ঘুমের মধ্যে রোগী দেখছিলাম। সবই জটিল জটিল রোগ। কারো পেট ফুলে ঢোল। কারো হৃদযন্ত্রে ছ্যাঁদা। নড়লে চড়লেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কারো আবার সারা গায়ে লাল, নীল, সবুজ রঙের ছোপ ছোপ বেড়িয়েছে। যেন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। এমন অদ্ভুত স্কিন লেশন বাপের জন্মে দেখিনি।
সমস্যা হলো কাউকে কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বললেই তিনি বলছেন, ‘লকডাউনের পর করব।’
হাসপাতালে ভর্তি হতে বললে বলছেন, ‘লকডাউনের পর ভর্তি হব।’
একজন বললেন, ‘লকডাউনের পর ওষুধটা খেলে হয় না?’
স্বপ্নের অন্যতম অসুবিধা অনেক জানা জিনিসও মনে পড়ে না। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘লকডাউনটা কি?’
তিনি বললেন, ‘আমি গরীব মানুষ বাবু। অতশত কি বুঝি। আপনাকে বরঞ্চ লকডাউনের পর ভিজিট দেব।’
হঠাৎ স্ত্রীর অতিরিক্ত মিঠে হাতের চাপড়ে ঘুম ভেঙে গেল। রূপালী বলল, ‘এতো বেলা অবধি ঘুমালে চলবে। ওদিকে যে জল শেষ হয়ে গেল।’
বলতে গেলাম, ‘ঘুমালাম কই। সারারাত তো রোগীই দেখলাম।’ তখনই হঠাৎ খেয়াল হল, সারারাত রোগী দেখে বেশ কিছু টাকা পয়সা উপার্জন করেছিলাম। স্বপ্নের টাকা ঘুম ভাঙার সাথেই মিলিয়ে গেছে। আহারে, অনেক গুলো টাকা।
রূপালীর তীক্ষ্ণ আওয়াজ আবার পেলাম, ‘কি গো, চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে রইলে কেন? আবার ঘুমাচ্ছো নাকি?’
বললাম, ‘ঘুমাবো কেন, আমি দেশের কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করছি।’
রূপালী টেনে দাঁড় করিয়ে হাতে দুটো বালতি ধরিয়ে বলল, ‘বাড়ির পরিস্থিতি আরও কঠিন। এক ফোঁটা জলও নেই। শিগগিরী দু বালতি জল নিয়ে এস। নইলে স্নান তো দূরের কথা, চা টুকুও জুটবে না।’
বাড়ির সামনে হট্টগোলের শব্দ। বললাম, ‘অনেক রোগী এসেছে মনে হচ্ছে। গেলেই এখুনি দেখে দেওয়ার জন্য ধরবে। তুমি ওনাদের দুপুরে আসতে বলে বিদায় করো। তারপর জল এনে দিচ্ছি।’
রূপালী বলল, ‘শিওর তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। সবাইকেই রোগী ভাবছ। ওটা জল নেওয়ার লাইনের কোলাহল।’
বাড়ির সামনে কর্পোরেশনের জলের গাড়ি দিয়েছে। ঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে লাইনে দাঁড়ালাম।
একটা ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘একি তুমি মাস্ক পরোনি কেন? ছি ছি, ডাক্তারই যদি মাস্ক না পরে অন্যরা কি শিখবে!’
মেয়েটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মুখ ঢাকা থাকায় চিনতে পারছি না। বললাম, ‘খুকু, জল নেব আর চলে যাব। এটুকুর জন্য….’
মেয়েটি বলল, ‘অন্তত এক ঘন্টা লাগবে। লাইন দেখেছো। ততক্ষণে অন্তত গোটা দশেক করোনা ভাইরাস তোমার ফুসফুসে ঢুকে পড়বে।’
এবার মেয়েটাকে চিনতে পারলাম। সানাই, আমারই বড় মেয়ে। ছোটো ছোটো দুটো বালতি নিয়ে অনেকটা আগে লাইনে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা মাস্ক পরে এলাম।
লাইনের পিছনের কাকু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা বুমবাই, এই জল খেলে কি রক্ত আমাসা হবে?’
বললাম, ‘ফুটিয়ে খাবেন।’
‘টাইফয়েড হতে পারে?’
‘ফুটিয়ে খেলে হবে না।’
‘করোনা হতে পারে?’
নাও, ঠ্যালা সামলাও। সারারাত রোগী দেখেও নিস্তার নেই। বললাম, ‘জল থেকে করোনা হয় না। তবে জলের লাইন থেকে হয়। আপনি আমার এতো কাছাকাছি আসবেন না।’
একজন পার্ট টাইম মাস্ক বিক্রেতা জলের ট্যাংক দেখে দাঁড়িয়েছেন। দু লিটারের খালি বোতল বার করেছেন। সাইকেলের সামনে লাল, নীল, হলুদ- রঙবেরঙের মাস্ক ঝুলছে। নাকের জায়গায় নিশ্বাস নেওয়ার সুবিধার জন্য জাল জাল করা। ওই মাস্কে ভাইরাস আটকাবে না। মাস্ক বিক্রেতার দারিদ্র্যও আটকাবে না।
পাড়ার এক দয়ালু কাকিমা বোতলটা নিয়ে জল ভরে দিলেন। জলই এখন শ্রমজীবী মানুষের প্রধান খাদ্য। আম্ফান ঝড়ের পর সেই খাদ্যেরও অভাব দেখা দিয়েছে।
কতক্ষণ লাগবে বুঝতে পারছি না। পাড়ার এক দাদা হার্ট এটাকের কারণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো। এমন সময় হঠাৎ চিৎকার ‘জ্যোতি বাবু ফিরে এসেছেন, জ্যোতি বাবু ফিরে এসেছেন…’
অনেকেই বাড়িতে দৌড়ালেন হঠাৎ আসা কারেণ্টের সদব্যাবহার করতে। যেসব সৌভাগ্যবান ব্যক্তির বাড়ির রিজার্ভারে এখনো জল আছে, তাঁরা পাম্প চালাবেন। কেউ পাঁচদিন পরে পাখার হাওয়া খাবেন।
লাইন বেশ ফাঁকা হয়ে গেল। আর দশটা মিনিট কারেণ্ট থাকলে আমার দুটো বালতি ভরে যাবে।
★গতকাল সকালের কাহিনী। তখন নেট না থাকায় পোস্ট করা যায়নি। এখনো নেটের অবস্থা সুবিধাজনক নয়।