এমন কেউ আছেন যার সারা জীবনে একবারও খুশকি হয়নি? খুশকি সারানোর শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের অন্ত নেই, আর খুশকিরও অন্ত নেই। সকালে শ্যাম্পু করুন, বিকেলে খুশকি ফিরে আসবে, নাহলে পরদিন! বিজ্ঞাপনে দেখায় বটে চিরকালের মতো খুশকি সারে, কিন্তু বাস্তবে? উঁহু! কেন খুশকি হয়? এমন কোনও খুশকি আছে যা ডাক্তাররা সারাতে পারেন? চিরকালের মত সারিয়ে ফেলার মতো আছে নাকি কোনও ওষুধ?
বাচ্চাদের কথা বাদ দিলে, বড়দের খুশকির দুটো ভাগ। একটাতে খুশকি আসে একা, তার পেছনে অন্য কোনও রোগ নেই। আর অন্যরকম খুশকি হল কোনও একটা রোগের বহিঃপ্রকাশ—কেবল চামড়ার রোগ, এমনকি দেহের ভেতরের রোগও পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে।
কেবল খুশকি
বড়দের খুশকি সাধারণত আরম্ভ হয় বারো-তেরো বছর বয়স থেকে। বয়ঃসন্ধি। হরমোনের ক্রিয়ায় মাথার তৈলগ্রন্থিগুলো সক্রিয় হয়, তেল না মেখেই মাথা কেমন তেলতেলে হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে আসে খুশকি। সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো খুশকি মাথা থেকে ঝরে পড়ে, মাথা চুলকায়, কিছু চুল ওঠে। কখনও-সখনও মাথাতে বেশ বড় চাকলার মতো খুশকি বেরয়।
এই খুশকির সঙ্গে আর কোন চর্মরোগ থাকে না বটে, কিন্তু ডাক্তাররা খুঁজে খুঁজে এতেও মাথার চামড়ায় একধরনের ছত্রাক বের করেছেন—পিটাইরোস্পোরাম। ডাক্তারদের মতে এই খুশকিও আসলে সেবোরিক ডার্মাটাইটিসের একটা মৃদু আক্রমণ। ফলে কেবল খুশকিকে এখন আর কেবল একলা-খুশকি বলা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা পণ্ডিতদের জন্য। আমাদের মোদ্দা কথা এই যে, এরকম খুশকিতে সাধারণ শ্যাম্পুতেই ভালো কাজ হয়, তবে বিভিন্ন অ্যান্টিফাঙ্গাল মিশ্রিত শ্যাম্পু কখনো-সখনো আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। ‘কাজে হয়’ মানে সেরে যায় তা নয়, সাময়িকভাবে কমে, আবার ফিরে আসে।
অন্য ত্বকরোগ থেকে খুশকি
‘কেবল-খুশকি’-কে এখন ডাক্তাররা বলছেন, মৃদু সেবোরিক ডার্মাটাইটিস। সেবোরিক ডার্মাটাইটিস নামটা গালভারী হলেও এই রোগ খুব কমন। মৃদু রোগে কেবল-খুশকি হয়। একটু বেশি রোগে ত্বকের অন্যত্র, বিশেষ করে মুখে, বয়ঃসন্ধির পরে জায়গায় জায়গায় হালকা সাদা ছোপ হয়। ত্বক শুষ্ক থাকলে এইসব ছোপের জায়গা থেকে একটু পাতলা আঁশ ওঠে। তবে সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বাড়াবাড়ি করলে অনেক জায়গার ত্বক থেকে আঁশ ওঠে, লাল হয়, চুলকায়। এরকম হওয়া অবশ্য তত সাধারণ নয়, আর এরকম হলে ডাক্তারকে দেখানই বুদ্ধিমানের কাজ।
এছাড়া মাথার ত্বকে সোরিয়াসিস হলে সেখানটা লাল হয়ে যায় এবং সেই জায়গা থেকে আঁশ উঠতে থাকে। সোরিয়াসিস-এর ক্ষেত্রে মাথার যেটুকু অংশে সোরিয়াসিস থাকে সেটুকু অংশ সুস্থ চামড়ার থেকে একটু উঁচু আর লাল হয়ে যায়, বাকি সুস্থ চামড়া থেকে খুশকি বিশেষ ওঠে না। সেবোরিক ডার্মাটাইটিস-এ কিন্তু সারা মাথা জুড়ে কমবেশি খুশকি ওঠে, এবং সুস্থ চামড়া আর অসুস্থ চামড়া এদুটো আলাদা করা শক্ত।
এছাড়া মাথার চামড়ায় কয়েকরকম একজিমা হলে খুশকি হতে পারে। যেমন বাচ্চাদের মাথায় অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস হলে খুশকি হয়। মাথা চুলকায়, লাল হয়ে যায়, এবং অল্পবিস্তর আঁশ ওঠে। মুখে বা শরীরের অন্যত্র এই রোগের উপসর্গ দেখা যায়।
আমাদের শরীরে দাদ হয় যে ছত্রাক সংক্রমণ, সেই ছত্রাক সংক্রমণ মাথায় হলে কখনো সখনো তা খুশকির মতো দেখাতে পারে। বাচ্চাদের এটা বেশি হয়। সেখানে ফোলা, ব্যথা, লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি—এসব অনেক বেশি থাকে। তাছাড়া দেহের অন্যত্র ছত্রাক সংক্রমণ পাওয়া যেতে পারে, বাড়ির অন্যদের দাদ জাতীয় ছত্রাক সংক্রমণ দেখা যেতে পারে।
একটু বয়স্ক লোকেরা অনেক সময় মাথায় খুশকি আর চুলকানি নিয়ে আসেন। পরীক্ষা করলে দেখা যায় তারা কোন কলপ মেখেছেন, এবং তারপর থেকেই এরকম হচ্ছে। এটা আসলে কলপে এলার্জি থেকে একজিমা। কলপ থেকে এমন হওয়া খুব বেশি দেখি, তবে অন্য কিছুর এলার্জি থেকেও একজিমা হতে পারে—যেমন তেল এবং শ্যাম্পুতে দেওয়া নানা গন্ধদ্রব্য থেকে।
লাইকেন প্লেনাস একটি ত্বকরোগ, মাথার চামড়ায় হলে অনেক সময় খুশকির মতো উপসর্গ হয়। চামড়ায় সীমাবদ্ধ একটি রোগ ডিস্কয়েড লুপাস এরিথেম্যাটোসাস, আর দেহের প্রায় সমস্ত অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে এমন রোগ সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস—এদুটি রোগে মাথায় খুশকির মতো হতে পারে। ইকথিওসিস নামে ত্বকরোগে মাথা থেকে খুশকির মতো আঁশ উঠতে পারে। এছাড়াও কিছু ত্বকরোগের বিরল ধরনে, এমনকি কিছু ক্যানসার-জাতীয় রোগের (টি-সেল লিম্ফোমা) উপসর্গ হিসেবে খুশকি দেখা যেতে পারে। তাই বাড়াবাড়ি ধরনের খুশকি, খুশকির সঙ্গে ত্বকে অন্যত্র রোগ, বা শরীরে অন্য উপসর্গ থাকলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
নবজাতকের খুশকি
বাচ্চা জন্মানোর ঠিক পরে তার মাথায় অল্পবিস্তর খুশকি হয়। এই ব্যাপারটা প্রায় সব বাচ্চারই হয়, এবং কোনও রোগ ছাড়াও এরকম খুশকি হতে পারে। আমাদের ত্বকের উপরের কোষগুলি চামড়ার কোষগুলি দ্রুত বিভাজিত হয়, এবং চামড়ার উপরিতল থেকে খসে পড়তে থাকে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এইভাবেই আমাদের ত্বকের নবীকরণ হয়। মাথার ত্বকের উপরিতলের মৃত কোষগুলো চুলের জালে আটকে যায়। বাচ্চাদের কোষ দ্রুত বিভাজিত হয়, তার ওপর বাচ্চাদের মাথা পরিষ্কার করা অনেক সময় শক্ত। তাই ঝরা কোষগুলো চুলে আটকে থাকে আর সাদাটে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাথার উপর দেখা যায়—তখন আমরা বলি বাচ্চার মাথায় খুশকি হয়েছে।
কোনও কোনও বাচ্চার অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের খুশকি হয়, এবং খুশকির আঁশগুলো মাথার সঙ্গে লেগে থাকে। এই ব্যাপারটা কিন্তু কম বাচ্চার ক্ষেত্রেই হয়, এবং এদের অন্য কোন ত্বকের রোগ থাকার সম্ভাবনা। এরকম দেখলে চিকিৎসককে দেখাবেন—হয়তো বাচ্চার সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস আছে। আবার উকুন থেকেও মাথায় খুশকির মতো গুঁড়ো হতে পারে।
চিকিৎসা
সাধারণ খুশকির প্রাথমিক চিকিৎসা হলো মাথায় তেল না দেওয়া এবং নিয়মিত শ্যাম্পু করা। এতে কাজ না হলে মাথাতে বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ শ্যাম্পু
বলতে স্যালিসাইলিক এসিড, জিংক পাইরিথিয়ন, সেলেনিয়াম সালফাইড, কিটোকোনাজল অথবা কোল টার মিশ্রিত শ্যাম্পু—এসব রাসায়নিকের একটি বা একাধিক শ্যাম্পুতে মেশানো থাকতে পারে।
এছাড়া নির্দিষ্ট অসুখে নির্দিষ্ট ওষুধ দিতে হয়। সেটা কিন্তু নিজে নিজে দিলে বিপদ হতে পারে। সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসে স্টেরয়েড লোশন দিতে হয়, কিন্তু মাথার উকুনে স্টেরয়েড দিলে তা বেড়ে যাবে, অন্য জীবাণু সংক্রমণ হবার সম্ভাবনাও বাড়বে।
তাই সাধারণ খুশকিতে প্রথমে মাথায় তেল লাগানো বন্ধ করা ও সাধারণ শ্যাম্পু দেওয়া যেতে পারে। কোনো শ্যাম্পুতেই ‘খুশকি সারানো’-র গ্যারান্টি নেই। তবে খুশকি কমে। যেটা দিয়ে ভাল লাগে সেটা দেবেন। তাতে কাজ না হলে বা বেশি খুশকি হলে ডাক্তার দেখানো দরকার। খুশকির সঙ্গে অন্য কোনও চর্মরোগ থাকলে, বা দেহের অন্য কোনও উপসর্গ থাকলেও দেরী না করে ডাক্তার দেখান।
সাধারণ খুশকি সারার কোনও ওষুধ নেই, শ্যাম্পু ইত্যাদি করে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। একসময় কমে যায়, তারপর আস্তে আস্তে সেরে যায়। তবে কবে সারবে তা বলা অসম্ভব। আর নানা রোগের সঙ্গী হিসেবে ফাউ আসে যে খুশকি, সেগুলো সাধারণত মূল রোগ সারালে তবে সারে। অবশ্য সব মূল রোগ চট করে সারে না—যেমন সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস। আবার উকুন থেকে খুশকি হলে তা চিকিৎসা করলে কয়েকদিনে্র মধ্যেই সেরে যায়।
শেষ কথা
খুশকি খুব সাধারণ একটি রোগ। প্রায় সবার হয়।
সামান্য খুশকিতে মাথায় তেল মাখা বন্ধ করে সাধারণ শ্যাম্পু নিয়মিত দিন, তাতে কাজ না হলে ডাক্তার দেখান।
খুশকি বেশি হলে, মাথায় বেশি আঁশ হলে, ত্বকে অন্যত্র কোনও লক্ষণ দেখা দিলে, বা সামান্য খুশকি সাধারণ চিকিৎসায় ভালমতো না কমলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুশকি চিরকালের মতো সারাতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু খুশকি যদি অন্য রোগের কারণে হয় তবে তা ঠিকমত চিকিৎসা ছাড়া সারবেই না।
মাথায় এলাজি