এতো দিন ফোনে রোগীর কথাবার্তা বিশেষ শুনতাম না। দু’চার কথা শোনার পরই বলতাম, খারাপ রোগী দেখছি। আপনি প্রেসক্রিপশান নিয়ে যোগাযোগ করুন। ফোনে ওষুধ বলা যাবে না।
এখন সেটা করতে পারছি না। রোগীদের দুচার কথা ফোনে শুনতেই হচ্ছে। তাঁদের দুচারটে ওষুধ ফোনেই বলে দিতে হচ্ছে। দেশে লকডাউন চলছে, আমি কি করে তাঁদের আসতে বলি।
মুশকিল হল, তাঁরা ঘরে রয়েছেন। হাতে অফুরন্ত সময়। সারাদিন ধরে যা যা সমস্যা হচ্ছে, ভেবে রাখছেন। তারপর চা খেতে খেতে ফোন করছেন। অন্যদিকে আমি সে সময় চারদিনের জ্বরে নেতিয়ে পরা রোগী দেখছি।
জ্বরের রোগিণীর মা বারবার মুখে আঁচল চাপা দিচ্ছেন। ধমক লাগালাম। উনি বললেন, করোনা রোগের ভয়ে মুখ ঢাকছেন।
বললাম, করোনা ভাইরাস আপনার ভাশুর নয়, যে ঐ মুখ ঢাকায় সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবেন। বরঞ্চ বারবার মুখে হাত দিয়ে আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
বলতে বলতেই আমার মোবাইল বেজে উঠল। বাধ্য হয়ে রোগী দেখতে দেখতেই ফোন ধরলাম। জিনিসটা এই করোনার মরসুমে যথেষ্ট আনহাইজিনিক। কিন্তু না ধরেও উপায় নেই। রোগীকে ছোঁয়া হাতেই মোবাইল ধরে কানে ঠেকাচ্ছি। আমারও সব স্টেরিলিটির গুষ্টি উদ্ধার হয়ে গেল।
কিছু কিছু ফোন রোগীরা প্রয়োজনেই করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ফোনেরই মাথা মুন্ডু থাকেনা। ফোন করেই ওপাশের ব্যক্তি প্রথমেই বলেন, ডাক্তারবাবু, আমি শ্রীকান্ত সাহা, জানুয়ারীর দুই তারিখে আপনার কাছে দেখাতে গেছিলাম মনে পড়ছ?
আমি উত্তর দিই, আজ এপ্রিলের তিন তারিখ, এই তিনমাসে আমি অন্তত দশ হাজার রোগী দেখেছি। প্রত্যকের কথা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কি দরকার বলুন।
ভদ্রলোক অত্যন্ত আহত স্বরে বললেন, মনে পড়ছে না? সত্যি আপনার মনে পড়ছে না? ঐ যে পেটে ব্যথা নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমি একটু রুক্ষ ভাবেই বললাম, যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। খারাপ রোগী দেখছি।
আচ্ছা, ডাক্তারবাবু আমি কলা খেতে পারব?
কেন? কলা খাবেন না কেন? আপনার কি সুগার আছে?
না না। কিন্তু কলা খেলে তো ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আর ঠাণ্ডা লাগলেই তো করোনা ভাইরাস চেপে ধরবে।
আপনি নির্ভয়ে কলা খান। কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা ডাক্তারবাবু তেঁতুল খেলে করোনা হতে পারে? চিনাদের শুনেছি খাবার থেকেই প্রথম করোনা হয়েছিল।
কি আর করি। বললাম, আপনি বাদুড়, সাপ আর আরশোলা ছাড়া আর সব কিছু খান। অত্যন্ত অভদ্র ভাবে ফোন কেটে দিলাম।
জ্বরের রোগীটিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধ লিখতে যাচ্ছি। আবার ফোন। একজন মহিলা ফোন করেছেন।
হ্যালো, ডাক্তারবাবু। আমরা কি এসি চালাতে পারি?
আমি অবাক ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? আপনাদের এলাকায় লো ভোল্টেজ নাকি?
উনি বললেন, না না, গরমে তো করোনা ভাইরাস মরে যায়। এসি চালালে করোনা হবে নাতো?
বাধ্য হয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সঞ্জয়দাকে ডাকলাম। বললাম, একটু ফোনে প্রক্সি দাও। জরুরী মনে হলে আমায় দিও।
রোগী দেখতে দেখতে শুনছি মাঝে মঝেই ফোন বাজছে আর সঞ্জয়দা ফোন ধরছে। দিব্যি সামলে দিচ্ছে। একবারই শুধু আমাকে দিল। ওষুধের দোকান থেকে ফোন করেছে। কি একটা ওষুধ আউট অফ স্টক হয়ে গেছে। পরিবর্তে কি ওষুধ দেবে জানতে চাইছে।
সাড়ে পাঁচটায় বাড়িতে রোগী দেখা শেষ হল। সঞ্জয়দা মোবাইল ফেরত দিল। বলল, দাদা, অনেক ফোন এসেছিল। লোকজন প্যানিকড হয়ে গেছে। সকলেই প্রায় করোনা ঠেকানোর জন্য কি করা উচিৎ জিজ্ঞাসা করছিল। আমি পদ্ধতি বলে দিয়েছি।
পদ্ধতি? কি পদ্ধতি? আমি চমৎকৃত হলাম।
ঐ যে আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর গরম জলে পাতি লেবুর রস দিয়ে দু ঢোঁক করে খেতে হবে।
সর্বনাশ করেছে। এ পদ্ধতি কোথায় পেলে?
ফেসবুকে দেখলাম তো। অনেকেই শেয়ার করেছে।
আমি বললাম, যা করেছ, ভালই করেছ। মোমবাতি জ্বালিয়ে যদি ম্যাক্সওয়েলের মতবাদ অনুযায়ী ম্যাগনেটিভ ফিল্ড তৈরি করে করোনা ভাইরাস ধ্বংস করা যায়, তাহলে গরম জল খেয়েও যায়।
তারপর আরেক জায়গায় রোগী দেখা সেরে রাত্রি ন’টায় বাড়ি ফিরলাম। রাত নটা থেকে কাকুর দোকানে রোগী দেখতাম। আপাতত কাকু করোনাতঙ্কে ভুগছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়বাড়ি হয়েছে। বুকে চাপা ব্যথা, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাকুর ধারণা হার্ট এটাক হয়েছে, এক্ষুণি মরে যাবে।
আধঘণ্টা পরেও বেঁচে থাকায় কাকু নিজের ডায়াগনোসিস চেঞ্জ করেছে। এখন তার মনে হচ্ছে এফেব্রাইল করোনা হয়েছে। তিনদিনের মাথায় মরে যাবে।
তাই আপাতত তিনদিন দোকান বন্ধ। সোমবার অবধি সকলে বেঁচে থাকলে আবার খোলা হবে। বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে আমি ছটা রসগোল্লা খেলাম। যদি মরতেই হয়, তাহলে যেন আপসোস না করতে হয়। তবে সম্ভবত এরাজ্যে আর বেশি কেউ করোনায়? মরবে না।
Thank you.