আজকাল আর আড্ডা দেওয়া হয় না। আমার আড্ডা দেওয়ার মানুষ বলতে তো রোগীরাই। এমনিতে এখন বেশিরভাগই জ্বরের রোগী। এবং রোজ তার মধ্যে জনা দশেকের করোনা ধরা পড়ছে। সে কারণে তাদের সাথে খেজুরে আলাপ করার সাহস পাচ্ছিনা।
তাছাড়া রোগীর সংখ্যাও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। সেটার কারণ চিকিৎসা শাস্ত্রে আমার পারদর্শিতা সম্ভবত নয়। এটার মূল কারণ চিকিৎসকের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় না থাকা।
কিন্তু কারো সাথে মন খুলে গল্প করতে না পারলে পেটের ভাত হজম হয় না। শনিবার বাড়ির চেম্বারের পরে আর চেম্বার নেই। তাই তাড়াহুড়োও নেই। এক গৃহ শিক্ষকের সাথে গল্প জমে উঠলো।
ততক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি উনি করোনা রোগে নয়, করোনার আতঙ্কে ভুগছেন। ভিড় বাসে ঠেলাঠেলি করে তিনদিন আগে কলকাতায় গেছিলেন। তারপর থেকেই বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভদ্রলোক বললেন, ‘বুঝলেন ডাক্তারবাবু, বড়লোকরা বিদেশ থেকে দেশে এ রোগটা টেনে এনে ঢোকালো, আর মরবো আমরা।’
বললাম, ‘কেন, বড়লোকদেরও তো হচ্ছে মাস্টারমশাই?’
ওনার দেখলাম বড়লোকদের ওপর ভীষণ রাগ। রেগেমেগে বললেন, ‘ওদের হলে তো সমস্যা নেই। পাঁচতারা হাসপাতালে রাজকীয় চিকিৎসা পাবে। মাঝখান থেকে মরবো আমরা। একেবারে ধনে প্রাণে মরবো। ইতিমধ্যে আধমরা হয়েই গেছি।’
একটু থেমে বললেন, ‘যে কজন ছেলে মেয়েকে পড়াতাম তার মধ্যে মাত্র পাঁচজন এ মাসের মাইনে দিয়েছে। এভাবে চললে সবজি নিয়ে আমাকেও পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে হবে। কি করে যে কি করব, চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না।’
এসব কথা চুপ করে শুনে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভদ্রলোক বলে চলেছেন, ‘মাঝে মাঝে অবাক লাগে আমরা কি আদৌ সভ্য হচ্ছি? নাকি আরো অসভ্য হচ্ছি? মানুষের এই দুর্দিনেও দেখুন ত্রাণ নিয়ে কিরকম দুর্নীতি চলছে। মানুষ দুবেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে, আর আমাদের নেতারা ভোটের রাজনীতিতে বুঁদ হয়ে আছেন।’
আমি বললাম, ‘অসভ্যতাই যে সভ্য হয়ে ওঠার প্রাক শর্ত মাস্টারমশাই।’
‘মানে?’
‘আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগে ইউরোপের শিক্ষিত মানুষেরা সভ্যতার আলো নিয়ে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছেছিল। ওখানকার আদি বাসিন্দা অসভ্য রেড ইন্ডিয়ানদের যখন কিছুতেই বশ করতে পারছিল না, তখন কি করেছিল জানেন? হত দরিদ্র রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে শয়ে শয়ে কম্বল বিতরণ করেছিল।’
‘সেতো অত্যন্ত ভালো কাজ। সভ্য মানুষদের মত কাজ।’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘কম্বলগুলো ছিল হাসপাতালে স্মল পক্সে আক্রান্ত মৃত রোগীদের। উত্তর আমেরিকা স্মল পক্স মুক্ত অঞ্চল ছিল। তাই এই রোগের বিরুদ্ধে রেড ইন্ডিয়ানদের কোনরকম গোষ্ঠী ইমিউনিটিও ছিল না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে কয়েক লাখ রেড ইন্ডিয়ান স্মল পক্সের মহামারীতে মারা গেল। আমেরিকা শেষমেশ সত্যিকারের সভ্য দেশ হয়ে উঠল।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘মাঝে মাঝে সভ্যতা আর অসভ্যতার সংজ্ঞা গুলিয়ে যায়। তবে এখনো আমি বিশ্বাস করি কেউ একজন আছেন। তিনি সব কিছুর হিসাব রাখছেন। সবকিছুর সামঞ্জস্য বজায় রাখছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনি শেষ পর্যন্ত ভগবানের উপর ভরসা করছেন মাস্টারমশাই?’
উনি হাসলেন। বললেন, ‘তাছাড়া আমাদের মত অভাগার আছেই বা কে? এই দেখুন না, সব বড়োসড়ো আবাসনগুলোয় একের পর এক করোনা কেস ধরা পড়ছে। অথচ রেললাইনের ধারে যারা থাকেন, খালপাড়ে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে কিন্তু সংক্রমণ অনেক কম।’
আমি বললাম, ‘এভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘তাহলে সরকারি পরিসংখ্যান দিই। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দেড় লাখ লোকের করোনা হয়েছে। মারা গেছেন তিন হাজার। সেখানে ইংল্যান্ডে তিন লাখের সামান্য বেশি মানুষের করোনা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মাত্র দ্বিগুণ। অথচ মারা গেছেন একচল্লিশ হাজার। আমাদের চৌদ্দ গুণ। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে ভালো?’
গৌড় মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আর একজন রোগী এসেছে। পেটে ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে।’
মাস্টারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ওই ভরসাটুকু নিয়েই তো এখনো বেঁচে আছি ডাক্তারবাবু।’