মন মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। চারদিক থেকে চিকিৎসক সহকর্মীদের মৃত্যুর খবর আসছে। যাঁকে চিনতাম, শ্রদ্ধা করতাম, সেই হঠাৎ করে নেই হয়ে যাচ্ছেন।
তাছাড়া একঘেঁয়েমিও আসছে। দিনের পর দিন রোগী দেখতে কার ভালো লাগে? তাও অধিকাংশ জ্বরের রোগী।
খারাপ মেজাজে রোগী দেখছিলাম। সামনের মাঝবয়সী রোগিনী কাঁদছেন। বললাম, ‘কান্না শেষ করে চটপট বলুন।’
রোগিনী বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, হাজব্যান্ড করোনা হয়ে ……….. (একটি নামকরা কর্পোরেট হাসপাতাল)-এ ভর্তি। ভেন্টিলেশনে আছেন। অবস্থা ভালো নয়। ওখানকার ডাক্তারবাবু বলেছেন, করোনার সাথে ওনার ডেঙ্গুও হয়েছে।’
বললাম, ‘দেখুন, এখন শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে কি করে চলবে?’
‘ডাক্তারবাবু, আমিই যাতায়াত করছিলাম। টাকা পয়সার জোগাড় যন্ত্র করছিলাম। কাল থেকে আমার জ্বর আসছে। কাশি হচ্ছে। মাথা তুলতে পারছি না। এবার কে ছোটাছুটি করবে?’
আমি বললাম, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
উনি বললেন, ‘একমাত্র মেয়ের পুনেতে বিয়ে হয়েছে। ওর পক্ষে বাচ্চা নিয়ে এ সময় আসা অসম্ভব।’
এসব সমস্যার সমাধান আমার হাতের বাইরে। ওষুধ পত্র লিখে বললাম, ‘আপনাকেও করোনা পরীক্ষা করতে হবে। কালকেই করে নিন।’
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে তখন কি করব? বাড়ির বাইরে তো বেরোতে পারবো না? না না….. এখন টেস্ট করা যাবে না। এমনিতেই কোথা থেকে টাকা জোগাড় করবো সেই চিন্তায় ঘুম নেই।’
গৌড় দরজা ফাঁক করে মাথা বাড়ালো। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমাকে আবার একজন ফোন করেছিল। জানতে চাইছিলো আপনার করোনা হয়েছে কিনা।’
এই হয়েছে এক মুশকিল। সারাদিন রোগী দেখার পরেও নিস্তার নেই। তাদের ফোনের ঠেলায় অস্থির। তার সাথে এই সময় উৎসাহী জনতার নিত্য নতুন জিজ্ঞাসা।
‘ডাক্তারবাবু, কাঁচা হলুদ কি করোনা প্রতিরোধ করে?’
‘পালস অক্সিমিটার কোন কোম্পানিরটা কিনব?’
‘আমাজনের অক্সিজেন কনটেইনারগুলো কি কাজের জিনিস?’
তার সাথে মাঝে মাঝেই ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি ভালো আছেন তো? শুনছিলাম… মানে একজন বলল, আপনার নাকি করোনা……’
গৌড়কে বললাম, ‘ঝটপট কয়েকজন রোগীর প্রেশার মেপে পাঠাও। বড্ড ভিড় জমে গেছে। ভিড়টা ফাঁকা করে দিই।’
একমনে রোগী দেখছিলাম। একটি মধ্যবয়স্ক মানুষ মাথা বাড়ালেন, ‘আজ্ঞে, আপনি মায়ের প্রেশার মেপে জানাতে বলেছিলেন।’
ইনি ভ্যান চালান। ওনার মা লকডাউনে প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দশ দিন আগে স্ট্রোক হয়ে ডানদিক পড়ে গেছে। যখন আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন, উপরের প্রেশার ২০০ ছুঁয়েছে।
সোদপুরে বাড়ি। ভর্তি করতে বলেছিলাম। উনি জানিয়েছিলেন, ‘ভর্তি করা সম্ভব নয়। ঘোলা হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম, বলেছে আরজিকর নিয়ে যেতে।’
স্ক্যান করতে বলেছিলাম। জানিয়েছিলেন, ‘টাকা পয়সা জোগাড় করে করার চেষ্টা করব।’
গ্লুকোমিটারে সুগারটা মাপা হয়েছিল। সেটাও চারশোর উপরে। ওষুধ পত্র লিখে বলেছিলাম, দশদিন বাদে প্রেশার আর সুগার মেপে জানাতে। বুড়ি মাকে আর এদ্দূর টেনে আনতে হবে না।
প্রেশার আগের চেয়ে কমেছে। বললাম, ‘সুগার মেপেছো?’
উনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, যদি ঐ যন্ত্রটা দিয়ে আরেকবার মেপে দেন।’
‘মানে?’
‘মাকে ভ্যানে করে নিয়ে এসেছি ডাক্তারবাবু।’
রেগেমেগে বললাম, ‘মাকে বাড়ি থেকে বের করতে বারণ করলাম, আর তুমি মাকে এই অসুস্থ শরীরে দশ কিলোমিটার ভ্যানে করে নিয়ে এলে?’
উনি কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘কি করবো ডাক্তারবাবু, কেউ প্রেশার মাপতে চাইছে না। একজন বলল বাড়ি গিয়ে মাপতে পারে। একশো টাকা নেবে। সুগারও একশো টাকা। এই অকালে অত টাকা কোথায় পাব?’
বললাম, ‘চলো, মাকে যখন নিয়েই এসেছ, আরেকবার দেখি।’
বাইরে গিয়ে দেখি ভ্যানের উপর বুড়ি বালিশে হেলান দিয়ে রীতিমত বসে আছে। বৌমা একহাত দিয়ে বুড়িকে জড়িয়ে ধরেছে।
বললাম, ‘এই তো, দিব্যি আছো ঠাকুমা। এই লকডাউনের বাজারে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছো।’
খুব সত্যি। আমি নিজে ভর্তি। দেখছি অবস্থাটা। আমার মা ভর্তি আমার সাথে। কি যে অবস্থা পরিবারের ও চিকিৎসকরা ও কি করবেন?