ক্রমশ অবসাদ গ্রাস করছে। অবসাদ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেকদিনই টিভি দেখা, সংবাদ পত্র পড়া ছেড়ে দিয়েছি। তবু কিছু কিছু খবর এড়িয়ে যেতে পারিনা।
ডা. সুরেন্দ্র নাথ বেরার খবরটি যেমন। মাত্র ৩২ বছর বয়সেই স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারবাবু হেরে গেল করোনার কাছে। সে কাজ করতো মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে।
খবরটা শোনার পর থেকে আর ছেলেটির ছবি দেখার পর থেকে কোনও কিছু ভালো লাগছে না। মেঘালয়ের তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করেছিলাম, এক লাইনও লিখতে পারছি না। সারাদিন ধরে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে উঠছে ছেলেটির মুখ।
সবচেয়ে খারাপ লাগছে, এতো চিকিৎসক আর স্বাস্থ্য কর্মী মারা যাচ্ছেন, তাঁদের জীবনদান পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। তাঁদের মৃত্যুকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পারতাম, যদি আমরা সকলে একযোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সোচ্চার হতে পারতাম। দরিদ্র আর প্রান্তিক মানুষদের জন্য আধুনিক চিকিৎসার দাবীতে সরব হতে পারতাম।
কিন্তু দুঃখজনক ভাবে আমাদের যাবতীয় আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরে গেছে কর্পোরেট হাসপাতালে কেন এতো খরচ হবে সেই দিকে। বুদ্ধিজীবী অভিনেতা রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষকে উস্কাচ্ছেন কর্পোরেট হাসপাতাল গুলি ভাঙচুর করার জন্য। অথচ কেউ প্রশ্ন করছে না কেন মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে ঘটি বাটি বেচে বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার উপর নির্ভর করতে হবে।
করোনা কালের নিয়মে একসময় বিদায় নেবে। বেশ কিছু সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকের প্রাণের বিনিময়ে মহামারী থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পালটাবে না। বরঞ্চ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও বেশি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বিমা কোম্পানিগুলো ফুলে ফেঁপে উঠবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আরও খারাপের দিকে যাবে।
আর আমরা অসহায় চিকিৎসকেরা ডা. সুরেন্দ্র নাথ বেরার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকব। কর্ম জীবনের শুরুতেই নিজের পরিবারকে ভাসিয়ে চলে গেল ছেলেটা। ওর দুই শিশু সন্তানের আর কোনও দিন বাবা বলে কাউকে ডাকার সৌভাগ্য হবে না। যাদের একজনের বয়স পাঁচ। আর একজনের বয়স কয়েক মাস মাত্র। বাবাকে নিয়ে তাদের কোনও স্মৃতিই তৈরি হয়নি।
হয়তো সরকারি কমিটি খতিয়ে দেখবে ডা. বেরাকে কোভিড যোদ্ধার সম্মান দেয়া যায় কিনা? কোভিড যোদ্ধার সম্মান পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সরাসরি কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সাথে যুক্ত থাকার কথাও নয়।
আর কিসেরই বা যোদ্ধা? আমরা যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই হেরে গেছি। রোগী দেখে কি হবে, তার কাছে যদি ওষুধ কেনার মতো অর্থই না থাকে? ওষুধ খাইয়েই বা কি হবে যদি তার দুবেলার খাবার না জোটে? একদিকে দুধের শিশু অনলাইনে ক্লাস করছে, অন্যদিকে লকডাউনের সময় হাজার হাজার ছাত্র স্কুল ছুট হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন রোগী দেখা ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠছে। একদমই ভালো লাগছে না। কারণ জানি আমাদের সব কাজই অর্থহীন। জনস্বাস্থ্যের এই বিপর্যয়ের সময়েও মিডিয়াগুলি মেতে থাকবে কোন অভিনেতা, কোন অভিনেত্রী কি নেশা করেন তাই নিয়ে। এবং জনসাধারণও সেই আলোচনাতেই মসগুল থাকবে।
ডাঃ সুরেন্দ্র নাথ বেরার মৃত্যু কোথাও কোনও রেখাপাত করবে না। যেমন করেনি পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর। কাজ হারানো মানুষের আত্মহত্যার খবর।
ভালো লেখা।