এবার করোনা রোগীরা সুস্থ হয়ে চেম্বারে ফিরে আসছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এখন আর রিপিট করোনা পরীক্ষা করার দরকার নেই। চিকিৎসক সুস্থ বলে সার্টিফিকেট দিলেই তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। চৌদ্দ দিন হোম আইসোলেশনে কাটানোর পর অনেকেই সার্টিফিকেট নিতে আসছেন।
সাধারণত রোগ সেরে গেলে কেউ ডাক্তারের কাছে ফেরত আসেন না। যারা আসেন, হয় তাদের জ্বর কমেনি অথবা পেটে ব্যথা আরও বেড়েছে। প্রথম দিকে হতাশ হয়ে পড়তাম। ভাবতাম, কারোরই তো অসুখ কমাতে পারছি না। আস্তে আস্তে বুঝলাম, দশ জনের মধ্যে দু- তিনজন ফেরত আসছেন। বাকিরা সুস্থ আছেন বলেই আসছেন না।
দিনকে দিন অভিজ্ঞতা বাড়ছে। এখন আর সহজে আনন্দ, মন খারাপ, হতাশা এইসব হয় না।
কতো রকমের মানুষ যে হয়!
সাধারণ মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, আমি ঠিক হয়ে যাবো তো?’
ধৈর্য্য হীন মানুষ, ‘আমার রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। আগে দেখে দিন। না হলে খারাপ কিছু যদি হয়, আপনি দায়ী থাকবেন।’
হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, বাবার বয়স পঁচাশি পেরিয়েছে। তিনবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। আর কোথাও ভর্তি করবো না। আপনি যা পারেন করুন। তারপর যা হওয়ার হবে।’
ঝগড়ুটে শাশুড়ী, ‘যবে থেকে ওই হারামজাদি মেয়ে আমার বাড়িতে এসেছে, তবে থেকে প্রেশারই কমছেই না।’
সর্বহারা শ্রমিক, ‘ডাক্তার বাবু, লকডাউনে কারখানা বন্ধ। আপনার কাছে ওষুধ গুলো হবে? কিনে খেতে পারব না।’
তৈল মর্দনকারী মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, আমি প্রচুর ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু আপনার মতো ডাক্তার আমি কখনো দেখিনি।’
রাজার অসুখে আক্রান্ত মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের ঝিন ঝিন টা কমে গেছে। কিন্তু তার পর থেকেই নাভির ঠিক দুই আঙুল নীচে বিন বিন করছে।’
সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত বুড়ো, ‘ডাক্তার বাবু, ছেলে কাজের লোককে দিয়ে চায়ে বিষ মেশাচ্ছে। আমি মরলে বাড়িটা প্রোমোটারকে বেচে দেবে।’
হাহাকার সর্বস্ব মা, ‘ডাক্তার বাবু, আমার দুটো মেয়েরই থ্যালাসেমিয়া। ওদের বাপ অন্য মেয়ের সাথে পালিয়েছে। কয়েক বাড়ি ঠিকে ঝির কাজ করতাম। লক ডাউনে কাজ চলে গেছে। তিনমাস মেয়েদের রক্ত দিতে পারিনি। আজ সকাল থেকে বড় মেয়েটার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা করুন।’
যাঁরা বলেন, ‘জীবন অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমা নয়’, তাঁরা একটা দিন আমার সাথে থাকুন। বুঝতে পারবেন অঞ্জনবাবুই মানুষের সত্যিকারের আবেগগুলোকে ধরেছিলেন। তা যতই মেলোড্রামাটিক মনে হোক।
ধান ভাঙতে শিবের গাজন হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রসঙ্গে ফেরত আসি। করোনা আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে প্রায় সকলেই ফেরত আসছেন। সুস্থ রোগী দেখলে চিকিৎসকের কনফিডেন্স বাড়ে। আমারও বাড়ছে। করোনাকে আর মোটেই ভয়ঙ্কর রোগ বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভবত একটু ওভার কনফিডেন্সেই ভুগছি।
আমার সব ক্যাশে কারবার। অনলাইন লেনদেনে সড়গড় নই। মহামারীর সময়ে দূরের কাউকে টাকা পাঠাতে হলে অন্যের দারস্থ হই। যে পাঠাচ্ছে তাকে পরে ক্যাশে টাকা দিয়ে দিই।
এক আত্মীয় আমার হয়ে হাজার তিনেক টাকা অন্যকে পাঠিয়েছিল। চেম্বার শেষ করে রাত সাড়ে নটায় ফোন করলাম, ‘বাড়ি আছো? তাহলে টাকাটা দিয়ে আসি।’
‘রাখত টাকা। পরে দিস। এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?’
বললাম, ‘চারিদিকে যা অবস্থা। করোনা রোগীতে ছেয়ে গেছে। এ সময় কারো কাছে ঋণ বাকি রাখতে চাইনা। কখন কি হয়ে যায়।’
‘তুই এত ভাবিস না। তোর কিচ্ছু হবে না। তোর বয়স কম। কোন অসুখ-বিসুখ নেই। তোর আবার কি হবে?’
বললাম, ‘ইয়ে…. আমি আমার কথা না, তোমার কথা ভাবছিলাম। তোমার তো আবার সুগার প্রেসার দুটোই আছে। এ সময় ঋণ বাকি না রাখাই ভালো।’
মুশকিল হলো এর পরেই মোবাইলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আমিও টাকা ফেরত দিতে যেতে ভরসা পাচ্ছি না।