বড্ড একঘেয়ে লাগছে। সারাদিন ধরে শুধু জ্বরের রোগী দেখছি। সকলের মুখ মাস্কে ঢাকা। চেনা লোককেও অচেনা লাগছে।
কারো কারো মুখ দেখলেই হঠাৎ করে খারাপ লাগাটা ভালো লাগায় বদলে যায়। এই অকালে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। মুখে কত কিছু ফুটে ওঠে। রোগের যন্ত্রণা, নেশা ছাড়তে না পারার অপরাধ বোধ। এমনকি মুখে ফুটে ওঠা কৃতজ্ঞতার ভাষাও আমি কখনও সখনও পড়ে ফেলেছি।
মুখোশ পরা রোগীদের চিকিৎসা করতে করতে মনে হচ্ছিল, মানুষ নয়- আমি যন্ত্রদের চিকিৎসা করছি। আমাকে প্রযুক্তিবিদের মতো খুঁজতে হবে কোথায় কলকব্জা ঢিলে হয়েছে। কোথায় বল-বিয়ারিং এ একটু অয়েলিং দরকার।
অথচ রোববার বিকালে যখন বাড়ি বাড়ি কাঁসর ঘন্টা বাজল, বধূরা শাখে ফুঁ দিলেন, তখন মনে বেশ পুলক জেগেছিল। প্রাণপণে চেয়েছিলাম এই ভালোবাসার আর শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে উঠতে। একটিও মাস্কে ঢাকা মুখ দেখে বিষণ্নতায় ভুগিনি।
কিন্তু সোমবার সকালেই খবর পেলাম এক সিস্টার দিদিমণিকে তাঁর প্রতিবেশীরা গ্রাম ছাড়া করেছেন। গ্রামবাসীদের ধারণা আর্ত মানুষদের সেবায় নিয়োজিত ওই নার্সের থেকে তাদের মহামারী ছড়াতে পারে।
তারপর বেলা যত বেড়েছে রাজ্যের বিভিন্ন কোন থেকে খবর আসতে শুরু করেছে। অনেক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ি থেকে বহু দূরের হাসপাতালে চাকরি করেন। হাসপাতালের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। তাদের অনেককেই বাড়িওয়ালারা উঠে যেতে বলেছেন।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বহরমপুর। সেখানকার লোকজন বাক্স প্যাটরা সহ অনেক চিকিৎসককে রাস্তায় বার করে দিয়েছেন। কারা লড়ছে, কিসের জন্য লড়ছে, মহামারীটা আসলে কিসের, সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। কোনটা সত্যিকারের মুখ, আর কোনটা মুখোশ?
একটা N95 মাস্ক পরলেই কি মানুষ এতটা বদলে যায়? এই মুখোশের মহামারীও কি কম ভয়ংকর?
রবিবার রাতে জ্বরের রোগী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়ছি। কাল যত দিন গড়িয়েছে মনে হয়েছে আমি এক হার মেনে নেওয়া সৈনিক। দিনগত পাপক্ষয় করছি। যাদের জন্য লড়ছি তারা সামনে প্রশংসা করবে, ‘আপনার মতো ডাক্তার হয় না। কিন্তু শালা অমুক ডাক্তার পিওর হারামী। আমার পিসতুতো ভাইয়ের শ্বশুরকে ভেন্টিলেটরে ঢুকিয়ে মেরে ফেলল। আবার বিল করেছে আড়াই লাখ।’
তারপর সুযোগ পেলে একদিন আমাকেও…..
রোগী দেখা প্রায় শেষের দিকে। রাত ক্রমশ মাঝরাতের দিকে গড়াচ্ছে। আমি জ্বরের রোগীর ইতিহাস শুনছি, বুকে স্টেথো বসাচ্ছি আর ওষুধ লিখছি। হঠাৎ একজন বললেন, ‘ঐন্দ্রিল, তুই কি আমায় চিনতে পারছিস না?’
উনি মাস্ক সরালেন। আমাদের স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক। সেই ছোটো বেলা থেকেই ফিজিক্সের জটিল অংক সমেত যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি যুগিয়েছেন।
আমার এতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। সত্যিই, মুখোশের আড়ালে মানুষ চেনা বড় দায়।
ভালো লেগেছে।