কোভিড ১৯ পরীক্ষা করানো এখন অনেক সহজ হয়েছে। কয়েকদিন আগেও আমরা যারা বেসরকারি চিকিৎসক, চাইলেই করোনা পরীক্ষা করাতে পারতাম না। পরীক্ষা হতো খুব অল্প জায়গায়। আর খরচও লাগতো প্রায় আড়াই হাজার টাকা। লকডাউনের মধ্যে অধিকাংশ মানুষেরই সঞ্চয় তলানিতে। তাই আড়াই হাজার টাকার পরীক্ষা লেখার আগে অনেক ভাবনা চিন্তা করতে হতো।
ইদানীং সরকারি তরফে অনেক জায়গাতেই বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার বন্দোবস্ত হয়েছে। আমাদের আশেপাশে কারবালা ও দোহাড়িয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, মধ্যগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে, নববারাকপুর শক্তি সংঘে, ঘোলা হাসপাতালে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষা করতে বলার জন্য বিশেষ ভাবনা চিন্তা করতে হচ্ছে না। সন্দেহ হলেই পরীক্ষা লিখছি।
তবুও সমস্যা রয়ে গেছে। আজ একটি ছেলে এসেছিল, সাত দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। সাথে গলা ব্যথা, কাশি। করোনা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। পাঁচ দিন আগেই তাকে পরীক্ষা করতে বলেছিলাম। করায়নি।
রেগেমেগে বললাম, ‘আগের দিন এতো বোঝালাম, কারবেলায় গিয়ে টেস্টটা করিয়ে নাও। বিনা পয়সায় হয়ে যাবে। করোনি কেন?’
ছেলেটি বলল, ‘ডাক্তারবাবু, টেষ্ট করলেই নাকি পজিটিভ আসছে?’
‘করোনা হলে পজিটিভই তো আসবে। তুমি টেস্ট করালে সম্ভবত তোমারও পজিটিভ আসবে।’
ছেলেটি বলল, ‘সেই ভয়েই তো পরীক্ষা করছি না। ফুটপাতে একটা কাপড়ের দোকান আছে। এত মাস বন্ধ থাকার পর খুলেছি। করোনা হয়ে আরও চৌদ্দ দিন বাড়ি বসে থাকলে ওই দোকান আর এ জীবনে খুলতে পারবো না।’
একজন ভাঙাচোরা চেহারার মহিলাকে পরীক্ষা করার জন্য লেখায় সে জানালো, ‘লকডাউন এর আগে সাত বাড়িতে ঠিকে ঝির কাজ করতাম। চার বাড়িতে কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা ধরা পড়লে বাকি তিনটে কাজও চলে যাবে।’
বেশিরভাগ মানুষের একটাই কথা, ‘টেস্ট করতে আপত্তি নেই। কিন্তু করোনা ধরা পড়লে কি করব? দু-তিন সপ্তাহ বাড়িসুদ্ধ সবাই বসে গেলে খাওয়া জুটবে কোথা থেকে? এমনিতেই তো লকডাউনে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।’
কয়েকজনকে বলেছিলাম, ‘কেন, সরকারতো আপনাদের জন্য সেফ হোমের ব্যবস্থা করেছে।’
কেউই সেফ হোমের বিষয়টা জানেন না। বুঝিয়ে বলার পর তাদের বক্তব্য, ‘বাড়ির বাকি লোকদের কি হবে? আমাকে না হয় সরকার বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। কিন্তু পরিবারের বাকিদেরও তো বাড়িতে চৌদ্দ দিন বসে থাকতে হবে।’
কলকাতা ও তার আশেপাশের শহরে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এবং চাকুরিজীবী মানুষেরা থাকে। দীর্ঘদিন বাড়িতে কোয়ারান্টাইনে থাকলেও তাদের সমস্যা নেই। কিন্তু করোনা মহামারী আস্তে আস্তে দূরের মফস্বল ও গ্রামে-গঞ্জে ছড়াচ্ছে। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষের সরকারি সাহায্য ছাড়া দীর্ঘদিন কোয়ারান্টিনে থাকা অসম্ভব।
এই গরীব মানুষগুলির জন্য করোনা ধরা পড়লে যদি কিছু অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে তারা কিছুতেই পরীক্ষা করতে রাজি হবে না। অসুস্থ শরীরে জীবিকা অর্জনের মরিয়া প্রচেষ্টায় তারা মহামারীকে ছড়াতে আরও সাহায্য করবে।
করোনা ধরা পড়লে সমাজে অচ্ছুৎ হয়ে যাওয়ার ভয় অনেকটা কমেছে। সরকার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবে সেই ভয়ও কেটে গেছে। সেসব ভয়ে নয়, এখন করোনা পরীক্ষা না করানোর প্রধান কারণ কাজ হারানোর ভয়।
ভালো লেখা।