ছবিতে মুখগুলো দেখে থমকে গেলাম। এনারা শ্রমিক বা দিন মজুর। কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে অনেক দূরের ভিন রাজ্যের শহরে থাকেন। কেউ একা, কেউ পরিবার সহ।
লক ডাউনে কাজ বন্ধ। রোজগারও বন্ধ। হাতের টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। কেউ অর্ধাহারে, কেউ অনাহারে। মরিয়া হয়ে তাঁরা মহামারীর মধ্যেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন।
কেউ শিশু পুত্র-কন্যা সহ দেড় শো- দুশো কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেরার চেষ্টা করছেন। কোথাও জনস্রোত অপেক্ষা করছে একটা সরকারি বাসের জন্য।
মেডিসিনে মাস্টার্স ডিগ্রী করার সময় স্যার বারবার বলতেন, ‘ঐন্দ্রিল, মানুষের মুখ ভালো করে লক্ষ্য কর। মানুষের মুখেই অনেক অসুখের ছবি ফুটে ওঠে। শারীরিক যন্ত্রণা, অসহায়তা, মৃত্যু ভয় এইসবের ছবি পড়তে পারলে তবেই চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারবি।’
কিন্তু আজ অনেক চেষ্টা করেও ছবির মানুষগুলির মুখের ভাষা পড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে, আতংক না, মৃত্যুভয়ও না, যেনো একরাশ ঘৃণা ফুটে উঠেছে শ্রমিকদের মুখে। আমাদের মতো স্বচ্ছল গা-বাঁচানো লোকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। ঘৃণা সেই রাষ্ট্রের প্রতি, যে রাষ্ট্র রাতারাতি স্পেশাল প্লেনের ব্যবস্থা করে বিদেশ থেকে প্রভাবশালী নাগরিকদের বাড়ি ফেরাতে পারে, কিন্তু লকডাউন ঘোষণা করার আগে দেশের মধ্যে থাকা নাগরিকদের বাড়ি ফেরার কোনো ব্যবস্থা করে না।
আর এর জন্য দায়ী আমরাই। যে যার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। কোনো দিনও খোঁজ নিইনি আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষগুলো কেমন আছেন। আজ যখন পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে ঘরে ফেরার জন্য লং-মার্চ শুরু করেছেন আমরা বিস্ময়ে অসাড় হয়ে গেছি।
কি আর করতে পারি! শুধু নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রার্থনা করতে পারি বাবা ঘরে ফিরে তার শিশু কন্যার কপালে রোগের ছোঁয়াচ মুক্ত চুমু খাক। যে মা তার দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে পথ হাঁটছেন, ক্লান্তি যেন তাঁদের থামিয়ে না দেয়। শ্রমিকদের এই লংমার্চ যেন করোনা মহামারীর থেকেও বেশি প্রাণঘাতী না হয়ে ওঠে।
এত হাজার হাজার বাস রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো কি শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য ব্যবহার করা যেতো না? ওঁদের জন্য কয়েকটি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা যেতো না?
রেনকোট পরিয়ে চিকিৎসকদের হিরো সাজিয়ে জনসাধারণের সাহস বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা হলো চিকিৎসকরাও এখন নিজেরাই বিপন্ন। অধিকাংশ সামাজিক অসুখের চিকিৎসাই তাঁদের জানা নেই।
পৃথিবীর গভীর… গভীরতর অসুখ এখন।