একদিন চেম্বার বন্ধ থাকলে পরদিন দ্বিগুণ রোগী দেখতে হয়।
রবিবার গেছিলাম মিনাখাঁর আমফান বিধ্বস্ত গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্প করতে। সোমবার তাই বিপদে পড়লাম। সকাল সকাল ঘোলার দাস মেডিকেলের খুপরিতে ঢুকতেই দাস কাকু বললেন, ‘ডাক্তার বাবু, হাত চালিয়ে। নইলে বারোটার মধ্যে বের হতে পারবেন না। অনেক পেশেন্ট।’
বললাম, ‘যারা ক্রনিক পেশেন্ট পারলে ভাগিয়ে দিন। পরে আসবে।’
‘ডাক্তারবাবু, গতকাল একবার ভাগিয়েছি। আজ আবার ভাগালে এবার দোকানে ভাঙচুর করবে।’
কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। ঘাড় গুঁজে রোগী দেখতে শুরু করলাম। এই খুপরিটা সবচেয়ে ছোট। এসি একটা আছে বটে, কিন্তু চলে না। গত চার বছর ধরে ওটাকে অচল অবস্থায় দেখছি। সম্ভবত ভেতরে মেশিনপত্র নেই। এসির খোলস টানিয়ে চেম্বারটা কে জাতে তোলার চেষ্টা হয়েছে। থাকার মধ্যে আছে একটা টেবিল ফ্যান। সেটা আবার ঘুরে ঘুরে হাওয়া দেয়। মাস্ক পরে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছিলাম।
ঘড়ির কাঁটা ক্রমশ বারোটার ঘরের দিকে যাচ্ছে। আমার উত্তেজনাও বাড়ছে। সাড়ে বারোটার মধ্যে বাড়ির চেম্বারে না পৌঁছাতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। বাইরে বেশ কোলাহল। তার মানে এখনো অনেক রোগী নিজেদের মধ্যে লাইনের সিরিয়াল নিয়ে গণ্ডগোল করছে। আজ কপালে দুঃখ আছে।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দুপদাপ করে চেম্বারে ঢুকলেন। বললাম, ‘নাম বলুন।’
ভদ্রলোক নামটা বলেই বললেন, ‘চিনতে পারলেন?’
বললাম, ‘না তো। কেন বলুন তো?’
‘আসলে আমি তো একজন বিখ্যাত মানুষ। কুখ্যাতও বলতে পারেন।’
বললাম, ‘বলুন, সমস্যাটা কী?’
উনি বললেন, ‘আমার করোনা হয়েছে….’
ডাক্তাররা কিছুতেই চমকায় না। সারাদিন আজব আজব ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে তাদের চমকিত হওয়ার ক্ষমতা চলে যায়। বললাম, ‘ইয়ার্কি মারছেন নাকি?’
‘ছি ছি। ইয়ার্কি মারব কেন? তাছাড়া ডাক্তার আর ভগবানের সাথে কেউ ইয়ার্কি মারে? আপনি সত্যি আমার নাম শোনেন নি?’
‘কেন, আপনি কি বাংলা সিরিয়াল করেন? ওই সব সিরিয়াল আর খবরের চ্যানেল আমি দেখিনা কখনো। একটা সিরিয়াল একটু খানি দেখেছিলাম। শাশুড়ি আর তার মেয়ে মিলে পরিকল্পনা করছে- কি করে বৌমাকে ওষুধ দিয়ে পাগল বানাবে। বাপরে…’
ভদ্রলোক করুণ মুখে বললেন, ‘আমার নাম শোনেন নি আপনি? সত্যিই কি শোনেন নি আমার নাম?’
নেতিবাচক ঘাড় নাড়ালাম। বললাম, ‘একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। সময়ের বড় অভাব।’
ভদ্রলোক তাতে কান দিলেন বলে মনে হলো না। বলে চললেন, ‘অথচ আমি ভাবতাম করোনা হওয়ার পর আমাকে সবাই চিনে গেছে। ফেসবুক- হোয়াটসঅ্যাপে আমার ছবি, ঠিকুজি-কুলুজি দিয়ে পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল।’
আমি বললাম, ‘আপনার করোনা হোক, জলাতঙ্ক হোক- যাই হোক আমার কাছে কেন এসেছেন বলুন।’
ভদ্রলোক এবারও আমার কথা শুনলেন না। বললেন, ‘সারা জীবনে কেউ পাত্তা দিত না। নিজের বউও না। আর একাত্তর বছর বয়সে করোনার কল্যাণে হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে গেলাম। খারাপ লাগছে না, বুঝলেন ডাক্তারবাবু। কেউ কোনোদিন বাসের সিটও ছেড়ে দেয়নি। আজ করোনা হয়েছে বলে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে সবাই লাইন ছেড়ে দিলো।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি নিজেই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন আপনার করোনা হয়েছে?’
উনি বারাসতের জি এন আর সি হাসপাতালের একটা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট বের করলেন। বললেন, ‘না হলে তো আমাকে চৌদ্দ জনের পেছনে লাইন দিতে হতো।’
ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে চোখ বোলালাম। কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে এপ্রিলের ১০ থেকে ২৫ তারিখ অবধি ভর্তি ছিলেন। বললাম, ‘আমার কাছে কেন?’
উনি সুগারের রিপোর্ট বার করলেন। সুগার খালি পেটে ২৭৮। প্রেসার মাপলাম। উপরেরটা ১৭০ ছাড়িয়েছে। বললাম, ‘করেছেন কি? এই নিয়ে আপনি করোনা থেকে বেঁচে ফিরলেন কি করে?’
‘কাউকেই তো মরতে দেখলাম না। ভর্তির পর দিন তিনেক জ্বর ছিল। তারপরে শুধু বসে বসে গল্প করতাম। মেডিকেল কলেজের দুজন বাচ্চা ডাক্তারও আমার সাথে ভর্তি হয়েছিল। ভারী ভালো ছেলে। ওদের সাথেই বেশি গল্প করতাম।’
ওষুধ পত্র লিখে বললাম, ‘দু সপ্তাহ পরে আসুন। প্রেসার স্বাভাবিক হল কিনা দেখতে হবে।’
ভদ্রলোক বেরোতেই দাস কাকু মাথা বাড়ালেন। ‘আর রোগী নেই ডাক্তারবাবু। চট করে স্কুটার নিয়ে পালিয়ে যান।’
বিস্ময় মিশ্রিত পুলক অনুভব করলাম। ‘কিন্তু বাইরে যে চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলাম?’
‘এ ভদ্রলোক এমন ভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজের করোনা হওয়ার কথা জানালেন- শোনার পর সক্কলে পালিয়েছে। একজন পেটে ব্যথার পেশেন্ট ছিলো। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। সে পর্যন্ত দিব্যি সোজা হয়ে পালিয়ে গেল।’
আমি বললাম, ‘আহা, ভদ্রলোককে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ ছিল।’