সাত সকালে স্কুটার নিয়ে মিলন পল্লীতে গৌড়ের চেম্বারে রোগী দেখতে যাচ্ছিলাম। চৌমাথার সিগন্যালে আটকে গেলাম।
লকডাউনের কল্যাণে এসব সিগন্যালের কথা ভুলেই গেছিলাম। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর পরই সব সিগন্যাল আবার স্বমহিমায় ফেরত এসেছে।
তখন বাড়ি থেকে সাত মিনিটে ঘোলা যেতাম, পাঁচ মিনিটে মিলন পল্লী। আর আজ দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর যদি বা সিগন্যাল সবুজ হলো, কিন্তু চৌমাথা পেরোনোর আগেই আবার লাল।
বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। আমার পাশের সাইকেল চালক, যার মাস্ক গলা থেকে ঝুলছে, পিচিক করে গুটখা রঞ্জিত লালারস আমার পা ঘেঁষে ফেললেন।
আমি সভয়ে পা সরিয়ে তাঁর দিকে কটমট করে তাকাতেই তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘ভুল হয়ে গেছে দাদা। মাফ করেন।’
দিনের শুরুতেই তর্ক করতে ভালো লাগে না। কিন্তু সাতটা বাজার আগেই চৌমাথাতে এতো ভিড় কেন? এক্সিডেন্ট ট্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি? গাড়ি ঘোড়ার ফাঁক দিয়ে দেখছি লোকে লোকারণ্য।
সাইকেল চালক লোকটি কালো দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, ‘লোকাল ট্রেন শিগগিরী চালু না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
আমি বললাম, ‘মধ্যমগ্রাম হাট চৌমাথাতেই বসছে নাকি?’
‘হাট নয়, এ হলো কাজে যাওয়ার সংগ্রাম। আমিও দু’চারদিন লড়েছিলাম। এখন সাইকেলে যাই। কষ্ট হয় বটে, কিন্তু মারামারি করে বাসে যাওয়ার চেয়ে কম। তাছাড়া করোনা হওয়ার সম্ভাবনাও কম, যাতায়াতের খরচ কম। অনেক সুবিধা।’
বললাম, ‘সাইকেলে কদ্দুর যান?’
‘বৈঠকখানা বাজার। ওখানে একটা ছাপাখানায় কাজ করি। যাতায়াতে রোজ পঞ্চাশ কিলোমিটার সাইকেল চালাই।’
সিগন্যাল আবার সবুজ হলো। আমি চৌমাথা ছাড়িয়ে দাড়ালাম। একটা বাস আসল। সকলে হই হই করে দৌড়ে গেল।
এক বয়স্ক ব্যক্তি দৌড়াতে গিয়ে পরে গেছেন। দু-তিনজন তাকে মাড়িয়েই ছুটল।
কন্ডাকটর গেটে দাঁড়িয়েই চিৎকার করছেন, ‘আর উঠবেন না। আর জায়গা নেই।’
একজন অতিউৎসাহী ব্যক্তি তাকেই টেনে বাস থেকে নামিয়ে নিজে উঠে গেলেন।
কোথায় শারীরিক দূরত্ব! কোথায় মাস্ক!! অনেকেরই মাস্ক আছে বটে, কিন্তু ন্যাতার মতো বহু ব্যবহৃত জীর্ণ মাস্কগুলি গলা থেকে ঝুলছে।
লাদেন নামে পরিচিত বিপজ্জনক মোটর ভ্যানে ঠেসে লোক উঠছে। দুজনের মধ্যে ছয় ফুট দূরত্ব তো দূরের কথা, ছয় মাইক্রোমিটার দূরত্বও নেই। বিড়ি টানতে টানতে শ্রমজীবী মানুষেরা কাজে যাচ্ছেন।
ছোটো হাতি, চারশো সাত- যিনি যাতে পেরেছেন, চড়ে বসেছেন। বাড়ি বসে থাকলে সরকার অর্থ সাহায্য করবে না। জীবিকার জন্য তাঁরা মহামারীর ভয়কে তুচ্ছ করছেন।
দেখতে দেখতে উপলব্ধি করলাম আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বার্থপর জীব। আমাদের সরকার, আমি- সবাই।
সরকার দিনের পর দিন লোকাল ট্রেন বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু মানুষ কিভাবে কাজে যাবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। তাদের দায়িত্ব নিতেও নারাজ।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র মাস্ক। সরকার থেকে দিব্যি শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে ভালো মানের মাস্ক বিতরণ করা যেতো। তাদের মধ্যে মাস্ক পরার সুফল নিয়ে আলোচনা করা যেতো। কিন্তু সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত।
আমিও আরও বড় স্বার্থপর। এই মহামারীর মিলন ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে ভাগ্যিস আমার একটা নিজস্ব স্কুটার আছে। ভাগ্যিস যাতায়াতের জন্য এদের মতো মারামারি করতে হয় না। এদের মতো জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় না।
একটি এন- ৯৫ ও একটি সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চশমার কাচ ঝাপসা হলো। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে টুকটুক করে চললাম মিলন পল্লীর খুপরিতে। ওখানে অন্তত জনা ত্রিশেক জ্বরের রোগী অপেক্ষা করছেন।
এরপর আবার দুর্গাপুজো আসছে। জোর কদমে প্যান্ডেলের বাঁশ বাধা হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
ছবি ঋণ: অভিজিৎ পাল