমিক। নিয়োগীই ড্রাইভার। আমরা জঙ্গলের রাস্তায় প্রচুর ঘুরলাম, অনেক গ্রামে দাঁড়ানো হল। সব গ্রামেই নিয়োগীর পরিচিত লোকজন নিয়োগীকে অভ্যর্থনা জানাল।
শেষমেষ, একজন পরিচিতের বাড়ীতে গিয়ে নিয়োগী বললো আজ আমরা এখানে খাবো, সে তো মহাখুশী। মুরগী কাটতে গেল। তখন রাত প্রায় নটা।
আমরা তার বারান্দায় লাইন দিয়ে বসলাম। একটা কুপির আলোয় আধা অন্ধকার। কানপুরের শ্রমিক নেতা বলতে শুরু করলেন। প্রায় দু-চার মিনিট পরেই শোনা গেল নাক ডাকার আওয়াজ, নিয়োগী নাক ডাকছে। নেতাজী থামলেন না, ধীরে ধীরে বলেই চললেন। মিনিট কুড়ি পঁচিশ পরে নিয়োগী নাক ডাকা থামিয়ে আচমকা বলে উঠল, ইয়ে আপ ঠিক নেহি বোলে কমরেড। আমরা তাড়াহুড়া করে নিয়োগীকে থামিয়ে দিয়ে ফিসফস করে বললাম—আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন।
চলবে…………