সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে পরিযায়ী শব্দটা শুনলে পাখির কথা মনে হতো। একদল সুদীর্ঘ গ্রীবার বিহঙ্গ শ্বেতশুভ্র শক্তিশালী পক্ষ মেলে বেরিয়ে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে।
তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আর জন্মস্থানে ফিরে আসতে পারবে না। তবু বড্ড রোমান্টিক লাগতো এই হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টাকে।
মুর্শিদাবাদের এক প্রান্তিক হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর প্রথম শুনলাম পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। যে খড়গ্রাম হাসপাতালে কাজ করতাম সেই গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির অন্তত একজন পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁরা বেশিরভাগই কাজ করতেন মুম্বাইতে। যদিও ওখানকার কেউই মুম্বাই বলতেন না। মুম্বাই এখনো তাঁদের কাছে বোম্বে। চেন্নাই পরিচিত মাদ্রাজ নামে।
মুম্বাই ছাড়াও অনেকে কেরলায় কাজ করতে যেতেন। সেই আমলে কেরলায় একেকজন অদক্ষ শ্রমিক সাড়ে তিনশো টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। সারা বছর কাজ করে ঈদের সময় ফেরত আসতেন। আমরা যারা কোয়ার্টারে থাকতাম ঈদের আগে পরে বাড়ি ফিরতাম না। ট্রেনে বাসে বড্ড ভিড় হতো।
এছাড়াও ধান কাটার মরসুমে লোকজন দল বেঁধে বর্ধমান, বীরভুমে যেতেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে কলকাতা ও শহরতলিতে যেতেন।
অনেকে বেশি আয়ের লোভে আরব, কাতার, কুয়েত ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও যেতেন। এইসব দেশগুলোতে যারা যেতেন, অনেকেই আর ফেরত আসতেন না। তাঁদের বিদায়ের সময় বাড়ির লোকজন প্রায় মরাকান্না কাঁদতেন। এরকম বেশ কয়েকটি বিদায় দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো বিপদ আছে জেনেও এতো মানুষ জন্মস্থান ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন কেন? এনারা আর যাই হোন অন্তত মানসিক ভাবে লিভিংস্টোন নন।
এর কারণ বুঝেছিলাম একদিন ডাঃ পীযূষ কান্তি পালের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে। কাছের একটা বিলে পরিযায়ী পাখি দেখতে গেছিলাম। পীযূষদা কান্দির ছেলে। এ অঞ্চলের নাড়ি নক্ষত্র চেনে। বলল, ‘আগে অনেক পাখি আসতো। এখন আর আসে না। যে কটা আসে বেঁচে ফেরে না।’
আমি বললাম, ‘কেন, পাখি মারা তো নিষিদ্ধ?’
‘সে-তো অনেক কিছুই নিষিদ্ধ। কিন্তু রাতের অন্ধকারে এই জলা জঙ্গলে পাখি মারলে কে আর দেখতে আসছে।’
পাখি দেখে আলপথ ধরে ফিরছিলাম। চারিদিকে ধানের জমি। অজস্র আল দিয়ে ভাগ করা। বললাম, ‘এতো আল কেন? এতে তো অনেকটা জমি নষ্ট হয়।’
পীযূষদা বলল, ‘একজন মারা যায়, আর জমি তার সন্তানদের মধ্যে ভাগ হয়। আলের সংখ্যা বেড়ে যায়। কয়েক দশক পর আর চাষের জমি থাকবে না। শুধুই আল।’
মুর্শিদাবাদ সম্ভবত সবচেয়ে জনঘনত্ব পূর্ণ এবং সবচেয়ে অবহেলিত জেলা। এখানকার রেশম জগৎ বিখ্যাত। কিন্তু যাঁরা রেশম শিল্পের সাথে যুক্ত তাঁদের অবস্থা দেখলে চোখে জল আসতে বাধ্য। ফুটন্ত জলে সরাসরি হাত ডুবিয়ে সিদ্ধ রেশম গুটি তুলে আনছেন। এবং সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়েও বাড়ির সকলের দুই বেলা ভাত জুটছে না।
ওই অঞ্চলের আর একটি বড় শিল্প বিড়ি শিল্প। আট থেকে আশি বছরের সকলেই সামান্য মজুরির বদলে সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিড়ি বাঁধছেন। সারাক্ষণ তামাক ঘাঁটায় তাঁদের বুকে বাসা বাঁধছে যক্ষ্মা।
মুর্শিদাবাদের আরও একটি শিল্প আছে। বোমা শিল্প। খড়গ্রাম ব্লকের সাদল, শংকরপুর সেই সময় ছিল বোমা বাধার জন্য বিখ্যাত। রাজনৈতিক মদতে ঘরে ঘরে বোমা তৈরি হতো। খুন জখম ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। একটি ছাগলের জীবনের দাম ছিলো মানুষের চেয়ে বেশি।
এখানকার অধিকাংশ মানুষই অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর। জমির অভাবে এবং শিল্পের অভাবে অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যেতেন। এবং বেশিরভাগ মানুষই শূন্য হাতে শরীরে রোগ নিয়ে ফেরত আসতেন।
মুম্বাই বা কেরলে একটা ঘরে তাঁরা গাদাগাদি করে পশুর মতো থাকতেন। যার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। অসুস্থ হলে মালিক কোনো দায় দায়িত্ব নিতেন না। তাঁকে হাওড়া বা শিয়ালদার ট্রেনে তুলে দিয়ে দায় সারতেন।
কিভাবে যে পরিযায়ী শ্রমিকটি শেষ পর্যন্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় খড়গ্রাম হাসপাতালে এসে পৌঁছাতেন, সেটা ছিল একটা রহস্য। তাঁরা বেশি আক্রান্ত হতেন ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মায়। তাছাড়া এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগও বিরল ছিল না। মুম্বাই থেকে যাঁরা আসতেন তাঁদের ম্যালেরিয়া সহজে সেরে যেতো। কিন্তু যারা ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বিভিন্ন খনিতে কাজ করতেন, তাঁদের ম্যালেরিয়া ছিলো ভয়ংকর।
তখন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার আর্টেসুনেট কম্বিনেশন থেরাপি সবে চালু হয়েছে। তবু্ও সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েকজন জঙ্গলের ম্যালেরিয়া রোগীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।
তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা ও মৃত্যু দেখেও অন্যরা ভয় পেতেন না। বাবার মৃত্যুর পর একমাসের মধ্যেই ছেলে মুম্বাইয়ে রওনা দিয়েছে। বিধবা মা সম্মতি দিয়েছেন আরও ছোটো দুজন সন্তানের কথা ভেবে।
লক ডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা হঠাৎ করে সবার সামনে বে আব্রু হয়ে গেছে। কিন্তু এই সমস্যা আজকের নয়, বহু দিনের। এই সমস্যার সমাধানের জন্য দরকার জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় ভাবে কাজের ব্যবস্থা করা।
নিজের চোখে দেখেছি মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ কি অপূর্ব নকসি কাঁথা তৈরি করছেন, অথচ তার ঘরে চাল বাড়ন্ত। রেশম শিল্পীদের অবিস্মরণীয় কাজ দেখেছি। রাতে নিকানো দাওয়ায় বসে হ্যাঁচাক আর চাঁদের আলোয় অলৌকিক রায়বেঁশে নৃত্য দেখেছি, মুর্শিয়া গান শুনেছি।
কিন্তু সভ্যতার কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। আস্তে আস্তে এসব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। মুর্শিদাবাদ পরিচয় পাবে সস্তায় শ্রমিক সরবরাহকারী জেলা হিসেবে।
করোনার দিনগুলিতে তাঁদের নিয়ে একটু নাড়াচড়া হবে। তারপর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে তাঁদের কথা কেউ ভাববে না।
পরিযায়ী শ্রমিক এখন গাঁ গঞ্জে এমন কি নিজের পরিবারেও অচ্ছুত ডাক্তার বাবু।
,এদের কথা কেউ ভাবেনা কোনোদিন।