বাজার করতে আমার ভালো লাগে না। সকাল সকাল রুই মাছের পেট টিপতে ভালো লাগে না। ঢ্যাঁড়শের কোনা ভেঙে দেখতে ভালো লাগে না।
সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন রীতিমতো যুদ্ধ করে ব্যাগ-ভর্তি বাজার এনে বাড়িতে উপুড় করি, তখন সেই সব মালপত্র নিয়ে বাবা আর বউ রীতিমতো বিচার সভা বসায়। ব্যাপারটা যে কতটা অপমানকর, অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝাই মুশকিল। স্টেথো বসিয়ে দিব্যি ফুসফুসে জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে কিনা বোঝা যায়, কিন্তু বেগুনের মধ্যে জীবাণুর সংক্রমণ বুঝবো কি করে?
পাকা পটল বোঝার চাইতে রোগীর হৃদপিণ্ডে ছ্যাঁদা আছে কিনা বোঝা অনেক সহজ। তবু আমাকে প্রায়শই এই অপছন্দের কাজটাই করতে হয়। এবং আমিও যতটা সম্ভব ফাঁকিবাজি করে কাজটা সারার চেষ্টা করি। পাড়ার মুদির দোকান থেকে অধিকাংশ জিনিসপত্র জোগাড় করতে পারলে আর বাজারমুখো হই না।
অনেকদিন পরে আজ বাজারে গেছিলাম। গিয়ে দেখলাম জটিল অবস্থা। বাজারে ঢোকার রাস্তা একটাই। সেখানে স্যানিটাইজেশনের টানেল বসেছে। অনেকেই করোনা মুক্ত হওয়ার জন্য লাইন দিয়েছেন। দুচারটে সবজি কেনার জন্য করোনা মুক্ত হওয়ার ইচ্ছে হল না। ভাবলাম রাস্তার ধারে যারা বসে বিক্রি করছে তাদের কাছ থেকে কিনে নি।
ওভারব্রিজের তলায় বিবেকানন্দ মূর্তির সামনে বেশ ভিড়। বনগাঁ লোকালে ঝুলে মেডিকেল কলেজ জীবন কাটালাম, সেই আমারও আজকাল ভিড় দেখলেই কেমন অস্বস্তি লাগে। স্কুটার থামিয়ে ভিড়ের কারণ বোঝার চেষ্টা করছি, হঠাৎ একজন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি এখানে? বাজারে এসেছিলেন?’
চিনতে পারলাম। আমারই রোগী। বয়সও প্রায় আমার কাছাকাছি। বললাম, ‘বাজারেই এসেছিলাম। ঢুকলাম না। তোমার খবর কি?’
বলল, ‘খবর ভাল নয় ডাক্তারবাবু। কাজকর্ম কিছু নেই। বড়বাজার থেকে কাপড় কিনে এনে ফুটে দোকান করতুম। চৈত্র সেল, ঈদ দুটোই মার গেল। পুজোটাও যদি মার যায়? তাছাড়া ফুটের দোকান থেকে আপনারা তো মাল কিনবেন না। যারা কেনে, লক ডাউনের উঠলেও তাদের হাতে কি জামা কাপড় কেনার পয়সা থাকবে?’
শুনে খারাপই লাগল। এর স্ত্রী পোলিও আক্রান্ত। কোমরের নীচে দুটো পা’ই সরু। হাতে ভর দিয়ে হাঁটে। তার আবার হাঁপানি আছে। বছর দুয়েক আগে প্রেগনেন্সির সময়ে হাঁপানির খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল। তখন মাঝে মাঝেই দেখাতে আসত। মেয়ে হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ইনহেলার নিয়ে ভালো আছে। মাস কয়েক আগে মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। বছর দেড়েকের মেয়েটা দিব্যি ফুটফুটে হয়েছে।
বললাম, ‘তাহলে করছ কি এখন?’
‘কি আর করব। কটা দিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সবজি বেচার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভ্যান চালক, সোনার কারিগর, কারখানার শ্রমিক সবাই সবজি বেচতে নেমে পড়েছে। আমার ভ্যানও নেই। মাথায় করে কত আর সবজি নিয়ে ঘোরা যায়? কতটাই বা ঘোরা যায়? লাভও তেমন নেই। তাই ঐ ধান্দা ছেড়ে রোজ এখানে এসে লাইন দিচ্ছি।’
এইবার আমি কৌতূহলী হলাম। বললাম, ‘এখানে এতো লোক কেন? হচ্ছেটা কি এখানে?’
‘এখানে একটা সংস্থা দুপুরের খাবার দেয়। সেই আশাতেই সকাল থেকে সবাই বসে আছি। খাবার দিলে বাড়ি নিয়ে যাব। তিনজনে মিলে খাব। কোনোদিনও ভাবিনি ডাক্তারবাবু, এই দুটো হাত পা অক্ষত থাকতে থাকতে, শরীরে জোর থাকতেও আমাকে ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে হবে।’
পাড়ার বন্ধুরা চাঁদা তুলে সীমিত সাধ্যের মধ্যে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সেখান থেকে যুবকটিকে সপ্তাহ খানেকের চাল, ডাল, তেল দেওয়া যায়। বললাম, ‘আজ বিকেলে চেম্বারে এসো। পাড়া থেকে তোমাকে কিছু সাহায্য করার চেষ্টা করব। তবে আমাদের ক্ষমতা কম। আর কাউকে নিয়ে এসোনা কিন্তু।’
সে বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব, যে ভাবেই হোক কুড়িয়ে বাড়িয়ে এই দিনগুলো পার করে দিতেই হবে। কোনো কাজ থাকলে বলবেন, ডাক্তারবাবু। যেকোনো কাজ। যা হয় পয়সা দেবেন।’
এটা যে কতবার শুনেছি। আমি সামান্য ডাক্তার। হঠাৎ করে চাকরি ছাড়ার পর নিজেরই আয়ের ঠিক নেই। লক ডাউনের সময় তো আরও নেই। আমি কত জনকে কাজ দিতে পারি?
যুবকটি আবার বলল, ‘শুনেছিলুম ডাক্তারবাবু, করোনা এমন কিছু ভয়াবহ রোগ নয়। অনেকেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, ১৭ তারিখের পর লক ডাউন উঠে যাবে? ট্রেন চালু হবে?’
স্কুটারে স্টার্ট দিলাম। বললাম, ‘বিকেলে এসো কিন্তু।’
প্রায় পালিয়েই বাঁচলাম। জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলাম না, ওর স্ত্রী কেমন আছে। ইনহেলার নিয়মিত নিচ্ছে কিনা।
আমরা সবাই এখন ওদের থেকে পালিয়ে বাচতে চাই।